কুকুর দেখলেই জোড় করে জড়িয়ে ধরে দুধ পান করে এই বালক!
ODD বাংলা ডেস্ক: অভাবি সংসারের ঘানি টানতে মধুপুর শহরের হাটবাজারে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের কাজ নেন মা জমেলা। হাটের অপরিচ্ছন্ন রাস্তার পাশে অনাদরে বসিয়ে রাখতেন শিশু ফখরাকে। ক্ষুধা আর তৃষ্ণার কান্না শুনলে হাতের কাজ ফেলে পান করাতেন বুকের দুধ।
কদিন পর খেয়াল করলেন অনাদরের ফখরার বেজায় ভাব বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে। তখন থেকে শিশু ফখরার মায়ের বুকের দুধ পানের আগ্রহ কমতে থাকে। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান মা জমেলা।
একদিন বখরার কাণ্ড দেখে অবাক হন জমেলা। হাটের আবর্জনার স্তূপের আড়ালে দুটি ছানার সঙ্গে কুকুরের দুধ খাচ্ছে ফখরা। তিনি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারেননি। জোর করে সরিয়ে নেন শিশু ফখরাকে।
এরপর কাজের সময়েও কড়া নজরে রাখতেন রাস্তার ওপর বসিয়ে রাখা ফখরার দিকে। কিন্তু সুযোগ পেলেই দল বেঁধে কুকুর ছুটে আসত ফখরার কাছে। আর ফখরা নির্ভয়ে পান করত কুকুরের দুধ। পরে রাগে ক্ষোভে জমেলা প্রায়ই মারপিট করতেন শিশু ফখরাকে।
ফখরুদ্দীন। বয়স সাত। স্থানীয়দের কাছে ফখরা নামে বেশ পরিচিত। আলোচিত হয়েছে কুকুরের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে। আজ নয়, জন্মের ছয় মাস বয়স থেকেই কুকুরের সঙ্গে ওঠাবসা তার।
শুধু ওঠাবসাই নয়, কুকুরের দুধ পানে ফখরার বেড়ে ওঠা। অনাদরে থাকা ফখরা কুকুরের মাতৃস্নেহেই বেড়ে উঠছে। আবাল্য মেশামেশিতে অবুঝ প্রাণির সঙ্গে এখন তার নাড়ির বন্ধন। বোবা প্রাণিটিও যেন ওর আপনজন। একে অপরের ভাষা বোঝে সহজেই।
আকার ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করে তারা। কুকুরের সঙ্গে খাবার না দিলে অঝোর ধারায় কাঁদে ফখরা। ‘ফখরার কুকুরপ্রীতি’ এটা কোনো গল্প কাহিনি নয়।
কুকুরপ্রীতি এই ফখরার বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর পৌরসভার কাজীপাড়া এলাকায়। ফখরার এই কুকুরপ্রীতি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। বর্তমানে অর্ধশতাধিক কুকুর রয়েছে তার কাছে। শহরের সব কুকুরের নেতা ফখরা।
কুকুরের সঙ্গ আর কুকুরের দুধ পানে বড় হওয়া বিস্ময়কর এক বালক ফখরার অবিশ্বাস্য এক গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে। জন্মের ছয় মাসের মাথায় ফখরার মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে।
এ প্রসঙ্গে জমেলা জানান, একদিন ফখরা হারিয়ে যায়। দুদিন পর সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায় পৌরশহরের সান্দারপট্টির জঙ্গলে একদল কুকুরের সঙ্গে।
এভাবেই কুকুরের সঙ্গে ফখরার বেড়ে ওঠা। পৌরশহরের সব কুকুর এখন ওর খেলার সাথী ও বিশ্বস্ত বন্ধু। একই সঙ্গে কুকুরের দুধ পানেই বড় হয়ে উঠেছে ফখরা।
তিনি জানান, ১৫ বছর বয়সে জমেলার বিয়ে হয় উপজেলার জটাবাড়ির আলীম উদ্দীনের সঙ্গে। তিন মেয়ের পর ফখরার জন্ম ২০১১ সালে। অভাবের সংসারে জমেলার মাথা গোঁজার ঠাঁই ভাইয়ের ভিটায়। দেড় বছর বয়স থেকে কুকুরের সঙ্গে হাঁটাচলা, মেলামেশা অবিশ্বাস্য সখ্যতায় রূপ নেয়।
পাড়ার সব বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে ভাব হলেও আদুরি আর বাবুলি সব সময়ের সাথী। ওদের নিয়ে মধুপুর পৌরশহর ছাড়াও গাঙ্গাইর, রক্তিপাড়া, আশ্রা, মোটের বাজার, গারোবাজারসহ উপজেলার হাটবাজার ও গঞ্জ চষে বেড়ায় ফখরা।
তিনি বলেন, দূরের রাস্তায় কুকুরের পিঠে চড়ে পাড়ি দেয় ফখরা। যেন ঘোড়সওয়ার। বন্ধুর মতো গড়াগড়ি, গলাগলি, কামড়া-কামড়ি ও কসরত দর্শকদের মুগ্ধ করে। পাঁচ-দশ টাকা বকশিশ মেলে। তাতে কেনে কলা-পাউরুটি। এভাবেই কলা আর পাউরুটিতে দিন কাটে কুকুরবান্ধব ফখরার।
