আটলান্টিকে ভাসছে অভিশপ্ত দ্বীপ, বুনো ঘোড়া ও তিনশো জাহাজের শব নিয়ে

 


ODD বাংলা ডেস্ক: কানাডার নোভা স্কটিয়া প্রদেশের ভূখণ্ড থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দূরে, উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসছে একটি রহস্যময় দ্বীপ (Mysterious Island)। নাম ‘সেবল আইল্যান্ড’। অর্ধচন্দ্রাকৃতি দ্বীপটির আয়তন মাত্র ৩১ বর্গ কিলোমিটার। অভিযাত্রীরা দ্বীপটিকে বলেন ‘আটলান্টিকের সাহারা’ (Atlantic)। কারণ দ্বীপে সবুজের উপস্থিতি নামমাত্র এবং বালি (Sand) জমে তৈরি হওয়া দ্বীপে আছে অজস্র ঢেউ খেলানো বালিয়াড়ি।


‘সেবল’ দ্বীপকে (Mysterious Island) সারা বছর ঘিরে থাকে জমাট কুয়াশা ও মিশকালো মেঘ। প্রতি মুহূর্তে দ্বীপে আঘাত হানে উত্তর আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউ। বছরে কয়েকশোবার আছড়ে পড়ে উন্মত্ত ‘হারিকেন’। দ্বীপের তাপমাত্রা গ্রীষ্মে উঠে যায় কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। শীতে নেমে যায় মাইনাস উনিশ ডিগ্রিতে। 


মানচিত্রে সেবল দ্বীপ


অভিশপ্ত দ্বীপ ‘সেবল’ (Mysterious Island)


‘সেবল’ দ্বীপের নাম শুনলে আজও আঁতকে ওঠেন, আটলান্টিক পারাপার করা জাহাজগুলির পোড়খাওয়া ক্যাপ্টেন ও নাবিকের দল। দ্বীপটিকে তাঁরা বলেন ‘আটলান্টিকের কবরখানা’। কারণ ছোট্ট দ্বীপটিকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় তিনশো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। নাবিকদের মাধ্যমে জাহাজ থেকে জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে কিছু ভয়াল ভয়ঙ্কর কাহিনি। যে কাহিনিগুলি তাঁরা শুনেছিলেন কোনও নাবিকের মুখ থেকেই।


কিন্তু মৃত্যুর ছায়া ঘেরা এই অভিশপ্ত ‘সেবল’ দ্বীপে (Mysterious Island), আজও বাস করে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বুনো ঘোড়া। মনে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে সমুদ্র ঘেরা দ্বীপে এসে উঠেছিল ঘোড়াগুলি! কেন দ্বীপকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত জাহাজের মৃতদেহ! কী ভয়াবহ কাহিনি শোনান আটলান্টিকের নাবিকেরা! এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে।


আটলান্টিকে ভাসছে এই রহস্যময় দ্বীপ


দ্বীপে (Mysterious Island) পা রেখেছিল মানুষ


নির্জন এই দ্বীপে প্রথম পা রেখেছিলেন পর্তুগিজ অভিযাত্রী জোয়াও ফাগুনডেস। ১৫২০ সালে দ্বীপে কাটিয়ে ছিলেন কয়েক সপ্তাহ। দ্বীপটির নাম রেখেছিলেন ‘ফাগুনডা’। কিন্তু প্রবল হাওয়া ও উড়তে থাকা বালির হামলায় দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৫৯৮ সালে দ্বীপে আবার নেমেছিল মানুষ। সে বছর ফ্রান্সে হয়েছিল সেনাবিদ্রোহ। প্রায় চারশো বিদ্রোহী সেনাকে বন্দি করে জাহাজে তুলে দিয়েছিলেন ফরাসি ভাইসরয় ট্রোইলাস মেসকুয়েজ ।


কয়েক মাস পর জাহাজটি নোঙর করেছিল ফ্রান্স থেকে ৩১৭৫ নটিকাল মাইল দূরে থাকা এই নির্জন দ্বীপে (Mysterious Island)। বালি বা সেবলের তৈরি দ্বীপটির নাম ফরাসিরা দিয়েছিল ‘আইল ডি সেবল’। চারশো বন্দি ও তাদের তিন মাসের খাবার দ্বীপে নামিয়ে, ফিরে গিয়েছিল জাহাজ। কথা দিয়েছিল তিন মাস পরে আবার এসে দিয়ে যাবে জ্বালানি ও খাবার।


