রবীন্দ্রনাথের‘মনের মানুষ’ ও ‘ছদ্মবেশী’ এক বাউল

 


ODD বাংলা ডেস্ক: গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথে একতারা হাতে, আলখাল্লা পরে হেঁটে যাচ্ছে বাউল। কণ্ঠ ভরাট গানের সুরে। তিনটি ভুবন জুড়ে মনের মানুষের স্বপ্ন! বাউল সম্প্রদায়ের এই তো পরিচিত ছবি। আমি বলি এক ছদ্মবেশী বাউলের কথা। একটি জন্মজীবন শুধু শব্দের তুলি বুলিয়ে একে গেলেন মনের মানুষের শব্দচিত্র। ব্যথার আল্পনা দিয়ে মনের সহস্রদল পদ্মের উপর প্রতিষ্ঠিত করলেন জীবনদেবতাকে। তারপর? তারপর পৃথিবী মেতে উঠল তার গানের সুরে। রবীন্দ্রনাথের গানে বাউল প্রভাব অনিবার্য ছিল। ১৮৮০ সালের গোড়ার দিকে বাউল গানের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। তখনও সে পরিচয় আন্তরিক হয়ে ওঠেনি। অথচ সাময়িক পরিচিতির সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৩-তে লিখে ফেললেন, ‘বাউলের গান’ প্রবন্ধ। মন্ত্রবর্জিত এইসব সাধক, যারা প্রভাতের আলো মেখে, পদ্মানদীর তীরে একতারা হাতে, গভীর নির্জন পথে সাধনায় মগ্ন হয়ে থাকেন, রবীন্দ্রনাথের উন্মুখ আগ্রহ তাদের আলোকিত করবে ধীরে ধীরে। আলোকিত হবেন রবীন্দ্রনাথ নিজেও।

বাউল গানের সুরে শব্দব্রহ্মকে প্রতিষ্ঠা দেবেন নতুনভাবে। একটা সময় প্রবাসী পত্রিকায় বাউলদের গান সংগ্রহ করার কাজে মগ্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লোকগান সংগ্রহ করার উৎসাহ তো ছিলই, সেইসঙ্গে বাউল সাধনার আনুষ্ঠানিকতা ভঙ্গিটিকে আত্মস্থ করছিলেন তিনি। মন্ত্রহীনের নান্দনিক উপাসনার ঘরানা তাঁর নিজেরও। এর অন্তরালে গভীর মনস্তত্ত্ব রয়েছে। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এমনিতেই সমাজের প্রবল হিন্দুত্ববাদী মূল স্রোত থেকে ভিন্ন ছিলেন। সেই দিক থেকে নির্ভার বাউল সাধনা তাকে মুগ্ধ করে থাকবে।


১৮৯০ সালে বাউলদের সঙ্গে পরিচয় হয় রবীন্দ্রনাথের। ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’— এই বাউলগানটি প্রথম শুনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ‘মনের মানুষ’-ই হল বাউলদের বীজমন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ চিরবিরহী। অন্তরের গভীরে তারও মনের মানুষের সন্ধান চলেছে অবিরল। তাই মগ্নচেতনে তিনিও যে কখন একতারা হাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন, হয়তো তিনি নিজেও জানেন না। তিনি নিজস্ব বোধ থেকে লিখেছিলেন, ‘বাউলের কাছে মনের মানুষ হলো পরম সুরে বাঁধা এক অলৌকিক বাদ্যযন্ত্র—যে যন্ত্র থেকে জীবনসংগীতে অসীম সত্যের প্রকাশ ঘটে। সত্যকে লাভের যে আকুতি আমাদের মধ্যে আছে, যে সত্যের এখনো দেখা মেলেনি, তাই নিজের বাউল গানে স্ফুরিত হয়।’ শিলাইদহে জমিদারি পরিচালনার সময় বাউলদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু পরে তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে সেই সময় বাউলদের সঙ্গে পরিচয় করার কথা তিনি ভাবেননি। এইটুকুই জানতেন, তারা গান গেয়ে ভিক্ষা করেন। অথচ গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটি রবীন্দ্রনাথ মনের দোসরের মতো গ্রহণ করবেন এবং অন্তরে তিনিও বাউলবেশ গ্রহণ করবেন।  তার সৃজনের মধ্যে প্রকাশিত হবে বাউল ভাবনা। উপনিষদের জটিল তত্ত্বের সঙ্গে বাউল সাধনার সহজিয়া ধারাকে মিলিয়ে দেবেন রবীন্দ্রনাথ। উপনিষদের ‘অন্তরতর যদমাত্মা’ এবং বাউলদের ‘মনের মানুষ’ যে আসলে এক, এই অনুভূতি রবীন্দ্রনাথের মনে বিস্ময়ের ঘোর লাগিয়ে দিয়েছিল।


