যার ছবিতে খাবার হয়ে ওঠে শিল্প
ODD বাংলা ডেস্ক: রান্নার বইতে, রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে, সিনেমার দৃশ্যে বা বিজ্ঞাপন চিত্রে খাবারের ছবি দেখে প্রায়ই পেটের খিদে চনমন করে ওঠে না? হয়তো ছবির খাবারটি খুবই সাধারণ, নিত্যদিনের পরিচিত, তবু নজরকাড়া পরিবেশন একে অনন্য করে তোলে। এই কাজের পেছনে কৃতিত্ব পেশাদার ফুড স্টাইলিস্ট ও ফুড ফটোগ্রাফারদের। তাদের দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় সাধারণ খাবারগুলোও অসাধারণ হয়ে সেজে ওঠে।
"ফুড স্টাইলিস্ট" পেশাটি আমাদের দেশে এখনো খুব পরিচিত হয়ে না উঠলেও আন্তর্জাতিকভাবে দিন দিন এর কদর বাড়ছে। বাংলাদেশে ফুড স্টাইলিস্ট আর ফুড ফটোগ্রাফার হিসেবে অন্যতম নাম আতিয়া আমজাদ। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে গরুর মাংস, আলু ডিমের ঝোল, ললি আইসক্রিম বা সাধারণ লেবুর শরবতও যে শিল্প হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে তার উদাহরণ দেখা যায় আতিয়া আমজাদের তোলা ছবিতে।
পেশাগত জীবনে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করলেও শখের বসেই করেন রান্না-বান্না, ফুড ব্লগিং, ফুড স্টাইলিং আর ফুড ফটোগ্রাফি। খাবার নিয়ে যাবতীয় এক্সপেরিমেন্ট আতিয়ার নেশা। পত্রিকায় নানা সময়ে শেয়ার করতেন নিজের অভিনব সব রান্নার রেসিপি। তার তোলা নানা খাবারের ছবি ডিভাইসের স্ক্রিন থেকে বের হয়ে দর্শকের মনের ভেতর স্বাদ আর ঘ্রাণের আলোড়ন তুলে।
রান্নার প্রতি ভালোবাসা থেকেই আতিয়া সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করতেও পছন্দ করতেন। তার ভাষ্যে, "একা খাবার খেতে বসলেও আমি সবসময় খাবার সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে পছন্দ করি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব বাসায় বেড়াতে এসে আমার পরিবেশনা দেখে সবসময় প্রশংসা করত, ছবি তুলে নিয়ে যেত।" ফুড স্টাইলিং আর ফটোগ্রাফি নিয়ে আতিয়া আমজাদের আগ্রহের শুরুটা যখন হয়েছিল তখন বাংলাদেশে এই সেক্টরে পেশাগতভাবে কাজ করা তেমন কেউ ছিলেন না। তাই ফুড ফটোগ্রাফিতে প্রথমবার তার হাতে খড়ি হয়েছিল ইন্টারনেটে নানা ফটোগ্রাফি ব্লগ পড়ে।
যেকোনো আগ্রহের জায়গা নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি আর পড়াশোনা করা আতিয়ার অভ্যাস। রান্না নিয়ে তার জানাশোনাটাও ব্যাপক পড়াশোনার ফল। তেমনি ফুড ফটোগ্রাফি আর স্টাইলিং নিয়ে পড়াশোনা করেও অনেক খুটিনাটি জানতে পারেন তিনি। কিন্তু প্রফেশনালভাবে নিজেকে ঝালিয়ে নেয়ার জন্য ভর্তি হন পাঠাশালার বেসিক ফটোগ্রাফি কোর্সে। সে কোর্সে ফুড ফটোগ্রাফি নিয়ে বিশেষ কিছু অবশ্য ছিল না। পরবর্তিতে অনলাইনে নানা বিখ্যাত ফুড ফটোগ্রাফারদের কাছ থেকে প্রফেশনাল কোর্স করেন আতিয়া।
প্রতিনিয়ত দেশি নানা খাবার নান্দনিক রূপে ধরা পড়ে তার ফ্রেমে।"আমাদের দেশ, দেশের সংস্কৃতি আর দেশের খাবার যে কত সমৃদ্ধ! শুধু দেখার পার্থক্যের কারণে সব কিছু ইগ্নোরড হয়ে আছে। এটাই কষ্ট লাগে! নিজের দেশ, নিজের যা কিছু আছে আমি মনে করি তা দিয়েই বেস্ট আউটপুট আনা সম্ভব, শুধু দেখার চোখটা থাকতে হয়," আতিয়ার ভাষ্য।
