সামনের দিনগুলোয় ভিনগ্রহে যেসব এয়ারক্রাফট উড়বে

 


ODD বাংলা ডেস্ক: গতবছরই প্রথমবারের মতো ভিনগ্রহে হেলিকপ্টার উড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হয় নাসার। মঙ্গল গ্রহে বেশ কিছুক্ষণ উড়ে বেড়ানোর পর সফলভাবে অবতরণ করে মার্কিন মহাকাশ সংস্থার ক্ষুদ্রাকৃতির হেলিকপ্টার রোবট, ইনজেন্যুইটি। প্রবল ঘূর্ণন সৃষ্টি করেও ইনজেন্যুইটি ভূমি থেকে মাত্র একতলা ভবনের সমান উচ্চতায় উঠতে পেরেছিল।


২০৩০ সালের মাঝামাঝি আরেকটি উড়ন্তযান ভিনগ্রহে উড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ড্রাগনফ্লাই নামের ছোট গাড়ির সমান হেলিকপ্টারটি শনির সবচেয়ে বড় উপগ্রহ টাইটানের বুকে নামবে। এটাই হবে টাইটানে মানুষের প্রথম অভিযান। ভিনগ্রহে অন্যান্য আকাশযানের উড়ে বেড়ানোর রেকর্ড ভাঙবে ড্রাগনফ্লাই। এক ঘণ্টায় বিশাল অঞ্চলে অন্য কোনো যানের এত দ্রুত বিচরণ করার ইতিহাস নেই।


তবে ভিনগ্রহের মধ্যে পৃথিবীর পার্শ্ববর্তী শুক্রে চালানো অভিযানগুলো ছিল সবচেয়ে কঠিন। প্রচণ্ড তাপ, চাপ ও অম্লীয় আবহাওয়ার কারণে কোনো মহাকাশযানই ১২৭ মিনিটের বেশি সময় গ্রহটির বুকে অবস্থান করতে পারেনি।


পৃথিবীর বুকে মেরু অঞ্চলে উড়ন্ত অভিযানের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন জগৎ সম্পর্কে জানতে পেরেছিল মানুষ। নাসাও ভিনগ্রহে একই রকম অভিযান পরিচালনার কথা ভাবছে। মঙ্গলে অবতরণকারী ভাইকিং এবং কিউরিওসিটির মতো আইকনিক সব মহাকাশযান অনুকূল আবহাওয়ায় তথ্য সংগ্রহে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।


তবে বিকল্প মহাকাশযান নিয়েও ভাবছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। নিয়ন্ত্রিত রোবটিক হেলিকপ্টার, ড্রোন এমনকি প্রপেলার প্লেনের মতো উড়ন্তযান নির্মাণের প্রস্তাব রেখেছেন তারা। এর মাধ্যমে আরও কম সময়ে বড় অঞ্চল থেকে গ্রহের ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে উচ্চমানের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।


সাধারণত তিন ধরনের মহাকাশযানই বেশি দেখা যায়—রোভার, ল্যান্ডার এবং অরবিটার। রোভার গ্রহের বুকে বিচরণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। ল্যান্ডার একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবতরণের পর নির্ধারিত কাজগুলো সম্পাদন করে। অন্যদিকে, অরবিটার নির্দিস্ট কক্ষপথে অবস্থানের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে। এর বাইরে বিজ্ঞানীরা এখন এয়ারক্রাফটের মতো উড়ন্ত মহাকাশযানের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।


রোভারের মাধ্যমে খুব কাছে থেকে ভূমির ছবি তোলা সম্ভব হলেও অমসৃণ পাথুরে সমতল, পাহাড়ি অঞ্চল, পর্বত চূড়া কিংবা শনির মতো প্রতিকূল ভূমিতে উড়ন্ত মহাকাশযানই সর্বাধিক কার্যকর হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।


কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিটি গ্রহের বৈশিষ্ট্যই ভিন্ন। আর তাই নাসার প্রকৌশলীদের ভিন্নধারার ভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন মহাকাশযান নির্মাণে মনোযোগ দিতে হচ্ছে। নাসার বর্তমান প্রযুক্তিগুলোও সবক্ষেত্রে কার্যকর নয়।


