সৌদির তেলের খনির যত রহস্য

 


ODD বাংলা ডেস্ক:  খনিজ তেলকে বলা হয় তরল সোনা। সমগ্র বিশ্বের ১৬ শতাংশ খনিজ তেলের মজুদ রয়েছে সৌদি আরবে। দেশটির জাতীয় পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির নাম সৌদি আরামকো। আরামকোর অধীনে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল মজুদ রয়েছে এবং দৈনিক সবচেয়ে বেশি খনিজ তেল উৎপাদন করে সৌদি আরামকো। ২০১৫ সালে মার্কিন ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে, সৌদি আরামকো বিশ্বের বৃহত্তম তেল ও গ্যাস কোম্পানি। শুধু তাই নয়, এটি বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের সদস্যদের মধ্যে সৌদি আরবই সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে। দেশটির অর্থনীতি খনিজ তেলের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। সৌদি আরবের রপ্তানি পণ্যের ৯০ শতাংশই হলো তেল। সৌদি আরবের জাতীয় বাজেটের ৮৭ শতাংশই খরচ করা হয় পেট্রোলিয়াম খাপ থেকে এবং সৌদি আরবের জিডিপির ৪২ শতাংশই আসে খনিজ তেল থেকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই কোম্পানিটি সৌদি আরবের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। 


সৌদি আরবের প্রত্যেক ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরামকোর দ্বারা লাভবান হচ্ছে। সৌদি আরবের মতো একটি বিচ্ছিন্ন অনগ্রসর মরুভূমির দেশ বিশ্ব নেতৃত্বের স্থানে আসার পেছনে আরামকোর অবদান সবচেয়ে বেশি। সৌদি তেলের খনি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে মূলত আরামকোর ইতিহাস আলোচনা করতে হবে। ১৯৩৩ সালে সৌদি বাদশাহ আব্দুলআজিজ এবং মার্কিন কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের চুক্তির মাধ্যমে এরাবিয়ান আমেরিকান অয়েল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি অব ক্যালিফোর্নিয়া নামে আরো একটি কোম্পানি যুক্ত ছিল।


এই কোম্পানির বর্তমান নাম শেভরন। সেই দুটি বিদেশি কোম্পানি ৫০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ডের বিনিময়ে সৌদি আরব থেকে একচেটিয়া তেল উত্তোলনের জন্য বাদশার অনুমতি লাভ করেছিল। বাণিজ্যিকভাবে তেল উত্তোলন করতে পারলে আয় অনুযায়ী অর্থ বণ্টনের বিষয়ে সম্মত হয়েছিল উভয়পক্ষ। তবে তখনও সৌদি বাদশা ধারণা করতে পারেন নি, কি আলাদিনের চেরাগ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। 


১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বরে দুইজন আমেরিকান ভূতাত্ত্বিক সৌদি আরবের জুবাইল বন্দরে আসেন। তারা এই অঞ্চলের অনুর্বর ভূমিতে তেলের অনুসন্ধান চালান। ১৯৩৪ সালে এরাবিয়ান আমেরিকান অয়েল কোম্পানি জুবাইলে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে। এখান থেকেই তারা মানচিত্র তৈরি করে মরুভূমির মধ্যে তেল খোঁজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। প্রথম দিকে মরুভূমি থেকে পাথরের নমুনা সংগ্রহ করে সমগ্র উপমহাদেশের ভূত্বক সম্পর্কে ধারণা লাভ করা হয়। 


বিস্তৃত অজানা মরুতে চলার জন্য প্রথম দিকে তারা উটের উপর নির্ভরশীল ছিল। পরবর্তীতে অনুসন্ধানে কিছুটা গতি আনতে মোটরগাড়ির ব্যবহার শুরু হয়। এরপর বিমানের সাহায্যে মরুভূমির উপর থেকে হাজার হাজার ছবি তুলে বিস্তৃত এলাকা পর্যবেক্ষণ করা হয়। বিভিন্ন উপায়ে ভূমি জরিপ করার পর এবার মরুভূমির মাটি খুঁড়ে দেখার পালা। তবে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পৃথিবীর এই দুর্গম প্রান্তে খনন কাজ পরিচালনার উপযোগী যন্ত্রপাতি পরিবহন করা।


 প্রথম যে কূপ খনন করা হয়েছিল, সেখানে কোনো তেল ছিল না। প্রায় তিন বছর যাবত বিভিন্ন জায়গায় খনন কাজ করেও পর্যাপ্ত তেল পাওয়া যাচ্ছিল না। সামান্য কিছু তেল পাওয়া গেলেও বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। এরই মধ্যে ১৯৩৭ সালে হঠাৎ করে একটি তেলকুপে বিস্ফোরণ ঘটে। পর পর ছয়টি কূপ খনন করার পরও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় নি। এরপর 'ওয়েল সেভেন' বা সাত নাম্বার কূপ সৌদি আরবের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে।