অনেক সময় খাবারের লোভে দল বাঁধা কুকুর পিছু নেয় ফখরার। শহরে নবাগত অতিথিদের সঙ্গে ভাব জমাতে সময় লাগে না তার। মহল্লায় নবাগত আর মনিব অনুগত দুই দল কুকুরের আবহমান ঝগড়ায় দাঁত খেঁচিয়ে সেই বলে, কেন আইলি, প্রত্যুত্তরে ‘যাইস-খাইস’ বিবাদ মেটাতে তৎপর থাকে ফখরা।
মা জমেলা এখনো মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তিনি বলেন, ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন। লাভ হয়নি। কুকুর না দেখলে পাগল হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। তাই ওকে ওর মতো করে চলতে ছেড়ে দিয়েছি।
মধুপুর বাসস্ট্যান্ডের পরিবহন শ্রমিক নির্মল জানান, রাতে এক ডজন কুকুরের কড়া পাহারায় বাড়ি ফেরে ফখরা। মায়ের রান্না করা খাবার ভাগ করে খায় ওরা। কাকডাকা ভোরে দলবেঁধে আসে বাসস্ট্যান্ডে। ফখরার তিন বোনের সবার বিয়ে হয়েছে।
ফখরার বড় বোন শাহেদার আক্ষেপ, কুকুরের সঙ্গে থাকা-খাওয়ায় প্রতিবেশীরা বিরক্ত। ঘৃণা করে। বকাঝকা করে। কেউ মেশে না তার সঙ্গে। এমনকি আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসে না। কিন্তু ফখরার ওসব তোয়াক্কা নেই।
মা জমেলা বলেন, আবাল্য মেশামেশিতে অবুঝ প্রাণির সঙ্গে এখন তার নাড়ির বন্ধন। বোবা প্রাণি ওর আপনজন। ওদের ভাষা বোঝে। আকার ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করে। কুকুরের সঙ্গে খাবার না দিলে অঝোরে কাঁদে ফখরা। বেশি ক্ষেপলে হাঁড়িপাতিল ভাঙে। অস্বাভাবিক আচরণ করে। তখন ভয় লাগে।
গত ডিসেম্বরে মধুপুর পৌরশহরে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধায় ফখরা। প্রিয় কালু ও ভুলু নিধন হয় অভিযানে। এতে ক্ষেপে যায় ফখরা।
বাড়িতে অস্বাভাবিক কান্না করে সে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে মায়ের পরামর্শে একদল কুকুর নিয়ে পৌর ভবনে মেয়র মাসুদ পারভেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
মেয়রকে ফখরা জানায়, বন্ধু কালু আর ভুলু কখনো মানুষ কামড়াতো না। তাহলে কেন তারা নিধন হলো। মেয়র আগে থেকেই ফখরাকে চেনেন।
ফখরার ভাষ্য, মেয়র আমাকে খুব আদর করেন। আমাকে কথা দিয়েছেন আমার বন্ধুদের আর নিধন করা হবে না। এজন্য আমি খুবই খুশি।
পৌর মেয়র মাসুদ পারভেজ ফখরার কুকুরপ্রীতি ও কুকুরের দুধ পানে বেড়ে ওঠার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, পৃথিবীতে অনেক অবাক কাণ্ড ঘটে। এটি তার অন্যতম।
কুকুর নিধনের প্রতিবাদে ফখরার পৌর অফিসে আসার কথা স্বীকার করে মেয়র বলেন, কুকুরের সঙ্গে মানুষ হওয়া এ শিশুটির চাওয়া ছিল মানবিক। আসলে বিনা কারণে কুকুর নিধন না করার জন্য নির্দেশনা রয়েছে হাইকোর্টেরও।
ডিসেম্বরে নিধন অভিযানের পর মধুপুর পৌর শহরে বেওয়ারিশ কুকুর কমে যায়। তবে গ্রাম থেকে আসা নবাগত কুকুরের সঙ্গে ফখরার মিতালি গড়ে উঠে সমানতালে বলেন পৌর মেয়র।
পৌর শহরের পাইলট মার্কেটের দোকানি রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, ফখরাকে ছোটকাল থেকেই কুকুরের সঙ্গে বড় হতে দেখেছি। কুকুরের দুধ পান করার দৃশ্য অনেকেই দেখেছেন।
মধুপুর পাইলট মার্কেটের গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ভুট্টো সরকার বলেন, আজন্ম কুকুরের সঙ্গে মিতালির কারণে কখনো কখনো ওর মধ্যে অসহিষ্ণু ও ক্ষিপ্ত আচরণ সৃষ্টি হয়। রাগলে গলা দিয়ে অস্বাভাবিক স্বর বের হয়। সর্বক্ষণ জিহ্বা বের করে রাখে। হাঁটা ও পা ফেলার স্টাইল যেন কুকুরের অনুকরণ।
মা জমেলা বলেন, ওরে কুকুর সঙ্গ থেকে বিরত রাখা বিফলে গেছে। জরুরি চিকিৎসা দরকার। আমরা খুবই গরিব। এক বেলা খাবারই জোটে না।
আমার বুকের মানিকের চিকিৎসা করাব কীভাবে। মানুষে-কুকুরে এই মিতালি বিস্ময়কর না হলেও স্বভাবে হিংস্র ও মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত ফখরার সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের আবেদন জানিয়েছেন মা জমেলা।
Post a Comment