মাতৃত্বের টানে ছুটে আসা, শেষমেশ মৃত্যু

 


ODD বাংলা ডেস্ক: জলপাইরঙা সাগর কাছিম (Olive ridley sea turtle) সাগরের কচ্ছপগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে এদের পান্না কাছিমও বলা হয়। খোলসের জলপাই সবুজ রঙটাই এই নামের উৎস। কাছিমের এই প্রজাতিটি গ্রীষ্মপ্রধান উপকূলে বাস করে। বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগর, দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর এলাকার উষ্ণ জলে এদের বেশি বসতি। বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের কিছু কিছু দ্বীপে এদের দেখা মেলে।

জলপাইরঙা সাগর কাছিমের গড় ওজন ৪৬ কেজির মতো। হাল্কা গড়নের এই কাছিমের খোলস উঁচু গম্বুজের মতো, পিঠের খোলসের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭৬ সেন্টিমিটার (২.৫ ফুট)। খোলসের রঙ পিঠের দিকে গাঢ় জলপাই সবুজ আর বুকের দিকে হলদে সবুজ। পিঠের খোলসে পাশের দিকে সাধারণত ছয় জোড়া পার্শ্বখন্ড থাকে। তবে প্রকৃতিতে ৯ জোড়া পর্যন্ত পার্শ্বখন্ডের অধিকারী জলপাই সবুজ কচ্ছপও দেখা গেছে।


জীবনচক্রের নিয়মে সমুদ্রের মাঝ থেকে হাজার কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে একেকটি কচ্ছপ ডিম দিতে ছুটে আসে বালুচরের সৈকতে। সাধারণত রাতের আঁধারে সৈকতের বেলাভূমিতে উঠে আসে মা কাছিমের দল। গোপনে ডিম পেরে লুকিয়ে রাখে বালুর নিচে। ৬০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ডিমগুলো ফুটে বাচ্চা বের হয়।  


কিন্তু মানুষের অসচেতনতায় আবাসস্থল হারাচ্ছে এই প্রাণীটি। বাংলাদেশে যেসব এলাকায় তাদের দেখা যেত, তা ক্রমেই কমে এসেছে। মাছ শিকারকালে জেলেদের জালে জড়িয়ে মারা যায় কচ্ছপগুলো। বিক্রি কিংবা পরিবহন নিষিদ্ধ থাকায় মারা যাওয়া কচ্ছপগুলো বিচে ফেলে রেখে চলে যায় জেলেরা। অসাধু জেলেদের কারেন্ট জাল কিংবা বিহুন্দি জাল কচ্ছপের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। 


এমন কি সাগরে মাছ ধরা ট্রলার থেকেও বড় ভাসাজাল, ডুবোজাল, বিহুন্দি ও লাক্ষ্যা জাল পেতে রাখা হয় সাগরে। অপরদিকে মা হবার তাড়নায় ছুটে আসা এসব কচ্ছপ সেসব জালে আটকা পড়ে। জেলেরা ঝামেলা এড়াতে বৈঠা, বাঁশ, কাঠ বা ধারালো দা দিয়ে কচ্ছপগুলো নির্মমভাবে হত্যা করে সমুদ্রেই ফেলে দেয়। এসব মৃত কচ্ছপের নিথর দেহ জোয়ার কিংবা ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে আসে সৈকতে। এমন পরিণতি সহজেই প্রমাণ করে, মাতৃত্বের টানে ছুটে এসেই এসব কাছিমরা প্রাণ হারায়।  


এ ছাড়াও পর্যটন বিকাশের কারণে কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে অতিরিক্ত আলোকায়নে কূলে ফিরে কুকুরের আক্রমণেও প্রায়ই কচ্ছপ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। কাছিম বাঁচাতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সম্প্রতি সেন্টমার্টিন থেকে কুকুর সরানোর উদ্যোগ নেয়। তবে অবিবেচক প্রতিবাদে সেই উদ্যোগ স্থগিত হয়েছে। ফলে সুন্দর এই কচ্ছপটির বংশবিস্তার হুমকিতেই রয়ে গেল।


২০০১ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলো কচ্ছপ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। ফলশ্রুতিতে সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণ, কচ্ছপ বিষয়ক শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে সামুদ্রিক কচ্ছপ রক্ষায় অঙ্গীকার করে। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। 


সম্প্রতি ইউএসএইড এর অর্থায়নে ও নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) এর পরিচালনায় ইকো লাইফ প্রোগ্রামের আওতায় কক্সবাজারে ১৮৫টি জলপাইরঙা সাগর কাছিমে বাচ্চা অবমুক্ত হয়েছে। এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে দেশের প্রকৃতিপ্রেমীরা। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এমন উদ্যোগগুলো চলমান থাকবে বলে আশাবাদ বক্ত করেছে তারা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.