অসহায়ের সহায় ‘স্বপ্ন নিয়ে’

 


ODD বাংলা ডেস্ক: অগ্নিদগ্ধ মানুষের চিকিৎসা চাই, আর্তনাদে ভেঙে পড়েছে পরিবার। পা নেই, প্রতিবন্ধকতায় চলছে জীবন। দুরারোগ্য ব্যাধি ঝেঁকে বসেছে শরীরে, বাঁচার আকুতি। করোনায় আক্রান্তদের জীবন বাঁচাতে অক্সিজেন লাগবে, কর্মহীন মানুষকে খাবার দিতে হবে, শীতে জবুথুবু মানুষের শীত নিবারণ করতে হবে, জ্ঞানার্জনে খরচ চালাতে ব্যর্থ কাউকে সাহায্য লাগবে, সবারই সহায় হয়ে পাশে থেকেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বলছিলাম, ‘স্বপ্ন নিয়ে’ নামক একটি সংগঠনের গল্প।


মানুষের স্বপ্ন পূরণে গড়ে উঠেছে ‘স্বপ্ন নিয়ে’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। যেন তাদের ভাবনা একটাই, কীভাবে মানুষের উপকার করা যায়।


অগ্নিদগ্ধ ১১ জনের জন্য স্বপ্ন নিয়ে:


‘রামগতি ট্রাজেডি’ ছিল এক বেদনাদায়ক স্মৃতি। কক্সবাজারের সমুদ্রে মাছধরার ট্রলারে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লেগে ১১জন জেলে অগ্নিদগ্ধ হয়। তারপর তাদের শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ভর্তি করানো হয়। অগ্নি দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে দগ্ধ মানুষগুলোর দায়িত্ব নিতে কেউ এগিয়ে আসছিল না। এতে অসহায় অবস্থায় পড়ে জেলেরা। সে রকম সময়ে মানবিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে স্বপ্ন নিয়ে।


অগ্নিদগ্ধদের প্রতিদিন ১০-১২ ব্যাগ প্লাজমা এবং প্লাটিলেটের ব্যবস্থা, ঔষধ, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো, রোগীদের স্বজনের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসার নির্দেশনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ ও মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে এই স্বেচ্ছাসেবকরা। চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে তাদের পরিবারের জন্য গ্রামের বাড়িতে ২০দিনের খাবার ও ঈদ সামগ্রী দেয়া হয়। কেউ মারা গেলে হাসপাতালের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করা, থানায় জিদিসহ পোস্টমর্টেম ও ময়নাতদন্ত করানো, মৃতের স্নানের পরে এম্বুলেন্সে বাড়িতে পৌঁছানোসহ নানা কাজের সমাধানে কাজ করেছে এই সংগঠনটি।


স্বপ্ন নিয়ের বিভিন্ন সামাজিক কাজ:


প্রায় ৪০ এর অধিক ছাত্র-ছাত্রীকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কর্পোরেট অফিসে শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পডুয়া প্রায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে করে দেয়া হয়েছে ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা। চাকরিরও ব্যবস্থাও করে দেয়া হয়েছে অনেককে। 


৪২ জনের কৃত্রিম পা লাগানো, মাদক বিরোধী প্রচারণা, রক্ত সংগ্রহ করে দেয়া, তিনটি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণ, অসহায়দের হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা, প্রবীণদের জন্য স্বপ্ন নিয়ের নির্ভরতার লাঠি উপহার, গৃহহীনদের জন্য ঘর নির্মাণ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুক কর্নারের জন্য বই দেয়া, দরিদ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, দরিদ্র, মেধাবী ও দূর থেকে আসা ছাত্রদের সাইকেল উপহার, স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাতা বিতরণ, স্কুলে বৈদ্যুতিক পাখা উপহার, দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মধ্যে পোশাক বিতরণ, রিকশা চালক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রেইনকোট বিতরণ, বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তিদের চিকিৎসা চালানো, দুরারোগ্য ব্যাধিতে যারা ভুগছে- তাদের অপারেশনের ব্যবস্থা করা।


