প্রাচীন শিল্পকর্ম থেকে সবচেয়ে দামী মসলা জাফরানের উৎপত্তি ইতিহাস

 


ODD বাংলা ডেস্ক: বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ঝাল, মিষ্টি জাতীয় খাবারে জাফরান ব্যবহার করা হয়। ঔষধ ও রূপচর্চার কাজের পাশাপাশি জাফরানের রয়েছে অনেক গুণাগুণ। প্রাচীনকাল থেকেই  মসলা হিসেবে ও খাবারে সুন্দর রঙ আনতে  জাফরানের ব্যবহার হয়ে আসছে। মসলা হিসেবে দামের দিক থেকে জাফরান বিশ্বের অন্যতম দামী মসলা। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও দামী জাফরানের উৎপত্তির ইতিহাস চলুন জেনে নেওয়া যাক। 


জাফরান ক্রোকাস ফুলের গর্ভমুন্ডের লাল আশঁগুলোকে শুকিয়ে তৈরি করা হয় জাফরান। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোতে বন্য জাফরান গাছ হাজার হাজার বছর ধরে জন্মালেও, ঠিক কখন এবং কোথায় প্রথমবারের মতো আমাদের পূর্বপুরুষরা অন্যান্য শস্যর মতো জাফরান চাষ শুরু করে তা নিয়ে গবেষণাও হয়েছে। 


মধ্য ইউরোপ থেকে দক্ষিণ ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে চীনের পশ্চিম পর্যন্ত আনুমানিক ২৫০ প্রজাতির ক্রোকাস ফুল জন্মায়। ক্রোকাসের এই প্রজাতিগুলি বন্য অঞ্চলে জন্মাতে দেখা যায়। প্রায় ৫০ হাজার বছর  পূর্বে  বর্তমান ইরাকের একটি গুহায় আঁকা ছবিতে রঙ হিসেবে মানুষ প্রথমবার বন্য জাফরান ব্যবহার করে । প্রাচীন সুমেরীয়, অ্যাসিরিয়া ও ব্যাবলনীয় সভ্যতার গ্রন্থগুলোতে ঔষধ ও রঙ হিসেবে জাফরান ফুল ক্রোকাস ব্যবহার করার বর্ণনা পাওয়া গেছে।  


অপরদিকে, চাষকৃত জাফরান যেগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষ রান্না, রূপচর্চা ও পারফিউম হিসেবে ব্যবহার করছে সেগুলো বন-জঙ্গলে জন্মায় না। গ্রিক দার্শনিক থিওফ্রাস্টাস প্রথম ব্যক্তি-যিনি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ থেকে তৃতীয় শতাব্দীতে কীভাবে মানুষের সাহায্যে অপ্রজনন পদ্ধতিতে জাফরানের বংশবিস্তার করা যায় সেই ব্যাখ্যা দেন। সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে এখন সারাবিশ্বে জাফরান চাষ করা হচ্ছে, যেখানে প্রতি কেজি জাফরানের মূল্য ১ লক্ষ টাকা থেকে ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। 


'ফ্রন্টিয়ারস ইন প্ল্যান্ট সাইন্স' এ এক গবেষবণায় গবেষকরা বলেন, প্রাচীন চিত্রকর্মগুলোতে যে জাফরান ব্যবহৃত হয়েছে-সেগুলোর ঐ অঞ্চলে জন্মানো জাফরানের জিনগত বৈশিষ্ট্যর সাথে মিল রয়েছে। 


জার্মানির ফরসচুংজেনট্রাম জুলিচের বায়ো-এন্ড জিওসায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের পিএইডি শিক্ষার্থী ও গবেষণাটির প্রধান গবেষক, সাইয়্যেদেহ-সানাম কাজেমি-শাহনদশতি বলেন, "কোথায় এবং কবে প্রথম জাফরান চাষ শুরু হয়েছিল তা খুঁজে বের করা সহজ বিষয় ছিলনা। কেননা দুটির পরিবর্তে জাফরানগুলোর প্রতিটিতে তিনটি করে ক্রোমোজোম রয়েছে এবং  একটি বড় জিনোম রয়েছ। যার ফলে প্রজাতিগুলোর জিনগত অধ্যায়ন বেশ জটিল ও কঠিন করে তুলেছিল"। 


"যেহেতু প্রাচীনকালের ক্রোকাস প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়নি, তাই আমরা প্রাচীন শিল্পকর্মগুলোর ওপর গবেষণা শুরু করি, যেগুলোতে জাফরান রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী ছিলাম এটি আমাদেরকে এর উৎপত্তি অঞ্চল খুঁজে পেতে সহায়তা করবে"।


বিশ্লেষকরা ইতিহাস থেকে যুক্তি দেন যে, প্রাচীন গ্রিসের মিনোয়ান সভ্যতার শিল্পকর্মগুলি সম্ভবত জাফরান ব্যবহারের সবচেয়ে প্রাচীন উদাহরণ। যেমন, প্রায় ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে সান্তোরিনি দ্বীপের ফ্রেস্কো "দ্য স্যাফ্রন গাদারার্স"- চিত্রটিতে ক্রোকাস ফুলের ঘন পাপড়িগুলি জাফরান চাষের ধারণা দেয়।


একই দ্বীপের আরেকটি ফ্রেস্কো চিত্রকর্ম  "দ্য অ্যাডোরেন্টস" এ গাঢ় বেগুনি পাপড়ির উপরে  লম্বা, গাঢ়-লাল কালো ফুল দেখা যায়- যা অনেকটা দেখতে চাষকরা জাফরান গাছের মতো। একই রকম ফুলের চিত্রকর্ম দেখা গেছে, গ্রিসের ব্রোঞ্জ যুগের  সিরামিক এবং কাপড়ের ওপর করা নকশাতে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪ ও ১৫ শতাব্দীতে  ক্রিট থেকে আগত রাষ্ট্রদূতদেরা মিশরের সমাধিগুলোতে শ্রদ্ধা জানাতে জাফরান রঙের তৈরি কাপড় সাথে  এনেছিলেন। 


গবেষকরা মনে করেন বর্তমানের ব্যবহৃত জাফরান ক্রোকাস ফুলের  তিনটি জিনোম প্রাকৃতিকভাবে বন্য জাফরান প্রজাতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে।


ড্রেসডেনের টেকনিশে বিশ্ববিদ্যালয়ের  'প্ল্যান্ট জিনোমিক্স' গ্রুপের প্রধান, ড. টনি হেইটকাম বলেন: "বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের জাফরান ক্রোকাস হচ্ছে প্রাচীন গ্রিসের জাফরান ক্রোকাসের জিনগত প্রজাতি। জিন একই হলেও অঞ্চলভেদে জাফরানের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আমরা অঞ্চলভেদে এই পার্থক্যগুলোর কারণ অনুসন্ধান ও গবেষণা করছি"।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.