পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া ৫ অদ্ভুত এয়ারলাইনস!



 ODD বাংলা ডেস্ক: সত্তরের দশকের শেষদিকে দেশের বিমান শিল্প খাতকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে মার্কিন সরকার। বিমান ভাড়া, রুট পরিচালনা এবং নতুন বিমান বাজারে নিয়ে আসার ব্যাপারেও ফেডারেল নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে আশির দশকের শুরু থেকেই বাজারে আসতে থাকে একের পর এক নতুন এয়ারলাইনস। কিন্তু যাত্রী পরিবহণের পাশাপাশি কিছু এয়ারলাইনস বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকেই ছিল অদ্ভুত। যেন হুট করে নিজের খেয়াল-খুশিমতো একটা ব্যবসা খুলে বসেছেন মালিকেরা! চলুন জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের তেমনই কয়েকটি অদ্ভুত এয়ারলাইনের গল্প।


১. পেট এয়ারওয়েজ


শুধু মানুষই দিব্যি আরাম-আয়েশ করে বিমানে চড়বে, আর প্রিয় পোষা প্রাণীটি পড়ে থাকবে অবহেলায়? এমনটা একেবারে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে পশ্চিমাদের কাছে। তাইতো প্রিয় পোষা প্রাণীদের সেবায় বিশেষভাবে চালু করা হয়েছিল 'পেট এয়ারওয়েজ'। ২০০৯ সালে ফ্লোরিডার ডেলরে বিচে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।


কুকুর বা বিড়ালসহ বিভিন্ন পোষা প্রাণী তাদের মালিকদের ছাড়াই এই এয়ারওয়েজের বিমানে চড়তে পারতো। আর তাদের জন্য যেসব কেবিন বরাদ্দ ছিল, তাতে আসনের বদলে থাকতো ক্যারিয়ার! প্রতিটি বিমানে ৫০টি করে পোষা প্রাণী বহন করা যেতো। শুধু তাই নয়, ১৫ মিনিট পর পর এসে 'পেট অ্যাটেন্ডেন্ট'রা পরীক্ষা করে যেতেন প্রাণীদের। বিমান টেক-অফের আগে তাদেরকে প্রি-ফ্লাইট ওয়াক করানো হতো এবং এয়ারপোর্ট লাউঞ্জেই ছিল তাদের জন্য বিশেষ 'বাথরুম বিরতি'।


যাত্রীরা নিজেদের সাথে একই বিমানের কার্গো হোল্ডে করে প্রিয় পোষা প্রাণীদের নিয়ে যাবেন, নাকি তাদের আলাদা করে সুন্দর পরিবেশে গন্তব্যে নিয়ে যাবেন- এর মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দেয় পেট এয়ারওয়েজ। কার্গোতে করে প্রাণী আনা-নেওয়াকে একটি ক্ষতিকর প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যা দেয় এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ, যেখানে কিনা তাপমাত্রার ওঠানামা এবং যথাযথ আলো-বাতাসের অভাবে প্রাণীদের ক্ষতি হতে পারে।


পেট এয়ারওয়েজ চালু হওয়ার পর দুই বছর তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। নিউইয়র্ক, শিকাগো ও আটলান্টাসহ বেশকিছু শহরে প্রাণীদের পরিবহনের কাজটি করে তারা। সে সময় প্রাণীদের বিমানভাড়া ছিল ১৫০ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ১২০০ ডলার পর্যন্ত। প্রাণীর আকৃতির উপর ভিত্তি করে এই ভাড়া নির্ধারণ করা হতো।


কিন্তু ২০১২ সালে কিছু আর্থিক সমস্যার মুখে পড়ে পেট এয়ারওয়েজ এবং ফ্লাইট বাতিল করতে শুরু করে। প্রায় ৯০০০ প্রাণীকে পরিবহনের পর অবশেষে ২০১৩ সালে বন্ধ হয়ে যায় পেট এয়ারওয়েজ। তবে সুখবর হলো, প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটটি এখনো সক্রিয় রয়েছে এবং তাতে লেখা '২০২২ এর মাঝামাঝিতে আবারও চালু হবে ফ্লাইট।' কে জানে, হয়তো দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে আগের চাইতেও বেশি সফলতা পাবে পেট এয়ারওয়েজ।