১৯৩৮ সালের ধাহরানের কাছে দাম্মাম তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এটি সৌদি আরবের প্রথম বাণিজ্যিক তেলক্ষেত্র। সৌদি আরমকোর প্রধান কার্যালয়ও এই ধাহরান শহরেই আবস্থিত। প্রথমদিকে বিদেশিরা সৌদি আরব থেকে বিপুল পরিমাণ তেল নিয়ে যেতে থাকে। এরপর ১৯৫০ এর দশকে বাদশাহ আব্দুলআজিজ আরামকোকে জাতীয়করণ করার হুমকি দেয়। তখন আরামকো তাদের লভ্যাংশ আধাআধি ভাগ করে নিতে সম্মত হয়। ৭০ ও ৮০ দশকে সৌদি সরকার কোম্পানির সম্পূর্ণ মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। 


১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর সৌদি সরকার আরামকোর ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। ১৯৭৪ সালের সৌদি আরবের মালিকানা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ শতাংশে। ৮০ দশকে পুরো কোম্পানি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয় সৌদি শাসকগোষ্ঠী। বর্তমানে সৌদি আরমকো প্রতিদিন এক কোটি ২৫ লাখ ব্যারেল তেল প্রক্রিয়াজাত করে। যেখান থেকে তাদের দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি ডলার আয় হয়। অতীতে আরামকো উপার্জনের ৮৫ শতাংশ অর্থই সৌদি সরকারকে কর দিতে হতো। ২০১৭ সালে সৌদি সরকারের সেই করের পরিমাণ কমিয়ে ৫০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তারপরও ২০১৮ সালে আরামকো ১০ হাজার কোটি ডলার কর সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে।


আরামকো বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি কোম্পানি। পৃথিবীর প্রতি আট ব্যারেল তেলের মধ্যে এক ব্যারেল উৎপন্ন করে সৌদি আরামকো। এটি পৃথিবীর একমাত্র কোম্পানি যারা ব্যারেল প্রতি মাত্র ১০ ডলারের কম মূল্যে তেল উৎপাদন করতে পারে। সৌদি আরামকো শুধু বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানিই নয়, আরামকোর পর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা তেল কোম্পানি আরামকোর চেয়ে বহুগুণ পিছিয়ে আছে। আরামকোর তেলের রিজার্ভ আছে প্রায় ২৬১ বিলিয়ন ব্যারেল এবং দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মার্কিন কোম্পানি এক্সন মোবিলের রিজার্ভ আছে মাত্র ১৩ বিলিয়ন ব্যারেল।  


জ্বালানি খাতের বাইরে সব ধরনের কোম্পানির বাজার মূল্যের হিসেবে সৌদি আরামকো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ কোম্পানি। বর্তমানে শীর্ষ কোম্পানি অ্যাপেলের বাজারমূল্য ২.১ ট্রিলিয়ন ডলার এবং সৌদি আরামকোর বাজারমূল্য ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। তবে অ্যাপেলের আগে দীর্ঘদিন সৌদি আরামকোই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কোম্পানি। সৌদি আরামকোর অধীনে প্রায় ৬৫ হাজার কর্মী রয়েছে। তবে এই কোম্পানির কারণে পরোক্ষভাবে সৌদি আরবের লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।


প্রথমদিকে ভূতাত্ত্বিকেরা শুধুমাত্র ভূমির উপরের আলামত দেখে তেলক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজ করতো। তবে বর্তমানে আরামকো অতি আধুনিক সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে সম্ভাব্য তেলক্ষেত্র আবিষ্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরামকো 'দাম্মাম সেভেন' নামের এক সুপার কম্পিউটার নির্মাণ করেছে। তাদের প্রথম বাণিজ্যিক কূপের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। এটি পৃথিবীর শীর্ষ দশটি সুপার কম্পিউটারের মধ্যে একটি। 'দাম্মাম সেভেন'- এর সাহায্যে মাটির শত শত কিলোমিটার গভীরে কি আছে তার থ্রিডি মডেল দেখা যায়। 


এসব উচ্চমাত্রার জিওফিজিক্যাল ডেটা পর্যালোচনা করে অনেক সহজ আর নিরাপদে নতুন নতুন তেলের খনি আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে। তেলের দাম কমে যাওয়ার পর থেকে সৌদি আরব সরকার আরামকোর মতো প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার বাজারে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছে যা ছিল বিশ্ব শেয়ার বাজারের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। সৌদি আরবের মতো কাতারও তার মাটির নিচের খনিজ সম্পদের কারণে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। তবে কাতার শুধু খনিজ তেলই নয়, সেই সঙ্গে পেয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিটিও রয়েছে কাতারে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.