ডিম কিভাবে অতীতের কথা বলে!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ২০০ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে ডিম পাড়ছে পাখি, সরীসৃপ, ও ডাইনোসর। অবশ্য এ তালিকায় আছে দুই প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীও!


আদিকাল থেকেই মানুষ ডিমকে ব্যবহার করেছে পুষ্টিকর খাবার হিসেবে। ডিমের খোসা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পাত্র, বোতল, ও অলংকার।


অতীত সম্পর্কে জানার জন্য বিজ্ঞানীদের কাছে জীবাশ্ম হাড় ও কঙ্কাল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জীবাশ্ম ডিমের খোসা থেকেও পাওয়া যায় দারুণ সব তথ্য।


ডিমের খোসা থেকে জানা যেতে পারে প্রাগৈতিহাসিক আমলের প্রাণীর আচরণ ও খাদ্যাভ্যাস, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাচীন মানুষদের যোগাযোগ পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে।


ডাইনোসরের শরীরের তাপমাত্রা


ডাইনোসরদের রক্ত কি লিজার্ডদের মতো শীতল ছিল, নাকি পাখিদের মতো উষ্ণ; এই প্রশ্ন দীর্ঘসময় ধরে জীবাশ্মবিদদের (পেলিয়নটলোজিস্ট) দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছিল।


ডাইনোসরের ডিমের একটি অংশ

এরপর একটি জীবাশ্ম ডাইনোসরের ডিমের খোসা বিশ্লেষণ করে জানা গেল, আদতে ডাইনোসরের রক্ত উষ্ণই ছিল। গবেষকেরা ডিমের জীবাশ্ম খোসার অক্সিজেন ও কার্বন কণার বিন্যাস বিশ্লেষণ করে মা ডাইনোসরের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজি ও জিওফিজিক্স বিভাগের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পিনসেলি হল বলেন, 'ডাইনোসরের ভেতর তৈরি হওয়ায় ডিমগুলো বহুপ্রাচীন থার্মোমিটারের মতো কাজ করে।'


গবেষণা অনুযায়ী, ডাইনোসরের চারপাশের পরিবেশের যে তাপমাত্রা থাকার কথা, তার চেয়ে তাদের দেহ বেশি উষ্ণ ছিল। ডাইনোসর শরীরের অভ্যন্তরেও তাপমাত্রা উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল বলে ধারণা পাওয়া গিয়েছে ওই গবেষণায়।


বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর পাখিকে পোষ মানিয়েছিল মানুষ


মানুষ কোন পাখিকে সবার আগে পোষ মানিয়েছিল? অনেকেই ভাববেন হাঁস বা মুরগি।


কিন্তু পাপুয়া নিউগিনিতে পাওয়া ডিমের খোসার ফসিলের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাসোয়ারি নামক এমু-জাতীয় এক প্রকার পাখিকে সবার আগে পোষ মানিয়েছিল মানুষ।


ক্যাসোয়ারি পাখির দুই পায়ের থাবাগুলো ছুরির মতো। এজন্য এটিকে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর পাখি হিসেবে তুলনা করা হয়। আনুমানিক ১৮ হাজার বছর আগে এটিকে পালতে শুরু করে মানুষ।


ওই গবেষণায় প্রায় এক হাজারের বেশি জীবাশ্ম ডিমের খোসার টুকরা বিশ্লেষণ করা হয়। ক্যাসোয়ারি পাখির চেহারাকে ডাইনোসরের সাথে তুলনা করা হয়। ওই খোসাগুলো পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে, ডিমগুলো থেকে মানুষের সহায়তায় বাচ্চা ফোটানো হয়েছে, ওগুলো খাওয়া হয়নি।


কিছু ডাইনোসর যত্নবান মা-বাবা ছিল


১৯২০ সালে মঙ্গোলিয়াতে প্রথমবারের মতো টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো দেখতে মুখবিশিষ্ট ওভির‍্যাপ্টর ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যায়।


ওই ডাইনোসরের ফসিলের পাশে একটি বাসা ও ডিমের ফসিলও পাওয়া যায়। তখন বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন ডাইনোসরটি ওই ডিমগুলো চুরি করেছিল। সেজন্য তারা ডাইনোসরটির নামকরণ করেন 'ডিম চোর'। ওভির‍্যাপ্টোরসরিয়া শব্দের অর্থ 'ডিম চোর লিজার্ড'।


