মানুষকে মাছের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে শেখালেন যিনি



 ODD বাংলা ডেস্ক: মাছ ধরার জন্য বা সাঁতার কাটার জন্য সাগরের বুকে বহুকাল আগে থেকেই মানুষের বিচরণ থাকলেও একসময় জলের নিচের জগৎ ও সেখানকার প্রাণীদের জীবনচক্র নিয়ে মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। কিন্তু বর্তমান সময়ে সাগরে কখনো নামেননি এমন ব্যক্তিকেও জলের নিচের জগৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে সহজেই তার চোখে ভেসে উঠবে সেসব দৃশ্য। ডিজকাভারি চ্যানেল খুললেই প্রায় সময় আমরা এই দৃশ্যগুলো দেখতে পাই।


মানুষ জলের নিচে গিয়ে মাছের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে পারবে এমনটা চিন্তা করাই ছিল অসম্ভাবনীয়। তবে এই বিষয়টিই সত্যি করে দেখিয়েছেন ফরাসী নাবিক জাক কুস্তো। ১৯৪৩ সালে তার আবিষ্কৃত 'অ্যাকুয়া লাং' যন্ত্রটির কল্যাণে মানুষ এখন জলের নিচে ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণের পাশাপাশি, সাগরের গভীরে বসবাস করা প্রাণীদের জীববৈচিত্র্য প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পারছে।


মাছকে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে মাছই হতে হবে


জাক চেয়েছিলেন আকাশ জয় করতে, সে লক্ষ্যে তিনি ১৯৩০ সালে পাইলট হওয়ার জন্য ফরাসি নৌ একাডেমিতে যোগ দেন। কিন্তু মারাত্মক এক দুর্ঘটনায় তার দুই হাত ভেঙ্গে গেলে তার আকাশে ওড়ার স্বপ্ন থেমে যায়। সে মূহুর্তে নৌ অফিসার ফিলিপ তাইলিজ তাকে শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য সাঁতার কাটার পরামর্শ দেন। একদিন তাইলিজ জাককে ফ্রান্সের টউলনের কাছে ভূমধ্যসাগরে মাছ ধরতে নিয়ে যান ও সাঁতার কাটার জন্য নিজের একজোড়া গগলস ধার দেন। সেখান থেকে তার নতুন জীবনের শুরু হয়।


১৯৩০ সালে ফ্রান্সে সাগরের গভীরে ডুব দেওয়ার জন্য বিশেষ একধরনের রাবারের তৈরি জামা, তামার হেলমেট ও সীসাযুক্ত জুতা ব্যবহার করা হতো। পায়ের পাতার জন্য যে মোজা ব্যবহার করা হতো সেগুলো ভূপৃষ্ট থেকে বাতাস সরবরাহ করতে সাহায্য করতো। কিন্তু এর ব্যবহারে ডুবুরি সমুদ্রের খুব গভীরে যেতে পারতো না। ১৯২৫ সালে ইয়েভেস লে প্রিউর নামের একজন সাগরে শ্বাস-প্রশ্বাস কার্য চালানোর যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যন্ত্রটির আবিষ্কারে ডুবুরিদের ভারী ওজনের মোজা থেকে মুক্তি মিললেও, যন্ত্রটি থেকে সরবরাহকৃত বায়ু দ্রুত শেষ হয়ে যেত। যার ফলে ডুবুরিদের জলের খুব নিচে যাওয়া সম্ভব হতো না। এরকম নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য সে সময় মানুষ সাগরের খুব গভীরে পৌঁছাতে পারেনি।



অন্যদিকে প্রথমবার সাগরে ডুব দিয়ে জাক ৬০ ফুট গভীরে গিয়ে ৮০ সেকেন্ডের মতো জলের নিচে  থাকতে পেরেছিলেন। তখন তার উপলব্ধি হয়েছিল সাগরকে চিনতে এবং জলের নিচের জগতকে অনুধাবন করতে হলে এতো অল্প সময় যথেষ্ট নয়। তাই তাকে এমন কিছু আবিষ্কার করতে হবে যেটি জলের গভীরে মানুষকে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে এবং একটা ভিন্ন জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে।


তিনি তার একটা নিবন্ধনে লিখেছিলেন "মাছ পর্যবেক্ষণ করতে হলে আগে মাছ হতে হবে"।  আর মাছের কাছে যেতে হলে দরকার এমন যন্ত্রের যেটি দীর্ঘ সময় জলের নিচে শ্বাস-প্রশ্বাস ধরে রাখতে সাহায্য করবে।