শুরুতে শখের বসে তোলা খাবারের ছবি শুধু ফেসবুকে আর ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করতেন আতিয়া। সেসব ছবি দেখে অনেকেই কাজ সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তখন ইনবক্সেই নানা পরামর্শ দিতেন তিনি। "খাবারও যে একটা আর্ট হতে পারে আর আমাদের দেশের পরিচিত খাবারগুলো নিয়েও যে এত সুন্দর কাজ হতে পারে তা আপনাকে না দেখলে বুঝতাম না," দর্শকদের এমন মন্তব্য আতিয়ার কাজ করার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ।
ফুড স্টাইলিং আর ফটোগ্রাফি শুরুর কয়েকটা বছর নিজের আশেপাশে কোনো পরামর্শক পাননি আতিয়া৷ চার-পাঁচ বছরে অনেকটা নিজের চেষ্টাতেই ঠেকে শিখেছেন সব কিছু। তাই পরবর্তীতে যারা এই কাজে আসতে চেয়েছেন তাদের সহায়ক হওয়ার চিন্তা করেন। ২০২১ সালে করোনার লকডাউনের মাঝে অনলাইনেই শুরু করেন ফুড ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। ফেসবুকে তার কাজের সাথে পরিচিতরাই শুরুতে এই কোর্সে ভর্তি হন। এখন ফুড স্টাইলিং আর ফটোগ্রাফি কোর্সের তার সপ্তম ব্যাচকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন আতিয়া ৷ দেশি-বিদেশি নানা বয়সী শিক্ষার্থী ভর্তি হন তার কোর্সে।
আতিয়া বলেন, "সাধারণ ফটোগ্রাফি আর ফুড ফটোগ্রাফিতে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। ফুড ফটোগ্রাফির বিষয়টা সেনসেটিভ। অন্যান্য দেশে ফুড স্টাইলিস্ট আর ফুড ফটোগ্রাফার হিসেবে একাধিক মানুষ থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে একজনকেই সব করতে হয়।
"ধরুন আমি গরুর আইটেমের ছবি তুলব। সেজন্য শুধু রান্না করা গরুর মাংস সাজিয়ে ছবি তুলে ফেললেই হবে না। পারফেক্ট আর নতুন কম্পোজিশনের আমার আগে থেকেই ছবির দৃশ্যটা মাথায় সাজিয়ে নিতে হয়। কী কী প্রপস লাগবে, রান্নায় কী কী থাকবে, কোন আলোতে ছবি তুলব, কোন পাত্রে সাজাব সব আগেভাগে চিন্তা করা থাকে৷ এরপর সে অনুযায়ী সব জোগাড় করে রাখি৷ রান্নার উপকরণ সব বাজার থেকে ফ্রেশ কিনে আনি। নিজের কাজের ক্ষেত্রে রান্নাটাও নিজেই করি। তবে রান্নার আগেই সব সেটাপ সাজিয়ে নিই ঠিক করে। কারণ রান্নার পর ছবি তোলার জন্য বেশি সময় পাওয়া যায় না।"
ফটোগ্রাফির জন্য রান্নার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয় বলে জানান আতিয়া। যেমন- খাবারের রঙ সুন্দর রাখতে হলে খাবার কখনো পুরোপুরি সেদ্ধ করা যাবে না। ছবি তোলার জন্য ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ সেদ্ধ করা খাবারই চুলার তাপ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। খাবার সাজানোর জন্য অনেক সময় প্রাকৃতিক ফুল-পাতা ব্যবহার করা হয়৷ সেগুলোতে যেন বিষাক্ত কিছু না থাকে তা-ও নিশ্চিত হয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি৷