দ্বীপে শুরু হয়েছিল বাঁচার লড়াই


মাথার ওপর ছিল না ছাদ। ছিল না শীতবস্ত্র ও বাঁচার অনান্য আবশ্যকীয় উপকরণ। দ্বীপ (Mysterious Island) ছেড়ে পালাবারও উপায় ছিল না। কারণ দ্বীপে ছিল না একটিও গাছ। যা দিয়ে বানানো যাবে ভেলা। তাই ঝোড়ো হাওয়া, জমাট কুয়াশা ও উড়তে থাকা বালিকে সঙ্গী করে, কয়েকশো সেনা শুরু করেছিল বাঁচার লড়াই। দ্বীপের দক্ষিণ দিকে তারা খুঁজে পেয়েছিল বেশ কিছু মিষ্টি জলের পুকুর। যেগুলি ধরে রেখেছিল বৃষ্টির জল। সেই পুকুরগুলির পাড়ের বালিতে গর্ত করে, তারই মধ্যে বাস করতে শুরু করেছিল হতভাগ্যের দল।


তিন মাস পর ফুরিয়ে গিয়েছিল খাবার। এসে গিয়েছিল হাড়কাঁপানো শীত। জমে গিয়েছিল সমুদ্র। দ্বীপের বালি চাপা পড়ে গিয়েছিল তিনফুট পুরু বরফের তলায়। শুরু হয়েছিল দ্বীপবাসীদের অনাহার। বাধ্য হয়ে সিল শিকার করে, প্রাণীগুলির মাংস কাঁচা খেতে শুরু করেছিল দ্বীপবাসীরা। ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল সিলের রক্তমাখা চামড়া।


কিন্তু ভাগ্য সবার সহায় ছিল না


ডিসেম্বর মাসে শুরু হয়েছিল ভয়াবহ তুষারঝড়। তাণ্ডব চালিয়েছিল প্রায় একমাস ধরে। কয়েক মাস পরে শীত চলে গিয়ে এসেছিল গ্রীষ্ম। গলে গিয়েছিল বরফ। বালির বুকে গজিয়েছিল সবুজ ঘাস। কিন্তু তারই আগেই চিরতরে দ্বীপ ছেড়েছিল শতাধিক সেনা। গলে যাওয়া বরফের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেনাদের জমে কাঠ হওয়া মৃতদেহ। বালি খুঁড়ে সহযোদ্ধাদের সমাহিত করেছিল তখনও বেঁচে থাকা সেনারা।


সারাদিন ধরে দ্বীপবাসীরা তাকিয়ে থাকত সমুদ্রের দিকে। যদি ফিরে আসে দেশের জাহাজ। হ্যাঁ, ফিরে এসেছিল জাহাজ। কিন্তু পাঁচ বছর পর। দ্বীপে নেমে নাবিকেরা দেখতে পেয়েছিল, নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে থাকা বারো জন উন্মাদ মানুষকে। গায়ে সিলের চামড়া, মাথায় বড় বড় চুল, মুখে লম্বা দাড়ি। চারশো জন বিদ্রোহী সেনার মধ্যে বেঁচে থাকা বারো জনকে নিয়ে জাহাজ ভেসেছিল ফ্রান্সের পথে। জনমানবশূন্য হয়ে গিয়েছিল রহস্যময় দ্বীপ (mysterious island) সেবল।


আটলান্টিকের কবরখানা ‘সেবল’


ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ এইচএমএস ডিলাইট, আটলান্টিক অভিযান সেরে দেশে ফিরছিল ১৫৮৩ সালে। জাহাজে ছিলেন একশো জন নাবিক ও ক্যাপ্টেন। কুয়াশাচ্ছন্ন সেবল দ্বীপের (mysterious island) এক কিলোমিটার দূর দিয়ে যাওয়ার সময়, প্রচণ্ড শক্তিশালী স্রোত দ্বীপের দিকে ঠেলতে শুরু করেছিল জাহাজটিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজটিকে বন্দি করেছিল জলের নিচে ডুবে থাকা বালির চর। সেই রাতেই জাহাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ‘হারিকেন’ ও তিরিশ ফুট উচ্চতার ঢেউ।


ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল এইচএমএস ডিলাইট। সলিল সমাধি হয়েছিল পঁচাশি জন নাবিকের। মাত্র ষোল জন উঠতে পেরেছিলেন লাইফবোটে। সাতদিন আটলান্টিকে ভাসার পর, নাবিকদের উদ্ধার করেছিল তিমি শিকার করতে বেরোনো এক জাহাজ। সেই শুরু।