২. হুটারস এয়ার


২০০২ সালে রেস্টুরেন্ট চেইন 'হুটারস' এর চেয়ারম্যান রবার্ট ব্রুকস ৮টি বিমানবহর সম্বলিত পেস এয়ারলাইনস কিনে নেন। এর মধ্যে বেশিরভাগ বিমানই ছিল বোয়িং ৭৩৭। পরের বছর নাম পাল্টে এটি হয়ে যায় 'হুটারস এয়ার'।


এই এয়ারওয়েজের প্রধান আকর্ষণ ছিল এর চোখ ধাঁধানো কমলারঙা ডিজাইন, তার মধ্যে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকা প্যাচা! বিমানের ভেতরে দুজন তথাকথিত 'হুটারস গার্লস' থাকতো, যারা যাত্রীদের সাথে কথাবার্তা বলতো, আড্ডা দিত এবং পুরস্কারসহ নানা গেমসের আয়োজন করতো। তাদের পরনেও থাকতো একই কমলা রঙ এর ট্যাংক টপ এবং শর্টস, যা হুটারস রেস্টুরেন্টের কর্মীরাও পরেন।


তবে বিমানের ভেতরে খাবার পরিবেশন বা অন্যান্য সেবার কাজ এই হুটারস গার্লসরা করতেন না। তার জন্য আলাদাভাবে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টস ছিল। কম বাজেটে ভ্রমণের সুবিধা থাকায় এবং আটলান্টা, নিওয়ার্ক এবং বাল্টিমোরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় সব ধরনের যাত্রীদের কাছেই প্রিয় হয়ে ওঠে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ার মার্টল বিচভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি। তবে কখনোই খুব ব্যবসাসফল হতে পারেনি হুটারস এয়ার। ক্যাটরিনা এবং রিটা হ্যারিকেন ঝড়ের পর জ্বালানি তেলের দাম অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হয় হুটারস এয়ারকে।


৩. দ্য লর্ড'স এয়ারলাইন


ভ্রমণের সময় অ্যালকোহল নিষিদ্ধ, ম্যাগাজিনের পরিবর্তে বাইবেল-তোরাহ, শুধুমাত্র ধর্মীয় চলচ্চিত্র সম্প্রচার এবং বিমানভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয়ের চার ভাগের এক ভাগ ব্যয় হবে মিশনারি কাজে- এমনই একগুচ্ছ নতুন ও অদ্ভুত নিয়ম নিয়ে মাঠে নামে দ্য লর্ড'স এয়ারলাইন। নিউজার্সির ব্যবসায়ী এরি মার্শাল ১৯৮৫ সালে এই এয়ারলাইন প্রতিষ্ঠা করেন।


তাদের পরিকল্পনা ছিল মায়ামি থেকে ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর পর্যন্ত সপ্তাহে ৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করা এবং ৩০ মাইল দূরে অবস্থিত জেরুজালেমে যাওয়ার একটি সরাসরি রুট বাতলে দেওয়া।


সেসময় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের এই পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে যেতে নিউইয়র্ক হয়ে যেতে হতো। মার্শাল ১৯৮৬ সালে বলেন, 'রাশিয়ানদের নিজস্ব এয়ারলাইন আছে, ব্রিটিশদেরও আছে, তাহলে আমাদের কেন নয়?"


কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ১৯৮৭ সালের দিকে লর্ড'স এয়ারলাইন এফএফএ লাইসেন্সের যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে বিনিয়োগকারীরা মার্শালের উপর রুষ্ট হয়ে তাকে সরিয়ে দেন পরিচালনা পর্ষদ থেকে এবং এয়ারলাইনও একসময় বাতিল ঘোষণা করা হয়।


৪. স্মোকারস এক্সপ্রেস অ্যান্ড স্মিন্টএয়ার


১৯৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের ডমেস্টিক ফ্লাইটে ধুমপান নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ফ্লোরিডার দুই উদ্যোক্তা উইলিয়াম ওয়াল্টস এবং জর্জ রিচার্ডসন এ সিদ্ধান্তে খুশি ছিলেন না। ১৯৯৩ সালের শুরুর দিকে তারা এমন একটি এয়ারলাইন বানানোর সিদ্ধান্ত নেন যেখানে এই নিয়ম থাকবে না। এই এয়ারলাইনের সেবা পেতে চাইলে ২৫ ডলার দিয়ে এর সদস্য হতে হতো এবং মাত্র ২১ জন মানুষ এটি ব্যবহার করতে পারতো।


ফ্লোরিডার টিটুসভিলে স্পেস কোস্ট আঞ্চলিক বিমানবন্দরে এই এয়ারলাইনের ঘাটি হওয়ার কথা ছিল। বলা হয়েছিল, বিমানে ওঠার সময় যাত্রীদের বিনামূল্যে স্টেক-বার্গার ও সিগারেট দেওয়া হবে!