মঙ্গলের ইনজেন্যুইটি হেলিকপ্টার নির্মাণ দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রোবোটিক্স টেকনোলজিস্ট টেডি জ্যানটোস। মঙ্গলের উপযোগী পরবর্তী প্রজন্মের হেলিকপ্টার নিয়ে বর্তমানে তিনি কাজ করছেন।


তার মতে, মঙ্গলে মহাকাশযান উড্ডয়নের কাজটি বেশ কঠিন। এখানকার উপযোগী হেলিকপ্টার ১.৮ কেজির চেয়েও হালকা হতে হবে। এর মধ্যেই লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি, সেন্সর ক্যামেরার মতো যন্ত্রপাতিসহ মঙ্গলের শীতল রাতগুলোয় তাপ নিরোধক অবস্থায় রাখার বিষয়টিও দেখতে হবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ইনজেন্যুইটির মতো যান তৈরি করতে হবে। 


জ্যানটোস বলেন, "আমাদের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার এবং তার দলের সদস্যরা ১৯৯০ সালের দিকে প্রথম মঙ্গলগ্রহের উপযোগী হেলিকপ্টার নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তখন এতো উন্নত প্রযুক্তি ছিল না। শূন্য দশকে খুব দ্রুত উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়।"


আকাশযান সাধারণত দু'ধরনের। এক, বিমানের মতো ফিক্সড পাখাযুক্ত এয়ারক্রাফট। আর দ্বিতীয়ত, হেলিকপ্টারের মতো ব্লেডযুক্ত ঘূর্ণায়মান রোটরক্রাফট। তবে মঙ্গলে রোটরক্রাফটই ছিল বেশি উপযুক্ত। 


৯০ এর দশকে ইনজেন্যুইটির উপযোগী কার্বন ফাইবারের মতো বিষয়গুলোও এত উন্নত ছিল না। হালকা সেন্সর কিংবা উড্ডয়ন যন্ত্রের অ্যালগরিদমও ছিল অপ্রতুল। অথচ ২০ বছর পর এখন ড্রোনের সাহায্যে পার্সেল এবং ভ্যাকসিন ডেলিভারি দেওয়া হয়। ইনজেন্যুইটি উড়ার সঠিক সময়ের অপেক্ষাতেই যেন ছিল। 


ইতোমধ্যে মঙ্গলে পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সম্পন্ন করেছে ইনজেন্যুইটি। মহাকাশযানটি এখনো উড়ছে। জ্যানটোস বলেন, "আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল মঙ্গলে উড়া এবং আমরা সফলভাবে ৩০টির বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করেছি। প্রতিটি ফ্লাইটের পর আমরা অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ারিং ডেটা পাচ্ছি যা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাজে আসবে।"


টাইটানের অবস্থা মঙ্গলের সম্পূর্ণ উলটো। শনির এই বিশাল উপগ্রহের ভূপৃষ্ঠ বরফে ঢাকা। এর নিচে পুরো গ্রহজুড়ে রয়েছে এক সমুদ্র। অসহনীয় ঠাণ্ডার সঙ্গে এখানে মিথেনের বৃষ্টি পড়ে। আকাশযানের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল, নৌকায় এর সমতল পৃষ্ঠ এবং সাবমেরিনের সাহায্যে সমুদ্রের গভীরে অনুসন্ধান করা যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।


মঙ্গলে যেমন হালকা যান প্রয়োজন টাইটানে এর উলটো একদম ভারী আকাশযানের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ড্রাগনফ্লাই মিশনের ডেপুটি প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর মেলিসা জি ট্রেইনার। এখানে বিশালাকার এয়ারপ্লেন বা হেলিকপ্টার নামানো যেতে পারে। 


তবে ড্রাগনফ্লাইয়ের অবতরণে শক্ত ভূতলের প্রয়োজন হবে। অবতরণ নিরাপদ মনে না হলে তা উড়ে উড়ে নিজের মতো টাইটানের একটি ম্যাপ তৈরি করবে। লিপফ্রগের মতো সাময়িক বিরতি নিয়ে উড়ে চলাটাই এক্ষেত্রে বেশি নিরাপদ বলে মনে করেন মেলিসা।