এরপর সেবল দ্বীপের করাল গ্রাসের শিকার হয়েছিল, ঘন কুয়াশায় দিকভ্রষ্ট হওয়া তিনশো জাহাজ। প্রতিটি জাহাজই তীব্র স্রোতের কারণে আটকে গিয়েছিল ডুবে থাকা বালির চড়ায়। প্রবল ঝড় ও উন্মত্ত ঢেউ এসে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল জাহাজগুলিকে। সেবল দ্বীপের সৈকতকে ভাঙা টুকরোগুলি উপহার দিয়েছিল আটলান্টিকের ঢেউ। জাহাজডুবিতে প্রাণ হারিয়ে ছিলেন শত শত নাবিক ও যাত্রী।


জাহাজডুবির সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায়, সেবল দ্বীপে ডেরা বেঁধেছিল জলদস্যুদের দল। সারা বছর তারা লুকিয়ে থাকত বালিয়াড়িগুলির পিছনে। জাহাজডুবির পর লাইফ বোটে করে বা কোনও মতে সাঁতরে দ্বীপে ওঠা অসহায় নাবিক ও যাত্রীদের ওপর জলদস্যুরা চালাত লুঠতরাজ। নারী ও শিশুদেরও হত্যা করতেও হাত কাঁপত না তাদের। 


নোভা স্কটিয়ার গভর্নর জন ওয়েন্টওয়ার্থ, ১৮০১ সালে দ্বীপ থেকে তাড়িয়ে ছিলেন জলদস্যুদের। ডুবতে বসা জাহাজের যাত্রীদের জন্য দ্বীপে রেখে দিয়েছিলেন একটি উদ্ধারকারী দল। আনা হয়েছিল লাইফ-বোট। বানানো হয়েছিল বাঙ্কার ও লাইটহাউস। ডুবে থাকা চড়াগুলির মানচিত্র বানিয়ে দেওয়ায় কমতে শুরু করেছিল জাহাজডুবির সংখ্যা। কিন্তু ততদিনে সেবল দ্বীপ হয়ে উঠেছিল অভিশপ্ত। আটলান্টিকের কবরখানাকে ঘিরে পল্লবিত হয়েছিল নানা রোমহর্ষক কাহিনি। 


 সেবল দ্বীপে ছড়িয়ে আছে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ


ছড়িয়ে গিয়েছিল এই মর্মান্তিক কাহিনিটিও


সামুদ্রিক ঝড় থেকে বাঁচতে একবার সেবল দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন কিছু নাবিক। কোনও এক চাঁদনি রাতে সমুদ্র সৈকতে পায়চারি করছিলেন তাঁরা। হঠাৎ কানে এসেছিল এক নারীর গগনভেদী আর্তনাদ। ছুটে গিয়েছিলেন নাবিকেরা। দেখা পেয়েছিলেন সাদা গাউন পরা এক যুবতীর। পাগলের মত সমুদ্র সৈকতে কিছু একটা খুঁজছিলেন যুবতী।


পুর্ণিমার চাঁদকে ঘিরে ফেলছিল মেঘ। আধো আলো আধো অন্ধকারে নাবিকেরা যুবতীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কে আপনি? কী খুঁজছেন এখানে?” ভয়ার্ত কণ্ঠে যুবতীটি বলেছিলেন, “ওরা আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। আমার আঙুল কেটে নিয়েছে। সেই আঙুলে ছিল আমার বিয়ের আঙটি। সেই আঙুলটা খুঁজছি আমি।” এরপর নাবিকেরা কিছু বলার আগেই তীব্র বেগে সমুদ্রের দিকে ছুটতে শুরু করেছিলেন যুবতী। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সমুদ্রের জলে। উত্তাল ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যুবতীটিকে।


পরে নাবিকেরা জেনেছিলেন, শুধু তাঁরাই নন, এই যুবতীকে দেখেছেন অনেক নাবিকই। জলদস্যুরা বহু নিরীহ যাত্রীকে হত্যা করেছিল এই দ্বীপে। যুবতীর স্বামীও হয়ত ছিলেন সেই দলে। নিজের চোখে স্বামীর মৃত্যু দেখে মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিলেন সদ্যবিবাহিতা যুবতী। আত্মাহুতি দিয়েছিলেন আটলান্টিকের নীল জলে। সেই থেকে যুবতীর দুঃখী আত্মা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘সেবল’ দ্বীপের সৈকতে (Mysterious Island)। যদি খুঁজে পাওয়া যায় প্রিয়তমের পরিয়ে দেওয়া বিয়ের আঙটি।


