‘ভাসমান’ নগরী ভেনিস নির্মাণের গল্প

 


ODD বাংলা ডেস্ক: চার দিকে জল আর পাজল। নীলের অসাধারণ এক সৌন্দর্য। আর এই সৌন্দর্যের বুকে গড়ে উঠেছে বিচিত্র একটি শহর। যেখানে বহু মানুষের বসবাস। অনেকেই এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। বলছি, ইউরোপের একটি দেশ ইতালির ভেনিস শহরের কথা। শহরটি পর্যটকদের বেশ পছন্দের একটি জায়গা। এই শহরটি 'সিটি অফ লাভ' নামেও খ্যাত। এছাড়া মুখোশের শহর হিসেবে ও বহুল পরিচিত। ১১৮টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভেনিস নগরী। ভূমধ্যসাগরের অ্যাড্রিয়াটিক অংশের দিকে ভেনেতিয়ান উপহ্রদে এই নগরীর অবস্থান। 


দ্বীপগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে ৪০০টিরও বেশি সেতু এবং এ শহরে রয়েছে ১৭৭টি খাল। তবে ১০০টির বেশি দ্বীপ নিয়ে শহরটি গড়ে উঠলেও বেশিরভাগ ভবন এবং বাসস্থান দ্বীপগুলোতে সরাসরি নির্মাণ করা হয়নি। ভাসমান শহর ভেনিসের ভবন এবং সেতুগুলো জলে ভেসে আছে কাঠের তৈরি খুঁটির সহায়তায়। জলের উপর নির্মিত এই শহরটিতে যানবাহনের মাধ্যমে কোনো গাড়ি-ঘোড়া নয় বরং ছোট ছোট নৌকা ব্যবহৃত হয়। রঙ্গিন সেতু দিয়ে সজ্জিত এই শহরটি। তবে প্রায় সবার মাঝেই প্রশ্ন জাগে ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জলের উপর গড়ে ওঠা রহস্যটা কি? এক কথায় বলতে গেলে প্রয়োজনের তাগিদে এক অসাধারণ সৃষ্টি দৃষ্টান্ত এটি।


ভেনিস নির্মাণের ইতিহাস শুরু হয় পঞ্চম শতকের দিকে। সময়টা ছিল পশ্চিমা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের শুরুর দিক। উত্তরের দিক থেকে বর্বর ও অসভ্য জাতি রোমের প্রাক্তন অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য উঠে পড়ে লাগে। নিরীহ বাসিন্দাদের উপর বর্বর হামলা চালানো এবং লুটপাট খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এসব হামলা থেকে বাঁচার জন্য বাসিন্দারা অন্য কোথাও ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ভূমি ছেড়ে জলাভূমির উপরই বাসস্থান নির্মাণ করা তাদের কাছে উপযুক্ত বলে মনে হয়। বালুময় তিনটি দ্বীপ-টরসেলো, জে-সোলো এবং মালামোক্কোর কাছেই শুরু হয় ভেনিস শহরের নির্মাণ। শুরুতেই শুধু হামলার কবল থেকে বাঁচার জন্য এর নির্মাণ হয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে তা স্থায়ীভাবে রূপ নেয়।


নগরটি যে জলের উপর নির্মিত তা লবণাক্ত হওয়ায় অক্সিজেনের পরিমাণ নেই বললেই চলে। যার ফলে ওক এবং লার্চ গাছের কাঠ গুলো দ্বারা এর ভিত্তি নির্মাণ করা হয়েছিল তাতে পচল ধরেনি। ভেনিস নগরী টিকে থাকতে পারত না যদি তার ভিত্তিগুলো নড়বড়ে হতো কিংবা সরে যেত।সাগরের গভীর পলি মাটির নিচে একটি স্তর থাকে। যা শক্ত মাটি দিয়ে তৈরি। একে বলা হয় ক্যারান্টো। লবণাক্ত জলে থাকা খনিজ পদার্থ দিয়েই তৈরি স্তরটি। এ স্তরে খুঁটিগুলো স্থাপন করার ফলে ভিত্তিও বেশ মজবুত হয়। তাছাড়া জলাভূমির গভীরে থাকা খুঁটির নিচের অংশে প্রতিনিয়ত নুড়ি, পাথর, মাটি এসে জমা হয়, যা খুঁটিগুলোর সঙ্গে মাটির সংযোগ আরো মজবুত করে।


ফলে দিনের পর দিন খুঁটি সরে যাওয়ার বদলে তা আরো টেকসই হয়। কাঠ এসব পলিমাটি শোষণ করে শক্ত খুঁটিতে পরিণত হয়েছে। আর এক্ষেত্রে সমুদ্রের লবণাক্ত জল সহায়তা করেছে। জলে থাকা খনিজ পদার্থগুলো এই ভিত্তি শক্ত করতে ভূমিকা রেখেছে। দূষণ এবং কোলাহলমুক্ত এই শহর বিভিন্ন পর্যটকদের নিকট এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। যদিও বর্তমান সময় গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় শহরটি বেশ হুমকির মধ্যে রয়েছে। অনন্য সৌন্দর্যে ঘেরা শহরটির পরিস্থিতি এখন অবনতির পথে। কাঠের ভিত্তির উপর তৈরি ভাসমান নগরী ভেনিস ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে জলের নিচে।


 ২০০০ থেকে ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ০.০৪ থেকে ০.০৮ ইঞ্চি ভূমি চলে যাচ্ছে সাগরের নিচে। আর এর পেছনে দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা। তবে, এই একটি কারণেই ঐতিহ্যবাহী ভেনিস শহরকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না। আরো কারণ রয়েছে। যেমন- মাটির গভীর থেকে প্রতিনিয়ত জল উত্তোলন করা। এর ফলে সমুদ্রের তলদেশের খনিজ স্তর আরো নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। ফলে শহরটির ভিত্তি হয়ে যাচ্ছে দুর্বল। পরিশেষে বলা যায় ভেনিস নগরী গড়ে ওঠা ইতিহাসের এক অসাধারণ এবং বিরল ঘটনা। তাই শহরটিকে ইউনিভার্সিটি হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.