ঘোড়াদৌড় কি ক্রমশ থেমে যাবে?
ODD বাংলা ডেস্ক: ‘ইচ্ছে যদি ঘোড়া হত
উঠে পিঠে তার
সাত-সমুদ্র তেরো নদী
হয়ে যেতাম পার।’
সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করার এ গল্প আজকের নয়, এ এক অন্য সময়ের কথা। যখন আকাশে উড়তে মানুষের কাছে উড়োজাহাজ ছিল না। কিন্তু মানুষের ইচ্ছে ছিল ষোলআনা। তাই ইচ্ছেপূরণের সেই ভার ছিল যার কাঁধে, সে হল আমাদের পরিচিত বন্ধু, ঘোড়া। পক্ষীরাজ ঘোড়া যেন ছিল আমাদের সাক্ষাৎ আলাদিন। আমাদের স্বপ্নের ভেলা। আর তাই একথা বলতেই হয়, রূপকথার গল্প থেকে বাস্তবের যাত্রাপথে চিরকালীন ভ্রমণসঙ্গী হয়ে থেকেছে ঘোড়ারাই। পৌরাণিক কাহিনি কিংবা গল্পের পাতা, ঘোড়ারা কখনও হয়েছে রাজপুত্রের সখা, কখনও বা যুদ্ধের সওয়ারি।
পুরাণ মতে সূর্যদেব নাকি সপ্তাশ্ববাহিত রথে আকাশপথে পরিভ্রমণ করেন। শোনা যায়, তার রথের ঘোড়াগুলো সাতটি পৃথক পৃথক রঙের, যা রামধনুর সাত রঙের প্রতীক। আবার, পৌরাণিক সাহিত্যে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা প্রদর্শন করার রেওয়াজের কথাও আমরা শুনে থাকি। অর্থাৎ, ঘোড়া মানেই যেন অকৃত্রিম এক শক্তি। তাই দাবা খেলার ছকেও ঘোড়ার দৌড় আড়াই পা, সেখানেও সে বেপরোয়া, সামনের বাধা সহজেই টপকে দান দিতে সক্ষম সে।
শহরবাসীর এহেন ঘোড়ার পিঠে চড়ার শুরু ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। শোনা যায়, ১৭৭৫ সালে উইলিয়াম জনসন নামের এক ইংরেজ ব্যক্তি কলকাতার পণ্ডিতিয়া অঞ্চলে প্রথম ঘোড়ার গাড়ির কারখানা তৈরি করেন। এর আগে কলকাতার রাস্তায় সাহেবদের নিজস্ব কিছু ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া সেভাবে আর শব্দ শোনা যেত না।
এককালে যে ঘোড়া একার কাঁধে চলাচলের দায়িত্ব সামলেছে অনেকাংশে, আজ আধুনিক যন্ত্রচালিত যানবাহনের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘোড়ার অবসরের সময় এসেছে। এক্কা গাড়ি ছোটার শব্দ হারিয়ে গেছে পরিচিত অভ্যেস থেকে। কবি মৃদুল দাশগুপ্তের ‘রাজার ঘোড়া’-রা আজ আর অনায়াসে ধান ক্ষেতে ছুটে বেড়ায় না। বাঙালি আজকাল শখে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে, কখনও শীতের আমেজে ময়দান চত্বরে বেড়াতে গেলে ঘোড়ায় চড়ে পুরোনো স্মৃতি খানিক ঘেঁটে নেয়। ঘোড়ার গাড়ি আজ যেন দুর্লভ কিছু।
অথচ আমাদের ঘরের খোকারা একদিন এই ঘোড়ার খুরে খুরে রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আনত। মাকে নিয়ে দূর দেশে পাড়ি দিয়ে ‘বীরপুরুষ’ হয়ে উঠত। কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত তার ‘শেষ ঘোড়া’ কবিতায় যে ঘোড়ার ওপর জীবনের সর্বস্ব বাজি রাখার কথা বলেছেন, রেসের মাঠে যেন তারই বাস্তব ছবি পাওয়া যেত।
কথিত আছে, ঘোড়ার রেসের মাঠ যতটা দেয় তার থেকে অনেক বেশি উসুল করে নেয়। তবুও যেন এ এক আদিম নেশা, জীবনের বাজি রাখার এই খেলায় হার জিতের হিসেব কষে একটা অন্য জগতের খোঁজ পায় ঘোড়াদৌড়। রেসের ময়দানে রোজ নায়ক হয়ে ওঠত কোনো না কোনো ঘোড়ারাই। আজও সেসব স্মৃতি স্বপ্ন হয়ে বাঙালিকে যখন-তখন আঁকড়ে ধরে।
আর্থিক সংকটে ঘোড়াপালন জৌলুস হারিয়েছে। খাদ্য আর পরিচর্যার অভাবে ঘোড়াদের চেহারায় ছাপ ফেলেছে বিষণ্ণতার। তবুও সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে পায়ে পা ফেলে খানিকটা পথ ছুটে নিচ্ছে তারা।
আজও কিছুটা টিকে আছে ঘোড়াদৌড়, তাই আজও ছুটির দিনে চোখে পড়ে পরিস্থিতির সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে টিকে যাওয়া কিছু ঘোড়সওয়ার। যারা সদর্পে বলতে পারে, ‘আমরা আজও মরে যাইনি’। চেনা সেই ঘোড়ার গাড়ির পুরোনো স্মৃতি আজও উস্কে দেয় স্মৃতি। আর বাঙালিও চায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে নস্টালজিয়ায় ফিরে যেতে।
Post a Comment