ডাউন সিনড্রোম ও করণীয়



 ODD বাংলা ডেস্ক: ডাউন সিনড্রোম কী?


ডাউন সিনড্রোম একটি জিনগত বা জেনেটিক রোগ, যা মানবকোষের ক্রমোজোমের অসামঞ্জস্যতার কারণে হয়ে থাকে। ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাংডন ডাউন প্রথমবার এ রোগের বিস্তারিত বিবরণ দেন। তাই তাঁর নামানুসারে এই রোগের নামকরণ হয় ডাউন সিনড্রোম। পরে ১৯৫৯ সালে ফ্রান্সের শিশু ও জেনেটিক রোগ বিশেষজ্ঞ জেরোম লুঁজা এ রোগের কারণ হিসেবে আবিষ্কার করেন যে মানবকোষের ২৩ জোড়া ক্রমোজোমের ২১ নম্বর ক্রমোজোম জোড়ায় দুটির স্থলে তিনটি ক্রমোজোম থাকে।


এ জন্য ডাউন সিনড্রোম রোগটি ‘ট্রাইসোমি ২১’ নামেও পরিচিত। আর ২১ নম্বর ক্রমোজোম সংখ্যায় তিনটি ক্রমোজোম থাকে বলে ২১/৩ অর্থাৎ ২১ মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস হিসেবে পালিত হয়।


বিশ্বে এখন ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৭০ লাখ। প্রতিবছর জন্মগ্রহণকারী এক হাজার শিশুর মধ্যে একজন ডাউন সিনড্রোম রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রতিবছর পাঁচ হাজার জন বা প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়। মায়ের বয়স যত বেশি থাকে শিশুর ডাউন সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা তত বাড়ে, যা ৪৫ বছর বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে কোনো মায়ের আগে একজন ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশু থাকলে পরে এ রকম আরেকজন শিশুর জন্ম হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। আক্রান্ত শিশুর মা-বাবা জেনেটিকভাবে স্বাভাবিক থাকতে পারে আবার ত্রুটিযুক্ত ক্রমোজোমের বাহকও হতে পারে। পরিবেশদূষণ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণেও ডাউন শিশুর জন্ম হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।


লক্ষণ


মানুষের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, যেমন—আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং ইত্যাদি ক্রমোজোমের ভেতরে ডিএনএ নামক এক ধরনের প্রোটিনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। তাই ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের ক্রমোজোমের অসামঞ্জস্যতার কারণে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায়। যেসব শিশু ডাউন সিনড্রোম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার মাইলফলকগুলো, যেমন—বসতে শেখা, দাঁড়াতে শেখা, হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা—এসব দেরিতে হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে মাংসপেশির শিথিলথতা, দুই চোখের বাইরের কোনা বাঁকাভাবে ওপরের দিকে উঠে থাকা, চ্যাপ্টা নাক, ছোট মুখমণ্ডল ও গলা, ছোট ও নিচু কান, জিহ্বা বের হয়ে থাকা, হাতের তালুতে একটিমাত্র রেখা, জন্মগত হৃদরোগ, অন্ত্রের অস্বাভাবিকতা, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যা, অধিক সংক্রমণের আশঙ্কা, ঘাড়ের হাড়ের সমস্যা, রক্তের রোগ, দাঁতে সংক্রমণ বা দাঁত পড়ে যাওয়া ইত্যাদি শারীরিক লক্ষণ দেখা যায়। মানসিক সমস্যার মধ্যে বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি, মনোযোগের ঘাটতি, অতি চঞ্চলতা, দ্রুত নতুন কিছু শিখতে না পারা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক একজন তরুণের বুদ্ধিমত্তা প্রায় ৮-৯ বছরের একজন সুস্থ শিশুর সমান হয়ে থাকে। অন্যদিকে যেখানে সাধারণ মানুষের ৬৫ বছর বয়সের পর স্মৃতিভ্রম রোগ (আলঝেইমার) হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের এই আশঙ্কা তৈরি হয় ৪০ বছর বয়সের পরই।


করণীয়


অনেক শিশুই জন্মগতভাবে নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে আসে, যার কিছু পরবর্তী সময়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সমাধান হয়, কিছু হয় না। তবে জেনেটিক ত্রুটিগুলোর বেশির ভাগেরই কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। তাই ডাউন সিনড্রোমেরও নেই কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে একটি শিশু জন্মালে পরিবারের জন্য যেমন ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কঠিন, তেমনি সেই পরিবারকেও সহ্য করতে হয় নানা রকম সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। এ ক্ষেত্রে তাই পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। যেহেতু মায়ের বেশি বয়সের সঙ্গে ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি বাড়ে, তাই অধিক বয়সে, বিশেষ করে পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে মা হওয়াকে নিরুৎসাহ করা দরকার। মায়ের আগের বাচ্চাটি যদি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত থাকে, তবে পরে বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মায়ের গর্ভকালীন ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে স্ক্রিনিং পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশু ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত কি না, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তবে গর্ভকালীন ১৫ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের শিশুর চারপাশের তরল পদার্থের ডিএনএ পরীক্ষা করে গর্ভের শিশুটি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত কি না, তা শনাক্ত করা যায় এবং পরবর্তী সময়ে জন্মের পর শিশুর শারীরিক ও জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমেই এ রোগ নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা যায়। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণটি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হলে গর্ভপাতের পরামর্শ দেওয়া হয়। আর জন্মের পর কোনো জটিলতা দেখা দিলে সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা করতে হয়। তবে আগে থেকেই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হলে জটিলতা কম হয়। ডাউন সিনড্রোমের রোগীকে সারা জীবন কিছু রোগের স্ক্রিনিং পরীক্ষা করাতে হয়। প্রয়োজনীয় পরিচর্যায় শারীরিক সমস্যাগুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। সঠিক যত্ন ও ভালোবাসা, পুষ্টিকর খাবার, স্পিচথেরাপি, ফিজিক্যালথেরাপি, যথাযথ শিক্ষা রোগীর জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করে। কিছু ডাউন সিনড্রোমের শিশুকে স্বাভাবিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা দেওয়া গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কেউ কেউ মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করতে পারে এবং খুব অল্পসংখ্যক উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে এসব রোগী ৫০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।


ভারতে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এখনো আলাদা কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। তাই তাদের মূলত শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালে ভারত ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি গঠিত হয়, যার শুরু হয় ২০১০ সালে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকদের নিয়ে তৈরি করা একটি সংগঠনের (প্যারেন্টস সাপোর্ট গ্রুপ) মাধ্যমে। তবে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রকৃত সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও সরকারি পর্যায় থেকে সচেতনতা সৃষ্টি করা তথা এসব রোগীর জন্য আলাদা চিকিৎসাকাঠামো তৈরি করা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলেই তাদের জীবন পাবে উষার আলোর সন্ধান।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.