ক্যালিফোর্নিয়ার প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইন্সটিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. এলডার নো ডোব্রিয়া শুক্র অভিযানের পরিকল্পনা করছেন।


শুক্রের ভূমিতে বিচরণ করা কঠিন বলেই সেখানে দুটি আকাশযান পাঠানোর কথা ভাবছে বিজ্ঞানীরা। এরমধ্যে সৌরশক্তি চালিত আকাশযানটি ভূমি থেকে নিরাপদ উচ্চতায় উড়ে তথ্য সংগ্রহ করবে। অপর যানটি ভূমির খুব কাছে থেকে প্রতিকূল পরিবেশে তথ্য নিবে।


শুক্রের আবহাওয়া বেশ খারাপ হলেও ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী বলে মনে করেন ড. ডোব্রিয়া। পৃথিবীর চেয়ে শুক্রের আবহাওয়ার ঘনত্ব বেশি বলে উড়াও সহজ। পাশাপাশি এখানে বর্তমান প্রযুক্তির সাহায্যেই সৌরশক্তি ব্যবহার করে এরোপ্লেন উড়ানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।


ডোব্রিয়ার আরেকটি পরিকল্পনা হলো শুক্রের ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি এয়ারক্রাফট উড়ানো। প্রচণ্ড তাপ ও চাপে বিষয়টি কঠিন হলেও ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি প্রচণ্ড তাপ থেকে শক্তি নিয়ে এয়ারক্রাফটটি উঁচু অপেক্ষাকৃত শীতল জায়গায় উড়তে পারবে বলে তিনি মনে করেন। এরজন্য স্টারলিং ইঞ্জিনের মতো ইঞ্জিনের প্রয়োজন পড়বে।


তবে এর বাইরেও আরেকটি বিকল্প আছে। আর তা হলো বেলুন!


ইনজেন্যুইটি ভিনগ্রহে প্রথম হেলিকপ্টার হতে পারে, তবে ভিনগ্রহের আকাশে উড়ানো মানুষের প্রথম যানটি আসলে বেলুন। ১৯৮৫ সালের জুনে সোভিয়েত-ইউরোপীয় ভেগা অভিযানে শুক্রে দুটি বিশালাকৃতির গোলাকার বেলুন ছাড়া হয়। বেলুনের নিচে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 


যুক্তরাষ্ট্রের বেলুন ট্র্যাকিং প্রজেক্টের প্রধান রবার্ট প্রিস্টন বলেন, "দুটি বেলুনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল বটে, তবে সেগুলো টিকতে পেরেছিল কি না, আমাদের জানা নেই। অসিলোস্কোপ স্ক্রিনের শুধু কিছু শব্দ পাওয়া গেছে। এছাড়া, অস্পষ্ট একটি সিগন্যালও মিলেছিল।"


তবে ভেগার বেলুন অভিযান নিশ্চিতভাবেই সফল হয়েছিল বলে মনে করেন স্পেস বিষয়ক ইতিহাসবিদ জে গ্যালেনটাইন। 


তবে শুধু সৌরজগতই নয়, সৌরজগতের বাইরেও অভিযানের কথা ভেবেছে নাসা। নাসার বিজ্ঞানী জোনাথন সোডার বলেন, "আমাদের সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলোর দিকে তাকালে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। বরফে তৈরি গ্রহ আছে যার বায়ুমণ্ডলে মিলবে ধাতব পদার্থ। আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি সেখানে পাঠালে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে পৃথিবীর মতো কিছু গ্রহও আছে।"


তবে পরিবেশ যত ভিন্নই হোক না কেন সৌরজগতের মতোই সেখানেও একইধরনের পদার্থবিদ্যা খাটবে বলে মনে করেন জ্যানটোস। তিনি বলেন, "আমরা এখন অন্যান্য গ্রহে স্বনিয়ন্ত্রিত যেসব এয়ারক্রাফট পরিচালনা করছি এগুলোই ভবিষ্যতের মানুষের উড্ডয়নের ভিত্তি রচনা করবে।"


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.