মুকেশ আম্বানি কি ভারতকে বিশ্বের হাইড্রোজেন জ্বালানির প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন?



 ODD বাংলা ডেস্ক: জীবাশ্ম জ্বালানি পরিশোধনের ব্যবসা থেকে বেড়িয়ে এসে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে পরিচ্ছন্ন হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদনমুখী করতে চান ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানি। তিনি সফল হলে ভারত বিশ্বের অন্যতম গ্রিন-হাইড্রোজেন জায়ান্ট হয়ে উঠবে। 


এশিয়ার সেরা ধনী আম্বানি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবসা করেই বিত্ত-বৈভবের শিখরে পৌঁছেছেন। চলতি মাসের শুরুতে তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানি অবকাঠামো গড়ে তুলতে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যার মধ্যে আছে- জেনারেশন প্ল্যান্ট, সোলার প্যানেল, ইলেক্ট্রোলাইজার ইত্যাদি। 


পর্যবেক্ষকদের ধারণা, পরিকল্পনাধীন স্থাপনায় উৎপাদিত দূষণমুক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হবে হাউড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদনে, যা হবে সম্পূর্ণ পরিবেশ-বান্ধব প্রক্রিয়া। এভাবে উৎপাদিত হাইড্রোজেনকেই বলা হয়- গ্রিন হাইড্রোজেন।


আগামী প্রজন্মের জ্বালানিটি প্রস্তুতে আম্বানির ঘোষণাটিই এপর্যন্ত ভারতের নবায়নযোগ্য উৎসে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ পরিকল্পনা। 


বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের পাইকারি বিদ্যুৎ বাজারে বড় সরবরাহক রিলায়েন্স। কিন্তু, এ বাজারে সরকারি-বেসরকারি খাতের সংস্থা থেকে বিল পেতে বেশ দেরী হয়। ইউটিলিটির এই বাজার আর্থিকভাবেও নানান সংকোচনের শিকার। হাইড্রোজেন উৎপাদনে ঝুঁকে এসব সমস্যাকেই এড়াতে চায় কোম্পানিটি। 


নয়াদিল্লিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সিইইডব্লিউ- এর সেন্টার ফর এনার্জি ফিন্যান্সের পরিচালক গগন সিধুর মতে,"গ্রিন হাইড্রোজেন অর্থনীতির সম্পূর্ণ ভ্যালু চেইন দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে রিলায়েন্স। এটাই যে ব্যবসার ভবিষ্যৎ তা তারা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে।" 


ইলেক্ট্রোলাইজার যন্ত্রে নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎ (সৌর, বায়ু বা জলবিদ্যুৎ) ব্যবহারের মাধ্যমে জল থেকে উৎপাদিত হয় গ্রিন হাইড্রোজেন। বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য অর্জনে এই প্রযুক্তিকে আবশ্যক হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে ইস্পাতের মতো বড় ও মৌলিক শিল্পগুলো দূষণহীন জ্বালানির নতুন যুগে পা রাখবে। দূষণের চিন্তা থেকে ভোক্তারাও হবেন নির্ভার।


আম্বানি পরিবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্য গুজরাট থেকে এসেছেন। গেল বছর নরেন্দ্র মোদি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ গ্রিনহাউজ নিঃসরণকারী দেশ ভারতকে হাউড্রোজেন জ্বালানি উৎপাদন ও রপ্তানির একটি বৈশ্বিক হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। 


রিলায়েন্স নিচ্ছে তারই প্রস্তুতি। কোম্পানিটি গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদনে বিনিয়োগের সঠিক পরিমাণ উল্লেখ না করলেও, পরিচ্ছন্ন জ্বালানিতে তাদের ৭৫ বিলিয়ন ডলার লগ্নীর পরিকল্পনা ভারতের ইতিহাসে এপর্যন্ত সর্বোচ্চ।   


মুকেশের প্রতিযোগী-আদানি এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি সংস্থা এনটিপিসি লিমিটেড এবং ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনেও সবুজ হাইড্রোজেন নিয়ে পরিকল্পনা করছে।


গেল বছর হাইড্রোজেন কৌশল প্রণয়ন করা দেশের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২৬টিতে পৌঁছে যায়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত ও চীনের মতো দেশের জাতীয় পরিকল্পনা বিশ্ববাজারকে নতুন ধাঁচে গড়বে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ এনইএফ। তবে এখাতে প্রযুক্তি ও উৎপাদন এখনও অনেকটাই পরীক্ষামূলক, বাণিজ্যিকভাবে কতখাতি লাভজনক হবে সেটাও দেখার বিষয়। 


সরকারি অর্থের অপচয় রোধে ভারত তাই ধনকুবের মুকেশ আম্বানি ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী গৌতম আদানির পথপ্রদর্শক হওয়ার ওপর নির্ভর করছে।  


