মরা ভেবে পুড়তে গেছিল ডোম, তিনিই দাঁড়িয়েছেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে

 


ODD বাংলা ডেস্ক: বইয়ের নাম ‘হ্যান্ডবুক অব ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস’ (আর্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড র’মেটিরিয়ালস)। দেশীয় শিল্পদ্রব্যকে বিদেশি ক্রেতাদের নাগালে নিয়ে আসার জন্যই হয়েছিল লেখা। লেখক তখন কলকাতা জাদুঘরের আধিকারিক। বাংলার হস্তশিল্পীদের খুঁজে বের করছেন জেলায় জেলায়। এরপর স্টেশনে স্টেশনে খুলছেন দোকান। ট্রেন থেকে নেমে গোরা সাহেব কিনছে ডোকরা কিংবা কৃষ্ণনগরের পুতুল। সাজিয়ে রাখছে ঘরে। অনাহারে মরতে বসা শিল্পীরা দুহাত তুলে আশীর্বাদ জানাচ্ছে ভদ্রলোককে। তার নাম ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। 

‘লুল্লু’ কিংবা ‘কঙ্কাবতী’-র মতো রচনা বাংলায় আর পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কঙ্কাবতীকে অনেকেই তুলনা করেন ‘অ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডার ল্যান্ড’-এর সঙ্গে। তার লেখনী মন কেড়েছিল রবীন্দ্রনাথেরও-- “এইরূপ অদ্ভুত রূপকথা ভালো করিয়া লেখা বিশেষ ক্ষমতার কাজ। ... এতদিন পরে বাঙ্গালায় এমন লেখকের অভ্যুদয়... যাহার লেখা আমাদের দেশের বালক বালিকাদের এবং তাদের পিতামাতার মনোরঞ্জন করিতে পারিবে।”


সভ্য-ভব্য-নব্য ভূত ‘লুল্লু’ সটান তুলে নিয়ে যাচ্ছে ‘চন্ডু’-রসিক আমিরের স্ত্রীকে। বিচলিত আমির বেরোন ‘বিবি’ উদ্ধারে। শেষে লুল্লুকেও আফিমের নেশা ধরিয়ে উদ্দেশ্য সফল করেই ফেরেন। ‘ডমরুধর’-এর মতো এমন উদ্ভট চরিত্রও বিরল। ‘ডমরু চরিত’ পড়তে পড়তে উনিশ শতকের লম্পট-নেশারু-মুচিরাম গুড়দের ছবিটা জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। বাঁধাগতের সাহিত্যিক তো ছিলেন না ত্রৈলোক্যনাথ!


অথচ, তিনি খাতায় কলমে ইস্কুলের গণ্ডিও পেরোননি। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি বাদে উর্দু, ওড়িয়া, হিন্দি, ফার্সি, সংস্কৃততেও সমান সাবলীল। ওড়িয়া পত্রিকার সম্পাদনাও করেছেন একসময়। আসলে জীবনে এমন কাজ নেই যা তিনি করেননি। পুলিশের দারোগা থেকে হাতি-ধরা মাহুত, ত্রৈলোক্যনাথকে পেটের জ্বালাই তাড়িয়ে ফিরেছে আজীবন। 


একসময় গ্রামের স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে চাকরি চলে গিয়েছে অচিরেই। আবার আধপেটা খেয়ে থাকা। তবুও, চরৈবেতি। উপার্জনের জন্য ঘুরেছেন বিভিন্ন প্রদেশে। অখাদ্য কুখাদ্য ভক্ষণে দিন কেটেছে। অনাহারে মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থেকেছেন গাছের নিচে। মড়া ভেবে পোড়াতে এসে প্রাণ বাঁচিয়েছিল ডোমেদের দল। এমন অবিশ্বাস্য জীবন বলেই বোধহয় তার হাত থেকে ডমরু বা কঙ্কাবতীর মতো আশ্চর্য লেখা বেরোয়। 


এত কিছুর পরেও শিরদাঁড়াটা সোজা। একটি পয়সার জন্যেও হাত পাতেননি কারো কাছে। বরং দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করতে পাশে দাঁড়াচ্ছেন মানুষের। এর উল্লেখ পাওয়া যাবে  আত্মকথনেই-- “তখন যৌবনের প্রারম্ভ। অতিশয় ক্ষুধা। একেকদিন সন্ধ্যাবেলা এরূপ ক্ষুধা পাইতো যে, ক্ষুধায় দাঁড়াইতে পারিতাম না। মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইবার উপক্রম হইত। তখন পেট ভরিয়া কেবল এক লোটা জল খাইতাম। তাহাতে শরীর কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইত। এরূপ করিয়া যাহা কিছু যৎসামান্য রাখিতে পারিতাম দুর্ভিক্ষ পীড়িত নরনারীদের দুঃখমোচনের চেষ্টা করিতাম ও বাড়িতে পাঠাইতাম। সেই সময় হইতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম ভবিষ্যতে যাহাতে এই স্বর্ণভূমি ভারতভূমিতে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত না হইতে পারে এইরূপ কার্যে আমার মনকে নিয়োজিত করব।”


শেষবয়সে কিন্তু খ্যাতির শিখরে পৌঁছলেন ত্রৈলোক্যনাথ। ভারতীয় শিল্পদ্রব্য ও পুরাতত্বের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি। স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়া ইংল্যান্ডে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাকে। কিন্তু এত বৈভব-সম্মানেও ভোলেননি স্বদেশপ্রীতি। এর কারণ, এক অদ্ভুত আত্মম্ভরিতা। ত্রৈলোক্যনাথ বরাবর নিজেকে সমাজ-সংস্কারকের আসনেই বসিয়েছেন। নিজের সম্পর্কে তার এই ধারণা বর্ণিত হয়েছে ছত্রে ছত্রে, ‘‘বিলাতে যাইলে মহারানি প্রভৃতি আমাকে যথোচিত সম্মান করিয়াছিলেন। যাহাদের কৃপাকটাক্ষে লোকে রাজা মহারাজা হইতে পারে, তাহারা সমকক্ষভাবে আমার সমাদর করিয়াছিলেন। কিন্তু বিলাত যাইয়া যাহাতে স্বার্থ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র আমি কোনো বিষয়ে লাভবান না হই, যাহাতে স্বার্থ-চিন্তা আমার হৃদয়ে স্থান না পায়, এ বিষয়ে আমাকে বিশেষরূপে সতর্ক হইতে হইয়াছিল। যদি উচ্চপদ উচ্চ উপাধি লইয়া আসিতাম, তাহা হইলে, পাঠক! আজ তোমাদিগকে আমি শিক্ষা দিতে পারিতাম না। জনসাধারণকে লোকে যেভাবে বিচার করিয়া থাকেন, আমার প্রতি যিনি সেইভাব আরোপিত করিতে যাইবেন, তিনি ঘোরতর ভ্রমে পতিত হইবেন।’’


কে জানে, হয়তো আড়ালে লোকশিক্ষেই দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাঙালি পাঠক তাকে কেবলই উদ্ভট-সাহিত্যের দিকপাল হিসেবেই মনে রেখেছে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.