ক্লোনিংয়ের কথা আর শোনা যায় না কেন?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ১৯৯৬ সালের ৫ জুলাই ডলি নামের এক ভেড়ার জন্ম হয় গবেষণাগারে। ক্লোনিং পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা ডলির জন্ম দেন। আরেকটি ভেড়ার স্তনগ্রন্থি থেকে কোষ নিয়ে সে কোষ ক্লোন করে বিজ্ঞানীরা ডলিকে 'তৈরি' করেন।


মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী ডলি প্যার্টনের নামে নাম রাখা হয় ডলির। স্কটল্যান্ডের রসলিন ইনস্টিটিউট ইন মিডলোথিয়ান-এর গবেষকদের গবেষণার অংশ হিসেবে ডলির জন্ম হয়।


যেকোনো জীবন্ত প্রাণীর জিন থেকে অবিকল আরেকটি প্রাণী তৈরি করার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াই হচ্ছে ক্লোনিং। তবে ১৯৯৬ সালে সফলভাবে প্রথম ক্লোন করা প্রাণীর জন্ম দেওয়া গেলেও ক্লোনিং নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করেছিলেন সেই ১৯৫০-এর দশক থেকে।


'৫০-এর দশকে ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী জন গার্ডন আফ্রিকান নখরবিশিষ্ট ব্যাঙের ক্লোন তৈরি করার একটি উপায় খুঁজে পান। কিন্তু তখন অব্দি বড় কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্লোন করা প্রায় অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হচ্ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে।


ডলির জন্মকথা


বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, অনেক চমকপ্রদ আবিষ্কারই খানিকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ডলির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কিছুটা এরকমই ছিল। রসলিন ইনস্টিটিউট প্রাথমিকভাবে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরীক্ষা করছিলেন, কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টাতেই তারা সাফল্য তথা পরিপূর্ণ ডলিকে পেয়ে যান।


রসলিন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার নামের একটি জটিল প্রক্রিয়ায় ভেড়ার ক্লোন করার চেষ্টা করছিলেন। তারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে একটি ভেড়ার (মাদার শিপ) স্তনগ্রন্থির কোষের নিউক্লিয়াসকে দ্বিতীয় একটি ভেড়ার ডিম্বাণুতে স্থানান্তর করেন।


এর ফলে ওই ডিম্বাণুতে মাদার শিপের সব ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) স্থাপিত হয়। তারপর গবেষণাগারে একটি ভ্রূণের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকে ওই ডিম্বাণুটি।


তবে বিজ্ঞানীরা তখন এতদূর পর্যন্ত প্রত্যাশা করেননি। তারা ভাবতেই পারেননি যে গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে আরেকটি কোষের ডিএনএ-র মাধ্যমে কোনো ভ্রূণকে বিকশিত করা সম্ভব। তারা কেবল ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তির সাফল্যের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করছিলেন।


'ডলি ভেড়ার সফল ক্লোনিং বিশ্বের সামনে এটাই প্রমাণ করলো যে পূর্ণবয়স্ক কোষের (অ্যাডাল্ট সেল) নিউক্লিয়াসে থাকা সব ডিএনএ রিপ্রোগ্রাম করলে এটি একটি আদি কোষের মতোই আচরণ করে ও নতুন প্রাণীর জন্ম দিতে সক্ষম হয়,' এমনটাই মন্তব্য করেছেন লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট-এর স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট জেনেটিক্স ল্যাবোরেটরি বিভাগের প্রধান রবিন লভেল-ব্যাজ।


অপ্রত্যাশিতভাবে পুষ্ট একটি ভ্রূণ তৈরি করে ফেলার পর রসলিন ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীরা সেটিকে তৃতীয় একটি ভেড়ার গর্ভে স্থাপন করেন। এভাবেই জন্ম হয় বিজ্ঞানের আশ্চর্য প্রাণী ডলির।


স্বভাবতই এ খবরে সাড়া পড়ে গিয়েছিল বিশ্বে। মানুষ অবাক হয়েছিল এমন অভূতপূর্ব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে। গণমাধ্যমগুলো তখন নিয়মিত ডলিকে নিয়ে খবর প্রকাশ করছিল। 


স্কটল্যান্ডে যখন ডলিতে মগ্ন সবাই, তখন ঠিক অপর প্রান্তে জাপানে একজন বিজ্ঞানী পুরো ঘটনার ওপর বিশেষ নজর রাখছিলেন।


চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঞ্জীবনী আবিষ্কার


শিনি ইয়ামানাকাকে তার সহকর্মীরা 'জামানাকা' বলে ডাকত। জাপানি এ শব্দের অর্থ হচ্ছে বাধা। তাকে এ নাম দেওয়া হয়েছিল কারণ ভদ্রলোক অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচারে একটু বেশিই সময় নিতেন।


