ফ্রিজ করোনাভাইরাসের নিরাপদ আশ্রয়স্থল



 ODD বাংলা ডেস্ক: গত বছরের শেষভাগে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে চার লাখের বেশি মানুষ মারা গেলেও এই ভাইরাসের উৎস, চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, গতিপ্রকৃতি বা বিবর্তনের ধরণ সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি বিজ্ঞানীরা।


এই ভাইরাস কোন ধরণের সমতলে কতক্ষণ বেঁচে থাকে, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে কত দ্রুত ছড়ায়, কোন ধরণের আবহাওয়া বা তাপমাত্রায় এর প্রকোপের কতটা তারতম্য হয়, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা একেকবার একেক মত দিয়েছেন, আবার নতুন গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে দফায় দফায় বিশেষজ্ঞদের মত পরিবর্তন করার ঘটনাও ঘটেছে।


শুরুতে একসময় মানুষের ধারণা ছিল যে উচ্চ তাপমাত্রায় এই ভাইরাস বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না, তবে এই দাবির কোনো প্রমাণ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায়নি শেষ পর্যন্ত। সেরকম আরেকটি ধারণা হলো, ফ্রিজের ভেতরে অন্যান্য স্থানের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে পারে। তবে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত অন্যান্য মতবাদের মত এই বিষয়টি নিয়েও শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেনি বিজ্ঞানীরা।


ফ্রিজে কি করোনাভাইরাস বেশি সময় ধরে টিকে থাকে?


এর আগে যেসব করোনাভাইরাস পরিবেশে ছিল, সেগুলোর কয়েকটি প্রজাতি হিমাঙ্কের নীচে তাপমাত্রায় পুরোপুরি কার্যকরভাবে বেঁচে না থাকলেও স্থিতিশীল অবস্থায় টিকে থাকে বলে প্রমাণ পেয়েছিল বিজ্ঞানীরা।


২০১০ সালে আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলোজি’র এক গবেষণায় উঠে আসে যে সার্স করোনাভাইরাস (যেটি অনেকটা কোভিড-১৯ ভাইরাসের মত) ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় (প্রায় ৪.৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) যেরকম আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা থাকে, ওই পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।


সাধারণত গৃহস্থালিতে যেসব রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতে এই তাপমাত্রা থাকে।


গবেষণায় উঠে আসে, তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা ২০ শতাংশের নীচে হলে সার্স করোনাভাইরাস প্রায় ২৮ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে, যেখানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর আর্দ্রতা ৮০ শতাংশ হলে ভাইরাসটির স্থায়িত্বকাল থাকে ৬ ঘণ্টার মত।


অনেক বিশেষজ্ঞ এই প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে আর পরবর্তী গবেষষণার জন্য অপেক্ষা না করে ফ্রিজ ব্যবহারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।


তারা বলছেন, কাছাকাছি প্রজাতির একটি করোনাভাইরাস যেহেতু ফ্রিজে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে, কাজেই নভেল করোনাভাইরাসেরও একই বৈশিষ্ট্য থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।


স্যান ফ্র্যান্সিসকোর গ্ল্যাডস্টোন ইনস্টিটিউটের রিসার্চ সাইন্টিস্ট ও ভাইরোলজিস্ট ড. ওয়ার্নার গ্রিন গত এপ্রিলে মার্কিন সংবাদ সংস্থা এনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন করোনাভাইরাস চরিত্রগতভাবে একটি ‘আঠালো’ ভাইরাস।


ওই সাক্ষাৎকারে ড. গ্রিন বলেছিলেন, ‘এই ভাইরাস (সার্স) বিভিন্ন সমতলে আশ্চর্জজনকভাবে লম্বা সময় টিকে থাকে।’


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, নভেল করোনাভাইরাস ফ্রিজে কতদিন বেঁচে থাকতে পারে সেসম্পর্ক না জানা গেলেও ফ্রিজের আবহাওয়ায় অন্য জায়গার তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি সময় বাঁচতে পারে বলে ধারণা করা যায়।


তিনি বলেন, ‘এটি যেই ধরণের ভাইরাস, তা সাধারণত ফ্রিজের পরিবেশে বেশি সময় বাঁচতে পারার কথা। কিন্তু সেখানে ঠিক কতদিন বাঁচতে পারবে, এ ধরণের কোনো গবেষণা এখনো নেই।’


তবে সার্স করোনাভাইরাস নিয়ে করা গবেষণার ভিত্তিতে নভেল করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে চান না বিশেষজ্ঞদের অনেকেই।


এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার এবিসি রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি চিফ মেডিক্যাল অফিসার মাইকেল কিড বলেন নভেল করোনাভাইরাস ফ্রিজে টিকে থাকতে পারে কিনা আর থাকলেও কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে, তা গবেষণার আগে বলা সম্ভব না।


তিনি বলেন, ‘সার্স করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা হলেও নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। কাজেই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না যে এই ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য সার্স করোনাভাইরাসের মত কি না।’ তাই তিনি ফ্রিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেন।


ফ্রিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী ধরণের সতর্কতা নেবেন?


এবিসি রেডিওকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মাইকেল কিড মন্তব্য করেছিলেন যে ফ্রিজে রাখার পরে তো বটেই, ফ্রিজে রাখার আগেও সব খাদ্যপণ্য অথবা পণ্যের প্যাকেট অন্তত একবার জীবাণুমুক্ত করে নেয়া জরুরি।


‘বাইরে থেকে বাজার ঘরে এনে ফ্রিজে রাখার আগে জীবাণুমুক্ত করার পাশাপাশি বারবার হাত ধোয়ার বিষয়টিও মনে রাখতে হবে সবাইকে,’ বলেন মাইকেল কিড।


সার্স করোনাভাইরাসের মত, ফ্রিজে রাখা খাদ্যপণ্যের গায়ে বা প্যাকেটে নভেল করোনাভাইরাস লেগে থাকলে তা সপ্তাহ চারেক বেঁচে থাকতে পারে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাই বাজার করার পর পণ্য ফ্রিজে রাখার আগে ও ফ্রিজ থেকে বের করার পর তা জীবাণমুক্ত করার ব্যাপারে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।


ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ফ্রিজে রাখা খাবারের প্যাকেট বের করার পর প্যাকেটটি জীবাণুনাশক মেশানো কাপড় দিয়ে ভালো করে মুছে নেয়া প্রয়োজন।’


ফ্রিজে রাখা শাকসবজি রান্না করার আগে কিছুক্ষণ সাবান মিশ্রিত জলে রেখে ধুয়ে নেয়ার উপদেশ দেন তিনি। তবে মাছ বা মাংসের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয় বলে মাছ-মাংস যেই প্যাকেটে বা পাত্রে রাখা হবে, সেটিকে জীবাণুমুক্ত করে নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।


‘এছাড়া যারা ফ্রিজ থেকে বের করা মাছ-মাংস কাটাকাটির দায়িত্বে থাকবেন, তাদের আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’


নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করা এবং রান্নার কাজ করার সময় বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরি করার উপদেশ দেন তিনি।


‘ফ্রিজ থেকে বের করা মাছ-মাংস নিয়ে কাজ করবেন যারা, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং নিয়মিত ভিত্তিতে হাত ধোয়ার মত বিষয়গুলো মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। যেই কাজে ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে, সেরকম প্রত্যেকটি ছোট ছোট কাজ শেষে মনে করে হাত ধোয়া জরুরি।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.