কিন্তু ঘোষণা দেওয়ার বছরখানেক পরেও এয়ারলাইন চালু হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না; যদিও প্রতিষ্ঠাতাদের দাবি- তাদের রয়েছে পাচ হাজারেরও বেশি মেম্বারশিপ। কিন্তু তাদেরকে লাইসেন্স দিতে অস্বীকৃতি জানান নিয়ন্ত্রকেরা। ফলে রাতারাতি হাওয়ার মিশে যাওয়ার মতো করেই মুছে যায় স্মোকারস এক্সপ্রেসের অস্তিত্ব।


তবে ২০০৬ সালে জার্মান উদ্যোক্তা আলেক্সান্ডার শুপমান এই ধারণাটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। দিনে ৩০টি সিগারেট খেতেন এই শুপমান। তাই তিনি যে স্মোকারস এক্সপ্রেসের মতো এয়ারলাইন চাইবেন তাতে আর অবাক হওয়ার কি! টোকিও ও ডুসেলডর্ফের মধ্যে 'স্মিন্টএয়ার' নামক একটি ডেইলি সার্ভিস চালু করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুটি দেশেই প্রচুর ধূমপায়ী লোক থাকা সত্ত্বেও স্মিন্টএয়ারের ভাগ্যেও ছিল স্মোকারস এক্সপ্রেসের মতোই একই পরিহাস। বিমানের কার্যক্রম শুরু করার মতো পুজির অভাবেই কিনা হারিয়ে যেতে হয়েছিল এই অভিনব আইডিয়াকে!


৫. এমজিএম গ্র্যান্ড এয়ার


১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এমজিএম গ্র্যান্ড এয়ার ছিল এমন একটি সুপারলাক্সারি এয়ারলাইন যেখানে ছিল শুধুই ফার্স্ট ক্লাস। শুধুমাত্র একটি রুটে চলতো এটি। বিমান হিসেবে ছিল বোয়িং ৭২৭ এবং ডগলাস ডিসি-৮। প্রায় শতাধিক লোকের ধারণক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই বিমানে ৩৩ জনের বেশি যাত্রী উঠানো নিষেধ ছিল।


এখানেই শেষ নয়, এয়ারলাইনটি আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- তাদের বিমানে যেতে হলে কোনো লাইনে দাড়াতে হবে না, ব্যাগবোচকা নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে না, কুলি আপনাআপনি সেগুলো পৌছে দিবে বিমানে, এমনকি ডোর-টু-ডোর লিমুজিন সেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল তারা।


বিমানের ভেতরে ছিল ৫ জন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট, একটি স্ট্যান্ড-আপ বার এবং ব্যক্তিগত আলাপের জন্য আলাদা কম্পার্টমেন্ট। চমতকার মদ ও শ্যাম্পেন সহযোগে খাওয়াদাওয়ার সুবিধাও থাকছে হাতের নাগালে। তবে এই সবকিছুর জন্য আপনাকে বাড়তি খুব বেশি টাকা গুনতে হবে না।


শুরুর দিকে তারকাদের মধ্যে এমজিএম বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তারা আরো রুট চালু করে। কিন্তু বিমানের ৩৩ আসন পূরণ করতেও হিমশিম খায় তারা। ফলে নব্বইয়ের দশকে আস্তে আস্তে নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয় এমজিএম গ্র্যান্ড এয়ার এবং ১৯৯৩ সালে এটি অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া হয়। এয়ারলাইনের নতুন নাম হয় 'চ্যাম্পিয়ন এয়ার' যা ক্রীড়া দল ও সরকারি সংস্থাগুলোকে চার্টার্ড ফ্লাইটের সুবিধা দিতো। কিন্তু বিধি বাম! এই প্রতিষ্ঠানটিও ২০০৮ সালে শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.