১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইয়ামানাকার ক্যারিয়ার বেজায় মন্দ যাচ্ছিল। অপারেশন থিয়েটারের পরে তার কাজ হয় ওসাকা সিটি ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুল-এ ইঁদুরের ওপর পর্যবেক্ষণ চালানো। ওখানে কাজ করার সময়ই তিনি জানতে পারেন স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা ক্লোনিং পদ্ধতিতে ভেড়ার জন্ম দিয়েছে।


ইয়ামানাকাকে এ খবরে পেয়ে বসে। তিনি ভাবতে শুরু করেন অ্যাডাল্ট সেল-এ রিপ্রোগ্রামিং-এর ক্ষেত্রে কোনো জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ওই কোষকে কি ভ্রূণ-পর্যায়ে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব কি না।


এরপর প্রায় এক দশক ধরে এ ধারণার ওপর কাজ করে ইয়ামানাকা সাফল্য অর্জন করেন। তার আবিষ্কৃত প্রযুক্তির ফলে শরীরের ত্বক বা রক্তকোষকে শরীরে থাকা অন্য যেকোনো ধরনের কোষে পরিবর্তন করা সম্ভব হলো। এ আবিষ্কারের কল্যাণে ২০১২ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ইয়ামানাকা।


ইয়ামানাকার এ আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে রোগীর রক্তকোষ ব্যবহার করে ছোট ছোট অঙ্গ তৈরি করতে সক্ষম হলেন। এ অঙ্গগুলো ব্যবহার করে নতুন ঔষধ, টিকা ইত্যাদি পরীক্ষা করা সম্ভব হলো। এমনকি বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিনগত যেকোনো বিকৃতিও সুস্থ করা সম্ভব হবে।


পোষ্য ক্লোনিংয়ের হিড়িক


১৯৯৬ সালে রসলিন ইনস্টিটিউট নিদারুণ অর্থসংকটে ভুগছিল। সরকারের দিক থেকেও বাজেট ছাঁটাইয়ের ভয় ছিল। ডলির সাফল্য তাদেরকে সাময়িকভাবে এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে।


টেক্সাসভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি ভায়াজেন ১৯৯৮ সালে ক্লোনিং প্রযুক্তির মেধাস্বত্ব কিনে নেয়। তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ক্লোনিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবাদিপশুর উন্নয়ন করা।


তবে ২০১৫ সালে ভায়াজেন ক্লোনিং পদ্ধতির নতুন একটি রূপ দিলো। পোষাপ্রাণীর মালিকেরা চাইলে তাদের কুকুর-বিড়ালের ক্লোনিং করতে পারবে- এমন সেবা দিতে শুরু করলো কোম্পানিটি।


সেসময় একটা বিড়াল ক্লোনিং করতে ৩৫ হাজার ডলার ও একটি কুকুরের জন্য ৫০ হাজার ডলার খরচ করতে হতো। তাতে অবশ্য চাহিদার কোনো কমতি হয়নি। মোট কতগুলো প্রাণীকে এখন পর্যন্ত ক্লোন করা হয়েছে তা ভায়াজেন না জানালেও কোম্পানিটির একজন ক্লায়েন্ট সার্ভিস ম্যানেজার মেলাইন রদ্রিগেজের হিসেব মতে এ সংখ্যা শতকের ঘর ছুঁয়েছে।


শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এভাবে পোষা প্রাণীর ক্লোন করা হচ্ছে না। দক্ষিণ কোরিয়ার সুয়াম বায়োটেক কোম্পানি ও চীনের সিনোজেন কোম্পানিও কুকুরের ক্লোনিং সেবা প্রদান করে।


মেলাইন রদ্রিগেজ বলেন, 'প্রতি বছরই আগের তুলনায় বেশি সংখ্যক প্রাণীর ক্লোনিং করছি আমরা। প্রতি সপ্তাহেই আমাদের এখানে ক্লোন করা কুকুর ছানার জন্ম হয়। আমরা তেমন একটা বিজ্ঞাপন দেই না এ নিয়ে। গ্রাহকেরা একজন আরেকজনের কাছ থেকে শুনে শুনে আমাদের কাছে আসেন।'


বিলুপ্ত প্রজাতি ও ক্লোনিং


ডলি'র ক্লোনিং-এর পরে অনেকগুলো প্রশ্ন তৈরি হলো। বিজ্ঞানীরা কি মানুষের ক্ষেত্রেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন? এবং এর ফলে কী কী নৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে?


