যেভাবে ভারত দখল করে পারস্যের বিরিয়ানি

 


ODD বাংলা ডেস্ক: বিরিয়ানির জন্য ভারতের বিশ্বজোড়া নাম। এর উৎস হলো প্রাচীন পারস্য। মালিকানা পারস্যের হলেও, বিরিয়ানিকে ভারতের মাটিতে আকাশছোঁয়া উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন মুঘল সম্রাটরা। তাদের হাতেই হয়েছিল বিরিয়ানির ভারতীয়করণ। একসময় বিরিয়ানি জয় করে নেয় ভারতবাসীর মন। কিন্তু কীভাবে?

কীভাবে ভারত দখল করেছিল পারস্যের বিরিয়ানি 


বিরিয়ানির নাম ইরানে ছিল বিরিঞ্জ বিরিয়ান। ‘বিরিঞ্জ’শব্দের অর্থ হলো ভাত এবং ‘বিরিয়ান’ শব্দটির অর্থ হলো ‘রান্নার আগে ভেজে নেওয়া’। প্রাচীন পারস্যের খুবই জনপ্রিয় একটি পদ ছিল এই ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’। প্রাচীনকালে পারস্য থেকেই ভারতে আসত দুর্লভ আতর ও অনান্য গন্ধদ্রব্য। ঠিক সেভাবেই পারস্যের ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিল পারস্যের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’। নাম হয়েছিল ‘বিরিয়ানি'(Biryani)।

অনেকে বলেন, চতুর্দশ শতকের মহাপরাক্রমশালী মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লঙের কথা। সিরিয়া থেকে চিনের কাশগড় পর্যন্ত ছিল যার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি। পারস্যের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’ ছিল নাকি তার মনপসন্দ ডিশ। এবং তৈমুরের সেনাদের হাত ধরেই ভারতে প্রবেশ করেছিল বিরিয়ানি। 


কিন্তু সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য মতবাদটি জড়িয়ে আছে মুঘল রাজত্বের সঙ্গে। মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্তানের ফারগানা থেকে ভারতে এসে, জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল মুঘল সাম্রাজ্য। তার হাত  ধরেই নাকি ভারতে প্রবেশ করেছিল পারস্যের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’। এই মতবাদটি সম্ভবত সত্যি। কারণ মুঘল সম্রাটদের বিরিয়ানি  প্রীতি বিশ্ববিদিত। সম্রাট আকবর তো রীতিমত গবেষণা করে,  স্বাদ ও গন্ধের দিক থেকে বিরিয়ানিকে নিয়ে গিয়েছিলেন আকাশছোঁয়া উচ্চতায়। আকবরি বিরিয়ানির জন্য বাছাই করা চালের প্রতিটা দানার গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হতো ‘সিলভার অয়েল’। গুরুপাক বিরিয়ানি হজমে সাহায্য করত এই তেল। সক্রিয় ভূমিকা নিত সম্রাটের যৌনশক্তি বৃদ্ধিতেও।

এছাড়া আকবরি বিরিয়ানির জন্য আফগানিস্তান থেকে আনা হতো বিশেষ প্রজাতির মুরগি। দিল্লির প্রাসাদে গড়ে তোলা খামারে মুরগিগুলিকে যত্ন করা হতো কয়েক মাস ধরে। মাটিতে ছড়িয়ে নয়, হাতে করে খাওয়ানো হতো বাছাই করা দানা। সেই দানাগুলোতে মেশানো থাকতো জাফরান। মুরগিগুলোকে পান করানো হতো সুগন্ধি গোলাপ জল। এতেই শেষ নয়, রোজ বিকেলে মুরগিগুলোর গায়ে মালিশ করা হতো কস্তুরি ও চন্দন তেল। ফলে আকবরি বিরিয়ানির মাংসে থাকতো না আঁশটে গন্ধ। মাংস হতো নরম, সুস্বাদু ও সুগন্ধী।


মমতাজ বিরিয়ানিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন আমজনতার কাছে


ভারতে আসার পর, একমাত্র মুঘল সম্রাটদের খাবার টেবিলেই শোভা পেত বাষ্প ওঠা সুরভিত বিরিয়ানি। কিন্তু পরবর্তীকালে একটি অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে বিরিয়ানি হয়ে গিয়েছিল আমজনতার। একবার সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে রণক্ষেত্র পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বেগম মমতাজ মহলো। রণক্ষেত্রে গিয়ে মুঘল সম্রাটের সৈন্যদের দেখে আঁতকে উঠেছিলেন মমতাজ।