তবে উৎপাদন ব্যয় সাধ্যের মধ্যে রাখা এক্ষেত্রে একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। তার প্রধান কারণ, নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে হয়। অথচ নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে উৎপাদনের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। আর কয়লাই হলো ভারতে বিদ্যুতের প্রধান উৎস।  


প্রতি কেজি গ্রিন হাইড্রোজেন মাত্র ১ ডলারে উৎপাদনের অঙ্গীকার করেছেন আম্বানি। বর্তমানে যে খরচ হয় এটি তার চেয়েও ৬০ শতাংশ কম। 


মুকেশ আম্বানি অবশ্য প্রত্যয়ী। গেল বছর তিনি বলেছেন, "রিলায়েন্স এই কম খরচে উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনে আগ্রাসীভাবে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে এবং চলতি দশক শেষ হওয়ার আগেই তাতে সফল হবে।"


এক ডলারের সেই কাঙ্খিত মূল্যসীমা ছুঁতে চাইলে নাটকীয় হারে কমাতে হবে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদনের মৌলিক যন্ত্র ইলেক্ট্রোলাইজারের দাম। এমনটাই জানান বহুজাতিক অডিট সংস্থা ডিলোয়েট টুশে তোহমাৎসুর মুম্বাই ভিত্তিক পার্টনার দেবাশীষ মিশ্র।


তিনি জানান, "এজন্য ৮০ শতাংশ সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, আর সেজন্য প্রয়োজন হবে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। সেই বিদ্যুতের দাম প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় হতে হবে তিন সেন্টেরও কম। ২৪ ঘণ্টার অবিরাম এ উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে জলবিদ্যুতের মতো ধারক উৎস থেকে বাড়তি সরবরাহ দরকার হবে। কেবলমাত্র তখনই খরচ কাঙ্ক্ষিত হারে নামিয়ে আনা সম্ভব।"  


মুকেশ আম্বানি হয়তো এ উদ্যোগ নিয়ে সরকারি সহায়তা পাওয়ার আশা করছেন। পেতে চাইছেন ভর্তুকি ও কর ছাড়ের মতো সুবিধা। 


দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল শোধনাগার ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পের সাবেক পরিচালক আর. রমাচন্দ্রন বলেন, "সন্দেহ নেই রিলায়েন্স সফল হলে তা হবে সুবর্ণ সুযোগ। আর নাহলে তখন সরকারকেই ভর্তুকি বা অন্য ধরনের আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিতে হবে।"  


আগামী ১০ দিনের মধ্যে প্রথম গ্রিন হাইড্রোজেন পরিকল্পনা প্রকাশের কথা জানিয়েছে ভারত। গেল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রী রাজকুমার সিং বলেছেন, এখাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পরিকল্পনায় ভর্তুকির ঘোষণা আসবে। 


দেশটি হাইড্রোজেন উৎপাদনে আন্তঃরাজ্য বিদ্যুৎ পরিবহন নিশ্চিত করতে চায়। দূষণমুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্রিন হাইড্রোজেন ও গ্রিন অ্যামোনিয়া ধারক অবকাঠামোর জন্য জমির প্রাপ্যতাও নিশ্চিত করা হবে বলে জানান রাজকুমার সিং।   


আর ২০৩৫ সাল নাগাদ শূন্য নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগ্রহী রিলায়েন্স নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ১০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। চলতি দশকের শেষ নাগাদ ভারত জাতীয়ভাবে যে পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের সক্ষমতা অর্জন করতে চায়, রিলায়েন্সের পরিকল্পনায় তার এক-পঞ্চমাংশ বাস্তবায়নের বিষয়টি রয়েছে। 


কোম্পানিটি জানিয়েছে, এজন্য তারা গুজরাটে উপযুক্ত স্থান খুঁজছে এবং ইতোমধ্যেই কচ্চ অঞ্চলে সাড়ে ৪ লাখ এক একর জমি বরাদ্দ দিতে রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। উল্লেখ্য,  ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সাদা বালির এ মরুভূমি দেশটির সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থাগুলোর পছন্দের শীর্ষে। 


অঞ্চলটির সম্ভাবনার ব্যাপারে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন গ্লোবাল এনার্জি পলিসির জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিও ফ্রিডম্যান বলেন, "রিলায়েন্স সঠিক জায়গাই নির্বাচন করেছে; এখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রতিযোগী মূল্যে উৎপাদন করা যাবে। তারা চূড়ান্ত লক্ষ্যস্থির করেছে এবং বাজার অংশীদারিত্ব ও প্রবৃদ্ধির বড় অংশ নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিতে বিনিয়োগ করছে।"

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.