শরীরের লোমের সাথে নারীর সম্পর্ক জটিল!



 ODD বাংলা ডেস্ক: নখ বা চুলের মত লোমও মানুষের শরীরের অংশ। আমাদের দেহের নানা জায়গায় – হাতে, বগলের নীচে, পায়ে, পিঠে, পেটে এবং গোপন অঙ্গে কম-বেশি লোম থাকে। কিন্তু তারপরও দেহের লোম নিয়ে মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অন্ত নেই, বিশেষ করে নারীদের ভেতর। নারীদের বিরাট অংশ শরীরের লোম নিয়ে কুণ্ঠা বোধ করে। বিশেষ করে অনাবৃত অংশের লোম উঠিয়ে ফেলার জন্য অনেক নারী যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত।


রেজর ব্র্যান্ড জিলেটের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, ব্রিটেনে ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মেয়েদের ৫০ শতাংশই সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের ছবি পোস্ট করা থেকে বিরত থাকে।


নারীদের এই কুণ্ঠা থেকে বের করে আনতে সম্প্রতি ব্রিটেনে ‘জানুহেয়ারি’ (#Januhairy) এবং ‘বডিহেয়ারডোন্টকেয়ার’ (#bodyhairdontcare) হ্যাশট্যাগে অনলাইনে প্রচারণা দেখা গেছে।


ঐ সব প্রচারণায় কিছুদিনের জন্য নারীদের শরীরের লোম শেভ না করার বা লোমের বিষয়টি পাত্তা না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে তাতে বড় কোনো ফল হয়েছে বলে মনে হয়না।


অবশ্য শরীরের লোম নিয়ে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গির অনেকটাই নির্ভর করে কীভাবে সে বড় হচ্ছে, পরিবারে বাবা-মা ঘনিষ্ঠজনরা কী শেখাচ্ছে, তার ধর্ম, এবং তার জাতি-গোষ্ঠীগত পরিচয়ের ওপর।


বিবিসির সংবাদদাতা নিয়াম হিউজ ব্রিটেনে ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর তিনজন নারীর সাথে শরীরের লোম নিয়ে কথা বলেছেন। শোনা যাক তাদের অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি :


খাদিজা তাহির, ছাত্রী, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, জানুহেয়ারি ধরণের আন্দোলন আমি বা আমার মত এশীয় বংশোদ্ভূত বাদামি চামড়ার মেয়েরা ঠিক বুঝতে পারেনা। মনে হয়, আমার সাথে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, কারণ ছোটবেলা থেকে দেহের লোমকে ঘৃণা করে বড় হয়েছি আমি।


শিশু বয়সে পরিবারের সাথে পাকিস্তান থেকে ব্রিটেনে আসেন তিনি। ‘একটা সময় ছিল যখন সত্যিই আমি দেহের লোমকে ঘেন্না করেছি। ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। নিজের চামড়া নিয়ে নিজেই অস্বস্তিতে ভুগতাম।’


তাহিরা বলেন, এতদিনে তিনি আত্মবিশ্বাস বোধ করতে শুরু করেছেন। এখন ভাবি এত হীনমন্যতা ঠিক নয়। তারপরও শরীরের লোম যেন দেখা না যায়, সে চেষ্টা করি, নিয়মিত কামিয়ে ফেলি।


কবে থেকে তার এই অস্বস্তি? খাদিজা বললেন তার বয়স যখন ১০ বা ১১। ‘আমি দেখতাম আমার সিনিয়র কাজিনরা, আমার মা লোম শেভ করছে। টিভিতে দেখতাম আমার বয়সী মেয়েদের হাত-পা বা মুখে কোনো লোম নেই। তখন থেকেই আমি ধরেই নেই আমাকেও লোমহীন হতে হবে।’


শিশু বয়সে পাকিস্তানে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে তাহিরা দেখেছেন মহিলারা নিয়মিত দেহের লোম ঢাকার চেষ্টা করছে। ওয়াক্সিং করছে, কামিয়ে ফেলছে। ‘পাকিস্তানে অন্তত মধ্যবিত্ত সমাজে নারীদের কাছে এটা অনেকটা রুটিন।’


তবে তার নিজের মধ্যে এই তাড়না ঢোকে যখন তিনি পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডে এসে স্কুলে ভর্তি হন। শরীর-চর্চার ক্লাসের আগে পরে চেঞ্জিং রুমে পোশাক বদলের সময় তিনি দেখতেন সহপাঠী শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের মাথায় পাতলা সোনালী চুল এবং হাতে-পায়ে-মুখে তার চেয়ে অনেক কম লোম।


বন্ধুরা মাঝে মধ্যে তার মুখের লোম নিয়ে কথা বলতো কিন্তু একদিন সহপাঠী একটি ছেলের মন্তব্যে দারুণ চোট পান খাদিজা।


‘স্কুলে সেদিন প্রথম চুল বেঁধে গিয়েছিলাম। আমার কানের পাশে চুল দেখে একটি ছেলে বিস্মিত হয়ে বললো, কীভাবে আমার এই চুল হলো।। তারপর থেকে আমি নিয়মিত কানের পাশের ঐ চুল কামিয়ে ফেলতাম।’


মুখমণ্ডলের লোম নিয়েও ঐ বয়সেই উদ্বেগ শুরু হয় খাদিজার। লুকিয়ে সারা মুখে হেয়ার রিমুভাল (লোম ঝরানোর) ক্রিম মাখতে শুরু করেন তিনি।


