ভারত যে খাদ্য সরবরাহের ভরসা দিচ্ছে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে, রক্ষা করতে পারবে?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজার এখন অস্থিতিশীল। তার জন্য অনেকটা দায়ী ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্যের সংকট চলছে। দানাদার শস্যের দাম এখন নজিরবিহীন মাত্রায় বেড়েই চলেছে। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের ঘাটতি পূরণে ভারত প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।


গত সপ্তাহে তিনি একথা বলেছেন আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে।  


এসময় মোদি জানান, ১৪০ কোটি নিজস্ব জনসংখ্যার মুখে তুলে দেওয়ার মতো 'পর্যাপ্ত খাবার' ভারতের রয়েছে। "বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) যদি অনুমতি দেয়, তাহলে আগামীকাল থেকেই বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের যোগান দিতে প্রস্তুত রয়েছে ভারত।"


বিশ্বের প্রধান প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগশ অন্যান্য কারণে ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই ফসল সংগ্রহ কমেছিল। তাতে শস্যের দাম পৌঁছে যায় ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। যুদ্ধের পর সে দাম আরো চড়েছে। ১৯৯০ সালের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ইউএন-ফাও) এর খাদ্যমূল্য সূচক। 


এমন না হওয়ারও কারণ নেই। যুদ্ধরত দুই দেশ—রাশিয়া আর ইউক্রেন—বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম সরবরাহক, সূর্যমুখী তেলের ৫৫ শতাংশের যোগানদাতা, ১৭ শতাংশ ভুট্টা ও বার্লি—তারাই যোগায়। ফাও এর তথ্যমতে, যৌথভাবে তাদের থেকে প্রত্যাশিত বার্ষিক গম ও ভুট্টা রপ্তানি যথাক্রমে ১৬ ও ১৪ মিলিয়ন টন। 


জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, দুই দেশ মিলে এবছর এক কোটি ৪০ লাখ টন গম ও এক কোটি ৬০ লাখ টন ভুট্টা রপ্তানি করবে বলে আশা করা হয়েছিল।


ইউএন-ফাও এর অর্থনীতিবিদ উপালি গালকেতি আরাতচিলেজ বলেন, "যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চক্রে ব্যাঘাত এবং রাশিয়া নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে থাকার অর্থ এসব রপ্তানিকে সমীকরণ থেকে বাদ দিতে হবে। ভারত আরও বেশি রপ্তানির উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে, কারণ দেশটির কাছে গমের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে।"


ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গম ও চাল উৎপাদক। চলতি এপ্রিলের শুরুর দিকে ভারতের কাছে এ দুটি প্রধান শস্যের মজুদ হিসাব করা হয়েছিল ৭ কোটি ৪০ লাখ টন। এরমধ্যে, ২ কোটি ১০ লাখ টন কৌশলগত মজুদে রাখা হয়, এখান থেকে গণবিতরণ ব্যবস্থায় ৭০ কোটি দরিদ্র ভারতীয়কে সস্তায় খাদ্য সরবরাহ করে সরকার।  


বিশ্বের যে কয়টি দেশ সবচেয়ে কম দামে গম ও চাল সরবরাহ করে ভারত তার মধ্যে অন্যতম। দেশটি প্রায় ১৫০টি দেশে চাল ও ৬৮টি দেশে গম রপ্তানি করে। 


২০২০-২১ অর্থবছরে ভারত প্রায় ৭০ লাখ টন গম রপ্তানি করে। আন্তর্জাতিক বাজারে চড়ামূল্য থাকায় এরমধ্যেই ভারতের ব্যবসায়ীরা এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩০ লাখ টন গম রপ্তানির চুক্তি পেয়েছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি এরমধ্যেই পাঁচ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।


ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অন রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সের কৃষি বিষয়ক অধ্যাপক অশোক গুলাটি বলেছেন, চলতি অর্থবছরে ভারতের ২ কোটি ২০ লাখ টন চাল ও এক কোটি ৬০ লাখ টন গম রপ্তানির সক্ষমতা আছে। "বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যদি ভারত সরকারের হাতে থাকা বিপুল মজুদ রপ্তানির অনুমোদন দেয়, তাহলে রপ্তানির পরিমাণ আরো বাড়তে পারবে। এতে বিশ্ববাজারে দর পরিস্থিতি শান্ত হবে এবং খাদ্য আমদানি-নির্ভর দেশগুলোর উপর চাপ কমবে।"


অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য ততোটা ইতিবাচকভাবে দেখছেন না। তারা বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহে ভারতকে অতি-উৎসাহ না দেখানোর পরামর্শ দেন। 


দিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের জ্যেষ্ঠ ফেলো হরিশ দামোদারান বলেন, "এই মুহূর্তে আমাদের কাছে যথেষ্ট মজুদ আছে। কিন্তু এখানেও কিছু উদ্বেগের বিষয় রয়ে গেছে, বিশ্বকে খাওয়ানোর বিষয়ে আমাদের অতি-উৎসাহী হওয়া মোটেই উচিত হবে না।"


খাদ্য রপ্তানি বাড়ালে নিঃসন্দেহে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়বে। কিন্তু তাতে দরিদ্র মানুষের খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। রয়েছে সারের মতো জরুরি কৃষি উপকরণের সংকট।  


তাছাড়া ভারতে এখন গমের মৌসুম চলছে। এ মৌসুমের ফসল এখনও সংগ্রহ হয়নি। যদিও কর্মকর্তাদের আশা এ মৌসুমে ১১ কোটি ১০ লাখ টন গম উৎপাদন হবে। আর তা বাস্তবে রূপ নিলে টানা ষষ্ঠ মৌসুমে হবে গমের বাম্পার ফলন।


দামোদারানের মতো কিছু বিশেষজ্ঞ এসব আভাসে আস্থা রাখতে পারছেন না। ভারতে এবছর সার সংকট রয়েছে। গ্রীষ্মের আগেই হানা দিয়েছে তাপদাহ ও অতিবৃষ্টি। তাই তিনি মনে করেন, সার সংকট এবং বিরুপ আবহাওয়ার কারণে এ মৌসুমে আশানুরুপ ফলন পাওয়া যাবে না। "আমরা উৎপাদনের অতিমূল্যায়ন করেছি। আরও ১০ দিন পর প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।"


তাছাড়া, চাষবাসের আবশ্যক উপাদান সার। এনিয়েও বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ আছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর কমেছে ভারতের সারের মজুদ।


ভারতকে ডি-এমোনিয়াম ফসফেট এবং সালফার, পটাশ, ফসফেট ও নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার আমদানি করতে হয়। রাশিয়া ও বেলারুশ বিশ্বের মোট পটাশ রপ্তানির ৪০ শতাংশ করে। দুটি দেশই পড়েছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে। তাছাড়া, গ্যাসের চড়া মূল্যের কারণেও বিশ্বজুড়ে সারের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে।


সার সরবরাহ কমায় আগামী ফসল উৎপাদন মৌসুমে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে জানিয়ে একটি বিকল্প উপায় বাৎলে দেন দামোদারান। তিনি বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে চাইলে ভারত সরকার মিশর ও আফ্রিকার অন্য দেশের সাথে 'সারের বিনিময়ে গম সরবরাহের চুক্তি' করতে পারে।


যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে ভারত পণ্যের চালান পৌঁছে দিতেও সমস্যার মুখে পড়বে। তখন রপ্তানি বৃদ্ধির চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে।


ইউএন-ফাও এর অর্থনীতিবিদ উপালি গালকেতি বলেছেন, "বিপুল পরিমাণ দানাদার শস্য রপ্তানিতে বিশাল সব অবকাঠামো ও যান প্রয়োজন হয়। চাই সড়ক যোগাযোগের পর্যাপ্ত লরি, বন্দরে গুদামঘর ও জাহাজ। রপ্তানি বাড়লে এসবের চাহিদাও বাড়বে। সঙ্গে পরিবহনের উচ্চ খরচের বিষয়টিও রয়েছে।"


আর সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ভারতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়েই। গত মার্চে ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ বা ৭.৬৮ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ভোজ্য তেল, দানাদার শস্য, দুধ, মাংস ও মাছের দাম বৃদ্ধির কারণে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সতর্ক করে বলেছে, 'বিশ্ববাজারে প্রধান কিছু খাদ্যের দরবৃদ্ধির চাপ ভারতেও আছড়ে পড়তে পারে, মূল্যস্ফীতিতে তাতে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে।   

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.