‘সুপারহিরো আইডিয়াল’: সেরা হতে হবে এই চাপ শিশুদের ক্ষতি করছে

 


ODD বাংলা ডেস্ক: সেরা হতে হবে পড়াশোনায়, খেলাধুলায় চাই দক্ষতা, পোশাকে আর চেহারায় থাকবে ব্যক্তিত্ব। শিশু-কিশোরদের প্রতি অভিভাবকদের এ চাহিদার শেষ নেই যেন। পারিপার্শ্বিক প্রতিযোগিতার এই চাপকে তাদের অনেকেই জীবনের অংশ হিসেবে মেনেও নিচ্ছে। কিন্তু, মানুষ 'সুপারম্যান' হয় না, সবকিছুতে সবাই সেরাও নয়। তাই অবধারিতভাবেই কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, গভীর বিষণ্ণতার মতো মানসিক সমস্যার মুখে ঠেলে দিচ্ছে শিশুদের। 


এতে মানসিকভাবে সবচেয়ে ভেঙ্গে পড়ছে ১০-১৯ এর মাঝামাঝি বয়সীরা, যাদের বলা হয় অ্যাডলেসেন্ট। এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যুঝতে হচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব তাদের শারীরিক সুস্থতার ওপরও পড়ছে। বর্তমান সময়েই এসব সমস্যা সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নিয়েছে। গেল বছর বিষণ্ণতার পর্ব কিশোরকিশোরীদের মধ্যে ছিল প্রায় ১৩.২ শতাংশ।


গবেষকরা এজন্য মহামারিকেও অনেকাংশে দায়ি করেছেন। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য আরও গুরুতর হুমকির মধ্যে পড়েছে।


মহামারির বড় সময় ধরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বন্ধ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলাধুলার সুযোগসুবিধা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-প্রতিযোগিতার আয়োজন। এই অচলাবস্থা সেরা হতে চাওয়া টিনএজারদের হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। যদিও শুধু মহামারির কারণেই নয়, সাধারণ সময়েও এমন লক্ষ্য, বিষাদের জন্ম দিয়ে থাকে।


চমকপ্রদ এক নতুন গবেষণার ভিত্তিতে এমন তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণা নিবন্ধের লেখকরা জানিয়েছেন, "অ্যাডলেসেন্টদের কোন অনুঘটকগুলি বিষাদগ্রস্ত করছে- তা জরুরিভিত্তিতে জানার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।"


টিনএজারদের মতামত নেওয়া হয় এ মনোবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে। যাদের অধিকাংশই শিক্ষায় ভালো গ্রেড, সবার মধ্যে জনপ্রিয় বা আকর্ষণীয় হওয়ার মতো একাধিক ক্ষেত্রে সেরা হওয়ার দৌড়ে- প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকার কথা উল্লেখ করেছে। পাশাপাশি তারা রয়েছে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস রপ্তের ঝুঁকিতে।


গবেষণার বিষয়ে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মনোবিজ্ঞানী ক্যাথারিন স্টেইনার ও অ্যাডেইর প্রথম এটির নাম নাম দেন 'সুপারওম্যান আইডিয়াল'। পরবর্তীতে আমেরিকার ওয়েলসলে কলেজের সহযোগী অধ্যাপক স্যালি এ. থেরান এটির নাম সামান্য বদলে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ করে দেন 'সুপারহিরো আইডিয়াল'।


গবেষণায় দেখা গেছে, সুপারহিরো আইডিয়ালে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা কিশোর-কিশোরীদের খাদ্যাভ্যাসে সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে ব্যাঘাতের এই লক্ষণ নিয়ে পূর্বাপর গবেষণাও হয়নি তেমন, যাকে বলা হচ্ছে 'ইন্টারনালাইজিং ডিজঅর্ডার'।


অর্থাৎ, সেরা হওয়ার তাগিদের কারণে সঠিক সময়ে খাদ্য গ্রহণ, নিদ্রা ইত্যাদির সমস্যা স্পষ্ট প্রকাশ পায়।