‘পরে অবশ্য ভেবেছি মাত্র ১১ বছর বয়সের একটি ছেলের মন্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া ভুল হয়েছিল।’


তবে দেহের পশম, চুল নিয়ে সমাজ ভেদে দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য রয়েছে।


অমৃত, উলভারহ্যাম্পটন


পাঁচিশ-বছর বয়সী অমৃত শিখ পরিবারের মেয়ে। গোঁড়া শিখ ধর্মীয় রীতি মেনে জীবনযাপন করেন। মাথার চুল পাগড়িতে ঢাকা থাকে। কানের পাশে, থুতনিতে ঠোঁটের ওপরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লোম গজিয়েছে, কিন্তু মূলত ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে তা কামানোর কোনো চেষ্টা তিনি করেননা।


তিনি বলেন, তাদের ধর্মে চুলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। লম্বা চুল রাখা, চুল না কাটা পবিত্রতার প্রতীক। শিখরা মনে করে, চুল গজানো এবং চুলের বৃদ্ধি ঈশ্বরের ইচ্ছা, সুতরাং তাকে ব্যাহত করা ঠিক নয়। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বলে আপনি যখন ঈশ্বরের নাম নেন, তখন আপনার প্রতিটি চুল কাঁপে। শিখ ধর্মে চুলের সাথে আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক রয়েছে।


অমৃত জানান, তিনি এবং তার পরিবার চুলকে এতোটাই পবিত্র মনে করেন যে, চিরুনির সাথে যে চুল উঠে আসে তা না ফেলে জমিয়ে পরে তা দাহ করেন।


আর চুল নিয়ে এই সম্মান ও ভক্তির জন্য শরীরের এবং মুখে গজানো লোমের সাথে তার নারীত্বের বোধের কোনো সংঘাত হয়নি অমৃতের। তবে যখনই তিনি লোকসমক্ষে যান, বা তাকে অন্যের মুখোমুখি হতে হয়, তখন অনেক সময়ই তাকে টিকা-টিপ্পনী শুনতে হয়।


অমৃত বলেন, বিরূপ মন্তব্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসে পুরুষের কাছ থেকে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের কাছ থেকে। আমার যখন বয়স নয়, তখন একটি ছেলে একদিন বলেছিল অমৃত তোমার গোঁফ গজিয়েছে। আমি এতটাই মুষড়ে পড়েছিলাম যে লুকিয়ে ঠোটের ওপর অংশ ব্লিচ করা শুরু করে দিয়েছিলাম। এখন ভাবি যে মানুষদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, তার মতামত- মন্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়ার দরকার কী?


তবে অমৃত স্বীকার করলেন, বাইরে বেরুলে অনেক সময় একটি চাদর দিয়ে নাকের নীচ থেকে থুতনি পর্যন্ত ঢেকে রাখেন তিনি।


‘এটা নিরাপত্তার জন্য। মানুষ যেন বাজে মন্তব্য না করে, আমার দিকে কিছু ছুঁড়ে না মারে। গন্তব্যে পৌঁছে চাদর খুলে ফেলি।’


লা লা লাভ, লন্ডন


ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে দেহের চুল, পশমকে মেনে নিয়েছেন অমৃত, কিন্তু সেসব নিয়ে কোনো হীনমন্যতা নেই ব্লগার লা লা লাভ-এর (সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যবহৃত নাম)। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেহের চুল বা রূপ নিয়ে নারীদের হীনমন্যতা ঘোচানোর চেষ্টা করছেন কৃষ্ণাঙ্গ এই তরুণী।


তিনি বলছিলেন কীভাবে অল্প কমবয়সে মা তার ভেতর এই আত্মবিশ্বাসের সূচনা করেছিলেন।


লা লা লাভ বলেন, আমার বয়স তখন ১১। আমার মা একদিন বলেন তোমার বগলের চুলে তোমাকে অনেক সেক্সি দেখাচ্ছে। আমার মনে হয়েছিল আমিতো কখনো এটা ভাবিনি…মা যখন বলছেন যে বগলের চুলে আমাকে সেক্সি দেখাচ্ছে তাহলে আমি সেক্সি।


তার মতে, শরীরের চুল, লোম শরীরের অংশ, ব্যক্তিত্বের অংশ এবং তা ঢাকতে তিনি নিজের ওপর চাপ তৈরি করতে রাজী নন। ‘আমার পা লোমশ হলে হবে, এটাই প্রাকৃতিক, তাই স্বাভাবিক।’


পায়ের পশম আছে জেনেও তিনি নিয়মিত ছোট স্কার্ট পরেন।


‘অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ছবি দেখে অনেক ছেলে বিরূপ মন্তব্য করে। আমি তাদের উত্তর দিই আমার বগলের চুল নিয়ে আমার কোনো অসুবিধা নাই, তোমার কি সমস্যা?’


তিনি বলেন, তার ফলোয়ার অনেক নারীকে তিনি আত্মবিশ্বাসী করে তুলছেন। ‘তারা এখন মনে করে খাটো হওয়া বা মোটা হওয়া নিয়ে এত উদ্বেগের কিছু নাই।’


প্রেমের সম্পর্কে অসুবিধা হয়না? এই প্রশ্নের উত্তরে লা লা লাভ বলেন, তার শরীর, দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি তার পুরুষ সঙ্গী যদি কখনো বাজে কথা বলে, তাকে ছেড়ে দিতে তিনি দ্বিধা করবেন না।


আমি যা তাই, কাউকে খুশি করতে আমি আমার স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে রাজী নই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.