দিগ্বিজয়ী সম্রাটের সৈন্যদের এ কী অবস্থা! এই জীর্ণ শীর্ণ চেহারার সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ জেতার আশা করছেন সম্রাট শাহজাহান! পত্রপাঠ মুঘল সেনাদের জন্য পুষ্টিকর বিরিয়ানি রাঁধার আদেশ দিয়েছিলেন মমতাজ। সেই প্রথম বিরিয়ানির স্বর্গীয় স্বাদ পেয়েছিল সাধারণ সৈন্যরা। মমতাজের আদেশে নিয়মিত বিরিয়ানি রাঁধা হতে লাগল মুঘল সৈন্যদের জন্য। প্রথমে এই মুঘল সৈন্য, পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন নবাব ও নিজামদের হাত ধরে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল বিরিয়ানি।


বিরিয়ানি হয়ে যায় ভারতের


ভারতে প্রধানত দুটি পদ্ধতিতে রাঁধা হয় বিরিয়ানি। পদ্ধতি দুটির নাম কাচ্চি ও পাক্কি। কাচ্চি বিরিয়ানিতে মাংস ও চাল, একই পাত্রে একসঙ্গে রান্না করা হয়। পাক্কি বিরিয়ানিতে মাংস ও চাল আলাদা আলাদা রান্না করা হয়, কিন্তু পরিবেশন করা হয় এক সঙ্গে। আজ এই কাচ্চি ও পাক্কি রন্ধনশৈলীর ছাতার নিচে আছে প্রায় আশি ধরণের বিরিয়ানি। তবে এগুলোর মধ্যে সব থেকে ওপরে আছে হায়দরাবাদী, লক্ষ্ণৌ (অওধি) ও কলকাতা বিরিয়ানি।


হায়দরাবাদের নিজামের রুসুইঘরে উৎকর্ষ লাভ করা হায়দরাবাদী বিরিয়ানিতে ব্যবহার করা হয়, রেওয়াজি খাসির মাংস, ঘি, পেঁয়াজ, লবঙ্গ, দারুচিনি, পেপে বাটা, তেজপাতা, এলাচ, জায়ফল, কেওড়া বীজ, জইত্রি, মৌরি, লাল ও সবুজ লঙ্কা, আদা, রসুন, লেবু, জাফরান, ধনে পাতা ও দই। একবার এই বিরিয়ানির স্বাদ নিলে তা ভোলা কঠিন। তাই অনেক পর্যটক এই বিরিয়ানি খাওয়ার লোভেই হায়দরাবাদকে দক্ষিণ ভারত ট্যুরের মধ্যে জুড়ে নেন।


পিছিয়ে নেই কলকাতা বিরিয়ানিও। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ, ১৮৫৮ সালে মেটিয়াবুরুজে আসার পর কলকাতায় প্রচলিত হয় ‘কলকাতা বিরিয়ানি’। নবাবের বেগমদের হাতে তৈরি এই বিরিয়ানিতেই প্রথম দেখা মিলেছিল ডিম ও আলুর। খরচ কমানোর জন্য মাংসের পরিমাণ কমিয়ে বিরিয়ানিতে যোগ করা হয়েছিল আলু ও ডিম, পুষ্টিমূল্য একই রেখে। এ ছাড়াও বিরিয়ানিতে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল মিঠে আতর।


আজ ভারতীয়দের রসনা তৃপ্ত করে বোম্বে বিরিয়ানি, কল্যানী বিরিয়ানি, দিন্দিগাল বিরিয়ানি, অম্বর বিরিয়ানি, সিন্ধি বিরিয়ানি, তেহারি বিরিয়ারি, থালাইসেরি বিরিয়ানিসহ আরো কতো বিরিয়ানি। খোদ ইরানেও বুঝি এত ধরণের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’ পাওয়া যায় না। কারণ ভারতবাসীদের মতো বিরিয়ানি নিয়ে এত গবেষণা করেনি ইরানও। তাই বিশ্ব জুড়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে ভারতীয় বিরিয়ানির জনপ্রিয়তা। ইরানের ‘বিরিঞ্জ বিরিয়ান’ পূর্বসুরী হয়েও, নিজের অজান্তেই হেরে গিয়েছে ভারতের বিরিয়ানির কাছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.