'অক্টা সাইকোলজিয়া' নামক এক মনোবৈজ্ঞানিক জার্নালে 'সুপারহিরো আইডিয়াল, অথেনটিসিটি ইন রিলেশনশিপস অ্যান্ড ডিপ্রেসিভ সিম্পটমস: অ্যা মাল্টিপল মেডিয়েশন এনালাইসিস" শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।


নিবন্ধের সহ-লেখক মনোবিজ্ঞানী স্যালি এ. থেরান ও হালিনা ডৌর 'ইন্টারনালাইজিং ডিজঅর্ডার'- এর সাথে সুপারহিরো আইডিয়ালের সরাসরি যোগসূত্র এবং সেকারণে বিষণ্ণতার পর্ব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আবিষ্কার করেছেন।


গবেষণার অধ্যয়নে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের সপ্তম ও অস্টম গ্রেডের ১৬৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। তাদের মধ্যে পুরুষ ও নারীর অনুপাত ছিল যথাক্রমে- ৪৬ ও ৫৪ শতাংশ।


অংশগ্রহণকারীদের বয়স ছিল ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে, তাদের বেশিরভাগ ছিল ককেশীয়/ শ্বেতাঙ্গ (৮৪ শতাংশ), আফ্রিকান-আমেরিকান (১ শতাংশ), লাতিন আমেরিকান (৩ শতাংশ), এশীয় (৮ শতাংশ), আমেরিকার আদি জনগোষ্ঠী (১ শতাংশ) এবং সংকর জাতির (১ শতাংশ)।


গবেষণা অনুসারে, "অকৃত্রিম ও সুস্থ সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে" এই টিনএজাররা বিষন্নতার লক্ষণগুলি থেকে মুক্তিও পেতে পারে।


গবেষক থেরান বলেছেন, "অভিষ্ট লক্ষ্যের ব্যাপারে বাড়তি চাপ না নিতে আমরা যতই নিরুৎসাহিত করি না কেন, কিশোররা কিন্তু এরমধ্যেই প্রতিযোগিতাকে নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করে ফেলেছে। আর সেজন্য তারা চাপের মধ্যেও থাকে।"


যেমন এ বয়সের অনেক শিক্ষার্থী মনে করে, কল্পিত সুপারহিরোদের মতোই তাদের সব দিকে সেরা হতে হবে। দৈনন্দিন পড়াশোনা, খেলাধুলা ও সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে তারা এজন্য বেশি সফল হওয়ার চেষ্টায় মাতে।


ক্ষতিকর এ ইঁদুর দৌড়কে নিরুৎসাহিত করতে সহপাঠী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সাথে সহযোগিতার সম্পর্কে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী থেরান ও ডৌর। এক্ষেত্রে 'অকৃত্রিম সম্পর্ক' তারা বলেছেন, মন খুলে নিজের ভাব প্রকাশ করাকে।


তবে তারা এও বলেছেন, অভিভাবক, শিক্ষক ও সহপাঠিদের ক্ষেত্রে অকৃত্রিম সম্পর্ক আলাদা আলাদা হতেই পারে। তবে অবশ্যই টিনএজারদের মনোভাব প্রকাশের বিষয়ে নিজের কাছে সৎ থাকতে হবে।


কীভাবে নিজের কাছে সৎ থাকা যায়- তার ব্যাখ্যায় থেরান জানান, ওই শিক্ষার্থী নিজেকে কিছু প্রশ্ন করতে পারে। যেমন সে আত্মঃঅনুসন্ধান করতে পারে যে সত্যিই আমি এই প্রতিযোগিতায় সেরা হতে চাই কিনা? বা এটি আমার ভালো লাগে কিনা? সত্যিই কী আমি অমুক সহপাঠীর বন্ধুত্ব চাই? সে কি আমার কাঙ্ক্ষিত?- ইত্যাদি।


গবেষকরা দেখেছেন, নিজের ও অন্যের কাছে সৎ থাকা শিক্ষার্থীরা অকৃত্রিম সম্পর্ক স্থাপনেও এগিয়ে। এবং তারা সুপারহিরো আইডিয়ালের মতো বিষণ্ণতার জন্য দায়ী সমস্যাকে এড়িয়ে চলতে বা কাটিয়েও উঠতে পারছে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.