রবীন্দ্রনাথ ‘প্রাণের মানুষ’, ‘মনের মানুষ’-কে গ্রহণ করবেন নিজের মতো করে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে বাউল প্রভাবের দুটি ধারা আছে। একটি পদ্মাপারে, শিলাইদহ পর্বে আর অন্যটি শান্তিনিকেতনে, বীরভূমের লালমাটির পথে। দুটি প্রভাবই রবীন্দ্রজীবনে অনিবার্য ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ অনেক দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছিলেন। সেইসব গানে বাউল সুর এক গভীর মেলবন্ধন তৈরি করেছিল। গীতাঞ্জলির কবিতায় বাউল প্রভাব আশ্চর্য সৌন্দর্য তৈরি করে। বাউলদের দেহবাদ বা সন্ধ্যাভাষা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেননি। যা গ্রহণ করেছেন, তা হল তাদের সহজিয়া আনন্দ। কোনো বিশেষ ধর্মমত কোনোদিনই রবীন্দ্রনাথকে বন্ধনের শাসনে রাখতে পারেনি। বাউলসাধনার সবটুকু নয়, ভঙ্গিটুকু গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার প্রয়োগ করা কিছু শব্দ, ভাবধারা, তার সাহিত্যের বাউল চরিত্রদের দেখে শশিভূষণ দাশগুপ্ত  তাকে ‘The greatest of the Bauls of Bengal’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ছদ্মবেশী বাউল। বাউলদের সুর ও বাণী নাহলে এত সহজে তার অন্তরে প্রবেশ করত না। 


কালীমোহন ঘোষ বলেছিলেন, শিলাইদহে লালন ফকিরের শিষ্যদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার আলাপ চলত। তবে লালন ফকিরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছে কীনা এই বিষয়ে সন্দেহ আছে। গগন হরকরার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। লালন, গগন, হাসন রাজা এবং আরো অনেক অপ্রচলিত বাউল গানের প্রভাব তার সাহিত্যে রয়েছে। শান্তিদেব ঘোষ আবার রবীন্দ্রনাথের উপর মধ্যবঙ্গের বাউলদের প্রভাবের কথা বলেছেন।


রবীন্দ্রসাহিত্যে বাউলের মতো কিছু চরিত্র আলোর খবর নিয়ে আসে। ফাল্গুনী, পরিত্রাণ, প্রায়শ্চিত্ত, অচলায়তন, শারদোৎসব, রাজা, ঋণশোধ, মুক্তধারা-য় নানা রূপে বাউল চরিত্র এসেছে। তারা কখনও বাউল বৈরাগী, কখনও দাদা ঠাকুর বা ঠাকুরদাদা আবার কখনও আদতেই বাউল। ‘অচলায়তন’ নাটকে দাদাঠাকুর একেবারে আদর্শ বাউল—


‘একলা কিন্তু হাজার মানুষ,

হাসির দলে, চোখের জলে

সকল ক্ষণে!’


এই একলা কিন্তু হাজার মানুষ রবীন্দ্রনাথ নিজেও। হয়তো তাই ঠাকুরদা, বাউল বা দাদাঠাকুরের ভূমিকায় সহজে মানিয়ে যায় তাঁকে। সত্তর বছর বয়সেও শান্তিনিকেতনের জন্য অর্থসংগ্রহ করার অভিপ্রায়ে একতারা হাতে নেচে ওঠেন রবীন্দ্র বাউল। অন্তরের আট কুঠুরি নয় দরোজার জটিল তত্ত্বের সমাধানের প্রয়োজন তাঁর ছিল না। তিনি জীবনের জটিল পথে সহজ আনন্দের সন্ধান পেয়েছিলেন। শব্দ দিয়ে তৈরি ছিল তাঁর একতারা। অন্তরে বাউল ছিলেন বলেই কোনো ধর্মের কোনো আড়ম্বর তাঁকে স্পর্শ করেনি। ‘ব্রাত্য ও মন্ত্রহীন’ হয়েই রয়ে গেলেন আজীবন। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.