‘সম্ভ্রম বাঁচাতে’ ট্যাটু এঁকে যে নারীরা মুখ বিকৃত করেন
ODD বাংলা ডেস্ক: মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে ‘চিন রাজ্য’ অবস্থিত। এখানকার পাহাড়-পর্বতে চিন উপজাতির মানুষের বাস। এদের নাম অনুসারেই মূলত রাজ্যটির এই নামকরণ। বছরে সাতশোর মতো পর্যটক আসে এখানে। কয়েকশ বছর ধরে রাজ্যটির বাসিন্দারা আধুনিক পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্নই ছিলেন বলা যায়। সম্ভ্রম বাঁচাতে এখানকার প্রত্যেক মেয়ের মুখে এঁকে দেয়া হয় ট্যাটু। বিকৃত করে দেয়া হয় তাদের চেহারা।
২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে, প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের বাস চিন রাজ্যে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী চিনদের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি অদ্ভূত প্রথা আছে, যা কিছুটা বর্বরও মনে হতে পারে। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে এই উপজাতির প্রত্যেক মেয়ের মুখে এঁকে দেয়া হয় ট্যাটু। তাদের চেহারা বিকৃত করে দেয়া হয়।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসছে চিনদের এই রীতি। সেখানে গেলে প্রত্যেকটি নারীর মুখেই দেখা মিলবে এই ট্যাটুর। এ নিয়ে উপজাতিটির ৭০ বছরের এক নারী বলেন, আমাদের বয়স যখন আট থেকে নয় হয়, তখন রীতি অনুসারেই আমাদের ট্যাটু করিয়ে দেয়া হয়। এটা একটা প্রাচীন প্রথা। আমার গ্রামের প্রত্যেক মেয়েই তা করেছে।
এর পেছনের কারণটাও বেশ আশ্চর্যজনক। ওই এলাকার প্রাচীন এক রাজার সময় থেকেই শুরু হয় চিনদের ট্যাটু আঁকার চর্চা। এশিয়ার আর পাঁচটি সামন্ত সমাজের মতো এখানকার রাজারাও যখন যে মেয়েকে খুশি সঙ্গী হিসেবে নিতে পারতো। এতে মেয়ের সম্মতি থাকুক, বা না থাকুক। কিন্তু মেয়েটিকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হতো না। রাখা হতো উপপত্মী করে। যখন ইচ্ছে একজনকে ত্যাগ করে আবার নতুন কোনো মেয়েকে সঙ্গী করতো তারা।
কারোরই সাধ্য ছিল না রাজার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার। শেষ পর্যন্ত সম্ভ্রম রক্ষার্থে ট্যাটু এঁকে মুখমণ্ডল বিকৃত করার চর্চা শুরু করে চিন সম্প্রদায়। সবাই জানতো, রাজকীয় শক্তির বিরোধিতা মানেই নির্মম নির্যাতন। আর তাই শেষ পর্যন্ত এই পথ বেছে নেয়া। এতে ট্যাটু শিল্পেও রীতিমতো সৃজনশীল হয়ে ওঠে চিনরা। তখন থেকে মুখে ট্যাটু তাদের সংস্কৃতিরও একটি অংশ হয়ে ওঠে।
বলা হয়ে থাকে, সুন্দরী মেয়েদের রাজ্য হিসেবে খ্যাতি ছিল চিন রাজ্যের। একবার এক বার্মিজ রাজা এই অঞ্চল ভ্রমণে আসেন এবং একটি মেয়েকে উপপত্নী হিসেবে নিজের প্রাসাদে নিয়ে যান। তবে এতে ওই মেয়ে মোটেও খুশি ছিলেন না। এক পর্যায়ে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন তিনি। কিন্তু শঙ্কা আর কাটে না। কখন যেন রাজার লোকেরা আবার ধরে নিয়ে যায় তাকে। আর তখনই ছদ্মবেশ ধারণ করতে ছুরি দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল বিকৃত করে ফেলেন ওই নারী।