আজও নাকি দেখা যায় সেই যুবতীকে


দ্বীপে এসেছিল ঘোড়ার পাল

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে পূর্ব কানাডার আকাডিয়াতে ছিল ফরাসি কলোনি। প্রায় ১৪০০০ ফরাসি বংশদ্ভুত মানুষ বাস করত সেই কলোনিতে। ১৭৫৫ সালে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে। যুদ্ধের আঁচ লেগেছিল আকাডিয়ার গায়েও। আকাডিয়া ছাড়তে হয়েছিল ১১০০০ ফরাসি। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি, অনাহার, অসুখ ও জাহাজডুবিতে প্রাণ হারিয়েছিল ৫০০০ নরনারী। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল আকাডিয়দের ঘর বাড়ি। লুঠ করে নেওয়া হয়েছিল সম্পত্তি, গবাদিপশু ও ঘোড়া।


জাহাজে করে ঘোড়াগুলিকে পাচার করে দেওয়া হচ্ছিল ইউরোপে। অস্বাস্থ্যকর জাহাজের খোলে রাখায়, প্রাণ হারাচ্ছিল শয়ে শয়ে ঘোড়া। খবর পেয়ে মাঝ সমুদ্রে হানা দিয়েছিলেন বস্টনের যাজক রেভারেন্ড অ্যান্ড্রু মারসা। মৃতপ্রায় ঘোড়াগুলিকে উদ্ধার করে, ছেড়ে দিয়েছিলেন সেবল দ্বীপে (Mysterious Island)। এছাড়াও পাচারকারীদের কাছ থেকে কিছু ঘোড়া কিনে নিয়েছিলেন, বস্টনের জাহাজ ব্যবসায়ী থমাস হ্যানকক। কিনে নেওয়া ঘোড়াগুলিকে তিনিও ছেড়ে দিয়েছিলেন সেবল দ্বীপে। বালির ওপর গজিয়ে ওঠা কচি ঘাস, বুনো মটর ও পুকুরগুলির মিষ্টি জল পেয়ে বাড়তে শুরু করেছিল সেবল দ্বীপের ঘোড়াদের সংখ্যা।


দ্বীপের ঘোড়াদের সবথেকে পুরোনো ছবি

সেবল দ্বীপে ১৮০১ সাল থেকে সেবল দ্বীপে (Mysterious Island) পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেছিল একটি উদ্ধারকারী দল। কিছু বুনো ঘোড়াকে পোষ মানাতে চেয়েছিলেন দলটির সদস্যরা। দ্বীপের এদিক ওদিক যাওয়া, জাহাজের ভাঙা টুকরো ও লাইফবোট বওয়ার জন্য। কিন্তু ততদিনে ঘোড়াগুলি পেয়েছিল মুক্তির স্বাদ। তাই হতে চায়নি মানুষের ক্রীতদাস। বাধ্য হয়ে উদ্ধারকারী দলের জন্য ফ্রান্সের ব্রেটন ও আন্দোলুসিয়া থেকে আনা হয়েছিল পোষ মানা ঘোড়া।


দিনের বেশিরভাগ সময় পোষ মানা ঘোড়াগুলি চরে বেড়াত দ্বীপের আনাচে কানাচে। একসময় বুনো ঘোড়াদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল পোষ মানা ঘোড়াদের। বুনো ঘোড়ারা পোষ মানা ঘোড়াদের মগজে গেঁথে দিয়েছিল বিপ্লবের বীজ। দড়ি ছিঁড়ে পোষ মানা ঘোড়াগুলি একদিন মিশে গিয়েছিল বুনো ঘোড়াদের দলে।


সেবল দ্বীপের বুনো ঘোড়া

১৮৭৯ সালে সেবল দ্বীপে বাস করত প্রায় চারশো বুনো ঘোড়া। দ্বীপকে সবুজ করার জন্য নোভা স্কটিয়া সরকার ১৯০১ সালে লাগিয়েছিল ৮০০০০ টি চারা গাছ। কিন্তু দ্বীপের চরম আবহাওয়ায় বাঁচেনি একটি গাছও। এরপরও বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সবুজ হতে চায়নি অভিশপ্ত দ্বীপ ‘সেবল’।


নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল সেবল দ্বীপের বুনো ঘোড়া

একদল অসাধু ব্যবসায়ী, ১৯৫০ সাল নাগাদ বুনো ঘোড়াগুলিকে পাচার করতে শুরু করেছিল কানাডার বিভিন্ন কসাইখানায়। গৃহপালিত কুকুরদের রসনা তৃপ্ত করার জন্য। এছাড়াও প্রচুর ঘোড়া পাচার করা হয়েছিল নোভা স্কটিয়ার কয়লা খনিতে। দ্বীপে ঘোড়ার সংখ্যা কমে হয়েছিল মাত্র ১৪৭। 


অবলা প্রাণীগুলির ওপর নির্মম অত্যাচারের কথা শুনে, ষাটের দশকে ফুঁসে উঠেছিল কানাডার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। বিক্ষোভ দেখিয়েছিল রাস্তায় নেমে। নড়ে চড়ে বসেছিল সরকার। ঘোড়া পাচার করার ওপরে জারি করা হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, দ্বীপে বাইরের মানুষের প্রবেশ। ২০১৩ সালে সেবল দ্বীপ হয়েছিল জাতীয় উদ্যান। অস্তিত্বের চরম সংকট থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিল সেবল দ্বীপের বুনো ঘোড়ারা। 


কসাইখানায় সেবল দ্বীপের বুনো ঘোড়ারা

আজ সেবল দ্বীপে রাজত্ব করে ৪৪ টি পালে থাকা প্রায় ৫৬০ টি বুনো ঘোড়া। উদ্দাম গতিতে ছুটে বেড়ায় দ্বীপের এদিক থেকে ওদিক। প্রত্যেকটি পালকে নিরাপত্তা দেয় এক শক্তিশালী ও নবীন পুরুষ ঘোড়া। কিন্তু নেতৃত্ব দেয় কোনও বয়স্ক পুরুষ ঘোড়া। জায়গা দখলের জন্য পালগুলির মধ্যে সারাবছর রেষারেষি থাকলেও, শীতকালে একটু উষ্ণতার জন্য ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে ঘোড়াগুলি। কয়েকমাসের জন্য ভুলে যায় সব অভিমান।


কিন্তু আর মাত্র কয়েক দশক

কানাডার আবহাওয়া দফতরের কয়েকজন বিজ্ঞানী সারা বছর থাকেন সেবল দ্বীপে। তাঁরা দ্বীপের ঘোড়াগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত। প্রতিবছরই অস্বাভাবিক ঠাণ্ডায়, খাদ্যের অভাবে এবং প্রচুর পরিমাণে বালি খেয়ে মারা যায় বেশ কিছু ঘোড়া। এছাড়াও বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পাল্টে গিয়েছে দ্বীপের আবহাওয়া। বালির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে দ্বীপের সবচেয়ে বড় মিষ্টি জলের হ্রদ ‘ওয়ালেস’। দ্বীপে দেখা দিয়েছে তীব্র জলাভাব। ঘোড়াদের শরীরে দেখা দিচ্ছে কৃমি ঘটিত নানান রোগ। আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করেছে ঘোড়াগুলির বংশবৃদ্ধির হার। 


প্রবল শীতে ঘাস খুঁজছে বুনো ঘোড়া

দ্বীপে থাকা বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাদ্যাভাব, জলকষ্ট ও রোগগুলি হয়ত থেকে সেবল দ্বীপের বুনো ঘোড়াদের বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু পরাধীনতার শিকল থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। কারণ বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলেই বাড়তে শুরু করেছে আটলান্টিকের জলস্তর। ডুবতে শুরু করেছে সেবল দ্বীপ। আর মাত্র কয়েক দশক। তারপর চিরতরে আটলান্টিকের অতলে তলিয়ে যাবে অভিশপ্ত দ্বীপ ‘সেবল’। তার করাল গ্রাসে আটকে পড়া জাহাজগুলির মতই। সেবল দ্বীপের নিরাপদ আশ্রয় হারাবে স্বাধীনচেতা বুনো ঘোড়াগুলি। প্রায় তিন শতাব্দী ধরে স্বাধীন থাকার পর, তাদের আবার মুখে পরানো হবে লাগাম। শরীরগুলি আবার রক্তাক্ত হবে পরাধীনতার চাবুকের আঘাতে।  

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.