সেখান থেকে তিনি ভাবতে থাকলেন সাগরের অতলে যেতে চাইলে তার এমন একটি যন্ত্রের প্রয়োজন-যেটি জলের চাপের সাথে ভারসাম্য করে ফুসফুসের জন্য বাতাস সরবরাহ করবে। কারণ একজন ডুবুরি জলের যতো গভীরে যেতে থাকে চাপ ততো বাড়তে থাকে এবং শরীরে বাতাসের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকে। এরকম পরিস্থিতিতে ফুসফুসের বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে দম আটকে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।


ব্যর্থতা থেকেই সফলতা


১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাক প্যারিসে গিয়ে প্রকৌশলী এমিল গ্যাগনানের সাথে দেখা করে সাঁতার কাটার সময় উৎপন্ন বায়ুচাপের সমস্যার সমাধান চান। গ্যাগনান ভাবলেন তার উদ্ভাবিত গ্যাস নিয়ন্ত্রক উদ্ভুত এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তারপর তারা একাধিক গবেষণা চালান এবং সাঁতার কাটার সময় যন্ত্রটির পরীক্ষামূলক ব্যবহার করেন।


১৯৪৩ সালে কয়েক মাস ধরে তিনবন্ধু জাক, টেলিয়েজ ও ফ্রেডেরিক ডুমাস মিলে 'অ্যাকুয়া লাং' যন্ত্রটি পরীক্ষা করে। পরীক্ষামূলক অনুশীলনের অংশ হিসেবে তারা ভূমধ্যসাগরের গভীরে ৫০০ বারের বেশি ডুব দেয়। প্রতিবার তারা আগের তুলনায় বেশি গভীরতাকে জয় করে, যা শুরু হয় ১৩০ ফুট থেকে এবং শেষ হয় ২১০ ফুট পর্যন্ত গভীরে গিয়ে।


জলের নিচে শ্বাস-প্রশ্বাস ধরে রাখতে ব্যবহৃত নাইট্রোজেন নারকোসিস মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। ১৯৪৭ সালে জাক কুস্তো তার যন্ত্র ব্যবহার করে ডাইভিং পরীক্ষার আয়োজন করেন, যেখানে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তার আবিষ্কৃত যন্ত্র সাগরের ৩২৮ ফুট গভীর পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা রাখে। কিন্তু এটির প্রাথমিক পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া তার বন্ধু মরিস ফার্গেস মারা যান। ১২০ মিটার গভীরে যাওয়ার পরে মরিস জলের মধ্যে থাকা অবস্থায় জ্ঞান হারায়। তাকে টেনে ওপরে ওঠানো হলেও আর জীবিত করা যায়নি।


জাক তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত জলে ডুবে ডুবে জলের নিচের জীববৈচিত্র্য ও মাছের সাথে কাটিয়েছেন

পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলে জাক কুস্তোর আবিষ্কৃত 'অ্যাকুয়া লাং' ফরাসী নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগরে লুকিয়ে রাখা বোমা এবং জলের তলদেশে পরে থাকা মৃত নাবিকদের দেহ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করে। যন্ত্রটি আবিষ্কারের প্রায় ৮০ বছর পার হয়ে গেলেও একই মৌলিক নকশা ব্যবহার করে এখনও অ্যাকুয়া লাং তৈরি করা হচ্ছে। তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার বিশ্বের ২৮ কোটি মানুষকে সাগরের গভীরে গিয়ে সরাসরি জলের নিচের জীববৈচিত্র্য দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।


জাক তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত জলে ডুবে ডুবে জলের নিচের জীববৈচিত্র্য ও মাছের সাথে কাটিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে ৮৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তিনি তার এক লেখাতে উল্লেখ করেছিলেন, "আমার আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ যেন সমুদ্রকে জানতে পারে ও ভালোবাসতে পারে"। ১৯৫৬ সালে কুস্তো জলের নিচের জগতকে মানুষের সামনে আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে 'দ্য সাইলেন্ট ওয়ার্ল্ড' নামের সিনেমা নির্মাণ করেন। সিনেমাটি এখনো অনেক তরুণকে উদ্দীপ্ত করে অ্যাকুয়া ডাইভ শিখতে। তার নির্মিত এই সিনেমাটি রূপালী জগতের সেরা মুকুট অস্কার জিতে নিয়েছিল।


অ্যাকুয়া লাং আবিষ্কারের পর সমুদ্রের গভীরের অনেক কিছু সম্পর্কে মানুষ জানতে পেরেছে। কিন্তু ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দাবি, এখনো সমুদ্রের অতলের  ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষের অজানা রয়ে গেছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.