মেয়েদের সম্মান রক্ষায় ছোটবেলাতেই তাদের মুখে ওই নকশা করে দিত মা-বাবারা। মধ্যবয়সী এক চিন নারী জানান, ট্যাটু করতে প্রায় পুরো দিনটাই চলে যেত তাদের। এতে ভয়ানক যন্ত্রণাও হতো, বিশেষ করে চোখের পাতায় ট্যাটু করার সময়। শরীরে যে অংশে ট্যাটু আঁকা হয় সেই অংশে লোহার অস্ত্র দিয়ে কেটে তার উপর গরু ছাগল বা ভেড়ার কালো চর্বি লাগানো হয়। একবার ট্যাটু আঁকলে প্রায় ছয় থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়। তারপর আবার, এভাবেই ট্যাটু আঁকা চলতে থাকে মৃত্যু পর্যন্ত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক সময় এই প্রথা পরিণত হয় এক চিত্তাকর্ষক শিল্পে। প্রথমে মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শুরু হলেও পরে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। মুখে অঙ্কিত ট্যাটুই হয়ে উঠল সৌন্দর্যের প্রতীক। আর এটি হয়ে দাঁড়ালো চিন নারীদের গৌরবের বিষয়।
বেশিরভাগ নারীই ট্যাটু আঁকেন মাকড়সার জালের মতো করে। কখনো কখনো পুরুষদের আকৃষ্ট করতেও মুখে আঁকা হয় ট্যাটু। স্থানীয়রা বলে থাকেন, ‘মাকড়সা জাল দিয়ে যেমন পোকামাকড় ধরে থাকে, মাকড়সার জালের মতো ট্যাটু দিয়েও নারীরা পুরুষদের ফাঁদে ফেলে থাকেন।’
চিনদের প্রত্যেকটি এলাকায় আছে আলাদা ধরনের ট্যাটুর নকশা। এজন্য ওই নকশা দেখেই বলে দেয়া যায়, কোন নারী কোন এলাকা থেকে এসেছে। তবে মিয়ানমার সরকারের কোনো অনুমোদন নেই এই রীতিতে। এমনকি এতে কোনো সমর্থনও নেই তাদের।
উনিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত পূর্ণ মাত্রায় প্রচলিত ছিল চিনদের ট্যাটু প্রথা। এরপর থেকেই পদক্ষেপ নেয় দেশটির সরকার। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা এখনো মানতে নারাজ সরকারের সিদ্ধান্ত। মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে কানজুড়ে বিশাল আকৃতির দুল পরেন তারা।
চিন নারীদের ট্যাটু আঁকার ছবি তুলতে রাজ্যজুড়ে ঘুরেছেন আলোকচিত্রী তাহ হান লিন। তিনি বলেন, আমি মিয়ানামার যাওয়ার পর ভাবলাম, সেখানে কোনো আদিম জনগোষ্ঠী থাকলে তাদের সম্পর্কে একটু তথ্য সংগ্রহ করবো। খোঁজ নিয়ে সেখানে চিন জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানতে পারলাম। তারা তাদের নারীদের অপহরণ ঠেকাতে এক অদ্ভুত পদ্ধতি গ্রহণ করেন। শরীরে কালো রঙের ট্যাটু আঁকার রীতিও তাদের মধ্যে একটি। এটি নারীদের জন্য খুবই ভয়ঙ্কর ও যন্ত্রণাদায়ক। ১৯৬০ সাল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও অনেক বৃদ্ধ নারী এই রীতি আজো ধারণ করে আছেন।
নতুন প্রজন্ম অবশ্য দিন দিন বিরক্ত হয়ে উঠছে প্রথাটির প্রতি। নিজেদের সুন্দর মুখমণ্ডল আর বিকৃত করতে চায় না তারা। মিয়ানমারের সামরিক সরকার ট্যাটু আঁকলে তার ওপর জরিমানার বিধানও করেছিল। সেই ভয়েও অনেকে আর ট্যাটু আঁকতে চান না। কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই হয়তো পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে প্রথাটি।
Post a Comment