"শুরুতে আমাকে এই ছোট ছোট বিষয়গুলো বলে দেওয়ার মতোও কেউ ছিল না৷ এতদিনে অর্জন করা সব জ্ঞান আমার ফটোগ্রাফি স্টুডেন্টদের শিখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি এখন। তিন মাস ব্যাপি এক-একটি কোর্সে মোট ১২-১৩ টি ক্লাস করাই৷ এর বাইরেও ফুড ফটোগ্রাফি নিয়ে স্টুডেন্টদের কোনো কিছু জানার থাকলে তারা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে জেনে নিতে পারে," বলেন আতিয়া। বর্তমানে তার প্রতিটি ফুড ফটোগ্রাফি কোর্সের জন্য নির্ধারিত কোর্স ফি ২৫ হাজার টাকা।
কেউ পেশাগতভাবে ফুড স্টাইলিং আর ফটোগ্রাফির কাজ করতে চাইলে শুরুতেই তাকে নিজের কাজ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে বলে জানান আতিয়া। দক্ষ হওয়ার পরই পেশাদারী কাজ শুরু করার চিন্তা করতে হবে। বাংলাদেশে এই পেশা অনেকটাই নতুন বলে ফ্রিল্যান্স কাজ করাটাই সুবিধাজনক। প্রচারণার জন্য ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বেশ সহায়ক মনে করেন তিনি।
নিয়মিত এসব মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে নিজের পরিচিতি বাড়ানো যেতে পারে। নিজের প্রোফাইলের পেশাদার কাজ করতে আগ্রহের কথা লিখে সবাইকে জানানো যায়। আগের কাজগুলো নিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন পোর্টফোলিও বানানো থাকলে তা নতুন কাজ পেতে খুবই সাহায্য করে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের নিজের কাজ সম্পর্কে জানিয়ে রাখলে নানা সোর্স থেকে কাজ পাওয়া সহজ হয়।
বিয়েবাড়ী, ক্রুয়া থাই, থাই সিগনেচার, ওয়াও মোমো, সুইট নেশন ইত্যাদি বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের খাবারের ছবি তুলেছেন আতিয়া আমজাদ। কাজ বাছাই করার ক্ষেত্রে তিনি বেশ সচেতন। মনমতো আউটপুট না পাবেন না ভাবলে সে কাজ আর করেন না। বাড়িতেই তার নিজস্ব স্টুডিওতে নিজের প্রপস দিয়ে মনমতো সেটিং সাজিয়ে কাজ করেন আতিয়া। এপর্যন্ত দেশ-বিদেশের নানা ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড, মেডেল ও পুরষ্কার জিতে নিয়েছেন। বর্তমানে প্রতি ছবির জন্য তার সম্মানী চার হাজার টাকা।
জীবনের সব কাজই আতিয়া দক্ষ হাতে করতে চান। যতক্ষন পর্যন্ত নিজের কাজে সন্তুষ্ট না হতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত অবিরত চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। ফুড ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রেও নতুন নতুন সব বিষয় শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷ প্রতিবেশি দেশ ভারতের ফুড স্টাইলিস্ট রিমলী দে আর মৌমিতা পাল ঘোষ তার কাজের অনুপ্রেরণা। নতুন যারা ফুড স্টাইলিং আর ফটোগ্রাফিকে পেশা হিসেবে নিয়ে কাজ করতে চায় তাদেরকে অবশ্যই দক্ষ হয়ে কাজে নামার পরামর্শ দেন তিনি৷
নানা ধরনের নিজস্ব রেসিপি আর তার তোলা খাবারের ছবিসহ প্রথম বই প্রকাশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আতিয়া আমজাদ৷ ফুড ব্লগিং এর জন্য নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরির কাজও চলছে। আতিয়া বলেন, "অনেক বয়স হয়ে গেলে নিজের কাজগুলো দেখে যেন আত্মতৃপ্তি পেতে পারি তা-ই চাওয়া৷" পরবর্তী প্রজন্মকেও নিজের কাজের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতে চান তিনি।
Post a Comment