এরপর ১৯৯০-এর দশকে আরেকটি অনুসন্ধানে জানা যায়, আদতে ওই ডিমগুলো ওভির‍্যাপ্টরেরই ছিল। এরপরের কয়েকটি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ওভির‍্যাপ্টর ডাইনোসরগুলো মা-বাবা হিসেবে খুবই যত্নশীল ছিল। ডাইনোসরগুলো আধুনিক পাখির মতোই বাসা তৈরি করে ডিম পেড়ে সেখানে সযত্নে বাচ্চা পালন করতো।


কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরির জিওসায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও ডাইনোসরের ডিম বিশেষজ্ঞ ডারলা জেলেনিত্সকি বলেন, 'ওই ফসিল থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ডিমগুলোকে খুব সুন্দর করে বাসায় সাজানো হয়েছিল। বোধহয় ডিমের ওপর ভালোভাবে বসার জন্য গোলাকৃতি করে সাজিয়েছিল মা ডাইনোসর।'


ওই সাইটগুলোতে পাওয়া ডাইনোসরের ডিমের ফসিলের ভেতর বাচ্চা ডাইনোসরের সুন্দরভাবে সংরক্ষিত দেহাকৃতি থেকে বোঝা যায়, আজকের পাখিদের অনেক বৈশিষ্ট্য ডাইনোসর থেকে এসেছে।


ডিমের খোসার মালায় তৈরি হয় প্রথম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম


আফ্রিকার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে উটপাখির ডিমের খোসা পাওয়া গিয়েছে। প্রথমদিকের মানুষ এ খোসাগুলোকে জলের বোতল হিসেবে ব্যবহার করতো।


কয়েক হাজার বছর ধরে প্রাচীন মানুষ ডিমের খোসার অবশিষ্টাংশ দিয়ে গুটি ও মালা তৈরি করতো। আজকেও এমন অলংকার তৈরির ঐতিহ্য টিকে আছে।


আফ্রিকার অনেক স্থানেই এরকম ডিমের খোসা থেকে তৈরি গুটি পাওয়া গিয়েছে। এমনকি যেসব স্থানে উটপাখি কখনো বাস করেনি, সেখানেও এসব গুটি পাওয়া যায়। এর ফলে বিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়, সেখানে এ গুটিগুলো এলো কী করে।


ওই উত্তর পাওয়া গেল ডিমের জিওকেমিস্ট্রিতে। ওই গুটিগুলোতে থাকা বিভিন্ন আইসোটোপের সিগনেচার পরীক্ষা করেন গবেষকেরা। সেখান থেকে তারা জানতে পারেন ওই গুটিগুলো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে।


গুটিগুলোকে একে অপরের সাথে বিনিময় করেছেন আদিম মানুষেরা। আর এটাকেই বিবেচনা করা হচ্ছে প্রাচীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে।


বিলুপ্তি বিষয়ক জ্ঞান


বর্তমানে যেমন খাবারের একটি বড় অংশ হচ্ছে ডিম, প্রস্তরযুগের ক্ষেত্রেও খাবার হিসেবে সমাদৃত ছিল এটি।


আর এ ডিম খাওয়ার জন্য অনেক সময় মানুষ বিভিন্ন প্রাণীকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রাচীন অস্ট্রেলিয়ানদের প্রিয় ছিল জেনিয়রনিস পাখির ডিম। ৪৭ হাজার বছর আগে এ পাখি বিলুপ্ত হয়ে যায়।


অস্ট্রেলিয়ার ২০০টি প্রাগৈতিহাসিক স্থানে এ পাখির পোড়া ডিমের খোসার জীবাশ্ম টুকরা পাওয়া গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা, প্রাচীন মানুষ রান্না করে ডিমগুলো খেত। সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যেত এমন এমু পাখির ডিমের ওপর পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন তখন এমন কোনো প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটেনি অস্ট্রেলিয়ায় যার কারণে জেনিয়রনিস বিলুপ্ত হয়েছে।


তাই বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মানুষই জেনিয়রনিস বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে দায়ী।


জলবায়ু পরিবর্তন

পেঙ্গুইন, উটপাখি, ও এমুপাখির ডিমের খোসার ফসিল থেকে বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করতে পেরেছেন সুপ্রাচীন অ্যান্টার্কটিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, ও অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু কেমন ছিল।


ভিক্টোরিয়ান যুগের সময়ে পাখির ডিম ও আধুনিক যুগের পাখির ডিম পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, আগের চেয়ে এক মাস বেশি সময় আগে শিকাগোর বেশ কয়েক প্রজাতির পাখি বাসা বাঁধে ও ডিম পাড়ে।


এছাড়া পাখির খাওয়া পোকামাকড়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীরা। তার অর্থ, জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যে আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে বদলে দিতে শুরু করেছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.