২০১৩ সালে সফলভাবে মানবভ্রূণের ক্লোন করা হয়। কিন্তু এর পরের ধাপ, অর্থাৎ ক্লোনিং পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ  মানুষের জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করেননি বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীবাসী এ ব্যাপারটিকে কীভাবে দেখবে, আর এ ক্লোনিং-এর ফলে সম্ভাব্য কী কী সমস্যার উদ্ভব হতে পারে তা নিয়ে এখনো আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার দরকার বিজ্ঞানীদের।


২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে চীনের বিজ্ঞানীরা প্রাইমেট ক্লোন করেন। এরপর থেকে মানুষের কাছাকাছি আর কোনো প্রাণীর ক্লোন করা হয়নি এখন পর্যন্ত। তার বদলে বিজ্ঞানীরা চাইছেন যেসব প্রাণী বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, সেগুলোকে ক্লোন করতে।


জায়ান্ট পান্ডা ও নর্দান হোয়াইট রাইনো প্রজাতির কেবল দু্ইটি প্রাণী বর্তমানে বেঁচে আছে। এ দুই প্রাণীর ক্লোন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে টিকে থাকা ব্ল্যাক ফুটেড ফেরেট ও শেভাস্কিস হর্স-এর ক্লোন করেছে ভায়াজেন।


হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল-এর জিনতত্ত্বের অধ্যাপক জর্জ চার্চ ক্লোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উলি ম্যামথকে ফিরিয়ে আনার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। ৪০০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এ প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটিকে আবারও পৃথিবীতে জন্ম দেওয়ার জন্য চার্চের কোম্পানি কলোসাল এখন পর্যন্ত সাড়ে ১৪ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১২৪ কোটি ৭২ লাখ টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছে।


চার্চের উদ্দেশ্য হচ্ছে এশিয়ান হাতির ত্বক থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে তা ক্লোনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে ম্যামথের ডিএনএ-তে রিপ্রোগ্রাম করা। এর ফলে তৈরি হবে হাতি ও ম্যামথের সংকর প্রাণী।


তবে লভেল-ব্যাজ প্রশ্ন করেছেন, 'ম্যামথকে পৃথিবীতে আবার ফিরে পেলে তো খুব ভালো হবে, কিন্তু সে ভালোটা কি ম্যামথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে?'


ক্লোনিং প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ


২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে চিকিৎসাবিজ্ঞানে আরেকটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। প্রথমবারের মতো শূকরের হৃৎপিণ্ড মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা হয়।


কিন্তু এ প্রতিস্থাপনের কেবল দুই মাসের মাথায় ডেভিড বেনেট নামের ওই ব্যক্তি মারা যান। তবে এ ঘটনায় বিজ্ঞানীরা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন একটি আশার আলো দেখছিলেন।


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অঙ্গ সংকটের কারণে প্রতিবছর অনেক মানুষ মারা যান। তাই যদি শূকর বা অন্য কোনো প্রাণীর অঙ্গ মানবদেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে এ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান পাওয়া যাবে।


জার্মানির মিউনিখের সেন্টার ফর ইনোভেটিভ মেডিক্যাল মডেলস-এর প্রধান একার্ড উল্ফ বর্তমানে চেষ্টা করছেন ক্লোনিং পদ্ধতিতে শূকর জন্ম দিতে। তার লক্ষ্য হলো মোটামুটি যথেষ্ট পরিমাণে ক্লোন করা শূকর তৈরি করা যাতে এগুলো থেকে মানবদেহে ব্যবহার করা সম্ভব এমন অঙ্গ পাওয়া যাবে।


মানুষের জন্য অঙ্গদাতা হিসেবে বিজ্ঞানীদের প্রথম পছন্দ শূকর। কারণ এটির অঙ্গের আকৃতি ও কাজ মানবদেহের সাথে তুলনামূলকভাবে ভালো মেলে। আবার শূকরের ওপর ভালোভাবে জিন প্রকৌশলবিদ্যা খাটানো যায়।


তাই উল্ফ চাচ্ছেন ক্লোনিং পদ্ধতিতে শূকরের দেহে এমন পরিবর্তন আনা যার ফলে আরও সহজভাবে অঙ্গ স্থানান্তর করা যাবে, অঙ্গ না মেলার বা ক্ষত সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে। সব ঠিক থাকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যেতে চান তিনি।


ডলির জন্মের পর ক্লোনিং প্রযুক্তিতে অনেক বছর কেটে গেছে। কিন্তু সেই প্রথম থেকেই ক্লোনিং যতটা প্রাসঙ্গিক ও বিতর্কপূর্ণ বিষয় ছিল, আজ এ ২০২২ সালে এসেও ক্লোনিং বিষয়ক ধারণা আগের মতোই রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.