স্বপ্ন নিয়ের দুর্দান্ত প্রকল্প ‘স্বাবলম্বী প্রজেক্ট’ এর মাধ্যমে ২৪জনকে স্বাবলম্বী করা হয়েছে, বেড়িবাঁধ এলাকা পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দিয়ে পরিচ্ছন্ন রাখা, শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ, মাদ্রাসায় ও এতিমখানায় কুরআন বিতরণ, উপকূলীয় এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি, অসচ্ছল ছাত্র-ছাত্রী এবং পথ শিশুদের মধ্যে ঈদের পোশাক বিতরণের মতো দৃষ্টান্তমূলক কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।


স্বপ্ন নিয়ের করোনাকালের সেবা:


করোনাকালে তিন হাজার ৭০০টি অসহায় পরিবারের মধ্যে তিন লাখ ১০ হাজার বেলার খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে ‘স্বপ্ন নিয়ে’। নন-এমপিও ৪৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১২০ জন আয় বঞ্চিত অস্বচ্ছল শিক্ষককে এবং ২১ বিধবাকে দিয়েছে রমজানের এক মাসের খাদ্য সহায়তা। এ ছাড়াও সংগঠনটি ২২০জন চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের দিয়েছে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), বিনামূল্যে অক্সিজেন সাপোর্ট, জনসাধারণের জন্য ১২টি হ্যান্ডওয়াশ ব্লক স্থাপন, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, হ্যান্ডওয়াশ সামগ্রী ও লিফলেট বিতরণ, জীবাণুনাশক ছিটানো, দোকানের সামনে দূরত্ব চিহ্ন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাউন্সেলিং ও সাবান বিতরণ, বিভিন্নস্থানে ব্যানার স্থাপনসহ নানা সচেতনতামূলক কাজ করেছে স্বপ্ন নিয়ে। গত কয়েক বছরে স্বপ্ন নিয়ের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কয়েক লাখেরও বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়েছেন।


সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম হান্নান। যিনি পেশায় একজন ব্যাংকার হলেও সামাজিক কাজ তার নেশা। প্রতিনিয়ত যিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি করছেন অনন্য নজির। সব মহলে কুড়িয়েছেন ব্যাপক প্রশংসা। স্বপ্ন নিয়ে প্রসঙ্গে কথা হয় তার সঙ্গে। 


কিভাবে সামাজিক কাজের পথচলা শুরু? এমন প্রশ্নে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, ‘আমার বাবা ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে শহিদ হন। ওই দুঃসময়ে আমাদের অসহায়ত্বের মুহূর্তগুলো সব সময় অন্যের বিপদে বা খারাপ সময়গুলোর সঙ্গে মনের অজান্তেই মিল করে দেয়। ওই অনুভূতি থেকে সব সময় কারো বিপদ বা অসহায়ত্ব দেখলে তাদের পাশে দাড়িয়ে সহযোগিতা করতে ইচ্ছে হয়। সব সময় মনে একটা তাড়া কাজ করে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর। ২০১৬ সালে আমার উদ্যোগে স্কুলের পুনর্মিলন হয়। প্রথমে ভাবিনি এতো বেশি সাড়া পাব। স্কুলের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে- ভালো কাজ করলে, মানুষের কল্যাণে কাজ করলে মানুষ এগিয়ে আসে এবং বিভিন্নভাবে সাপোর্ট দেয়। মানুষের অসহায়ত্বের প্রতি দরদ আর ভালো কাজে মানুষের অনুপ্রেরণার মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং অসহায় মানুষদের কল্যাণের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি এবং মনের শান্তির জন্য কাজ করতে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো শুরু।’


‘শুধু আমাদের যে তাই নয়, যেকোনো সেচ্ছাসেবী সংগঠনের জন্য অর্থ একটি বিরাট সমস্যা। তারপরেও আমাদের যখন যে প্রকল্পগুলো শুরু হয়েছে, সবার সহায়তায় আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফল হয়েছি। আমরা যখন কোনো কাজ শুরু করি, আমাদের মাথায় থাকে মানুষের কল্যাণে নেয়া কোনো উদ্যোগে বন্ধ হয়ে থাকে না। হয়তো সাময়িকভাবে বিলম্ব হয়। কিন্তু তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। এভাবেই আমরা মানুষের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যাব।’ বলছিলেন আশরাফুল আলম হান্নান।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.