হোগলাবনের প্রকৃতি

 


ODD বাংলা ডেস্ক: নদীর প্রান্ত ঘেঁষে লম্বা সবুজ পাতার ঘন বন। নদীতে জোয়ার এলে সবুজ পাতাগুলো প্রায় ডুবে যেত। আবার ভাটা শুরু হলে জেগে উঠত পাতাগুলো। গ্রামের কিছু জেলে ভরা জোয়ারের সময় হোগলাবনের দুই প্রান্তে গড়া (মাছ ধরার উপকরণ) লাগাতেন। ভাটার সময় তারা নানা ধরনের মাছ ধরতেন। চিতল, বোয়াল, দরগি, কালডই, বেলে, চেউয়া, শিলংসহ নানা ধরনের নদীর মাছ। গ্রামের মানুষ হোগলাবনের এমন দৃশ্য অনেকেই দেখেছেন। কৈশোরে হোগলাবনে গিয়ে বক, কোড়া, বালিহাঁসের বাসা খুঁজেছেন অনেকেই। তবে এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না তেমন হোগলাবন। এই বন যেন প্রতিনিয়তই কমে যাচ্ছে।  

শীতের সময় গরু-মহিষ ঢুকত হোগলার বনে ঘাস খেতে। কারণ, শীতে জোয়ারের জল হোগলার বন অবধি আসত না। কয়েক প্রজাতির ঘাস যে কারণে দ্রুতই বেড়ে উঠত। নদীর চরে জন্মানো চামডি ঘাস গবাদিপশুর পছন্দের তালিকায় থাকত। নদীর তীরে বসে হোগলাবন দেখার আনন্দটাই ছিল রোমাঞ্চকর। বিশেষ করে যখন বাতাসে হোগলাপাতাগুলো দুলত এবং একধরনের ধ্বনি হতো। সেই সুরেলা শব্দটা আজও মনে গেঁথে আছে অনেকের। বনে যখন মানুষ ঢুকত, কখনো পাতার প্রান্তে ধারালো অংশে হাত-পা কেটে যেত। ঘন কাণ্ড ও নরম কাদার ভেতর হাঁটতে কষ্ট হলেও অভিযান বন্ধ হতো না।


বছরের একসময় হোগলাবনে ফুল আসত। লম্বা ডাঁটার ওপরের দিকে বাদামি রঙের একটি নরম প্রলেপ। প্রাথমিক অবস্থায় ফুলের আবরণটা একটু শক্ত থাকত। কিছুদিন পর পরিপক্ব হলে আমরা ডাঁটা কেটে নিয়ে এসে মঞ্জরিদণ্ড থেকে ফুলগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়েছেন অনেকেই।


হোগলা (Typha elephantina) ছোট থেকে মাঝারি আকারের গুল্ম। উচ্চতা দুই থেকে পাঁচ মিটার। পত্রফলক চ্যাপ্টা। বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনার নদী অববাহিকায়, চরে, জলাশয়ে হোগলার বন দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। ফরিদপুর, গোয়ালন্দসহ পদ্মার চরেও হোগলার ছড়ানো-ছিটানো ঝোপ দেখা যায়। হোগলা স্বাদু ও লোনাজলের মিশ্রণেও জন্মে। সুন্দরবনের নদী ও খালের অগভীর তীর অংশেও দেখা যায়। সম্ভবত দুটি প্রজাতি বাংলাদেশে জন্মে।


হোগলাপাতা দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখে। হোগলাশিল্প দক্ষিণ বাংলার মানবসভ্যতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হোগলাপাতার তৈরি চাটাই ও মাদুর গ্রামের মানুষ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকে। তা ছাড়া ঝুড়ি ও দড়ি তৈরিতে শুকনা হোগলার ব্যবহার রয়েছে।


হোগলাবন মাছ, শামুক ও পাখির জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। অনেক প্রজাতির মাছ হোগলাবনে ডিম পাড়ে। নানা প্রজাতির জলজ ও ঘাসবনের পাখি (বালিহাঁস, বাবুই, কোড়া, গুরগুরি, চ্যাগা) হোগলাবনে খাবার খায়, বাসা বাঁধে এবং নিরাপদে সময় কাটায়। তা ছাড়া হোগলাবন ভোঁদড়ের জন্য একটি নিরাপদ আবাস।


দেশে হোগলাবনের পরিমাণ কতটুকু, তা নিয়ে কোনো গবেষণা জানামতে হয়নি। আমাদের ছেলেবেলায় যত বড় আয়তনের হোগলার বন দেখেছি, সে রকম বন এখন চোখে পড়ে না। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হোগলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ এখনই দরকার। এর নতুন কোনো ব্যবহার নিয়ে গবেষণা দরকার।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.