একা একাই এত কিছু আবিষ্কার করেননি আইনস্টাইন



 ODD বাংলা ডেস্ক: থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কার করে আলবার্ট আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় বিপ্লব আনেন। এ তত্ত্বের বাইরেও আরও বেশকিছু যুগান্তকারী তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন আইনস্টাইন।


আইনস্টাইনকে নিয়ে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, তিনি নিজে নিজেই কারও সাহায্য ছাড়া এতসব আলোড়ন সৃষ্টিকারী আবিষ্কার করেছেন। তাকে সেজন্য 'নিঃসঙ্গ জিনিয়াস'ও বলা হয়। অর্থাৎ, আইনস্টাইনের যা আবিষ্কার সবই তার মৌলিক আবিষ্কার, অন্য কারও কাছ থেকে কোনো ধারণা নেননি তিনি।


কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে এভাবে হুট করে কারও একার চেষ্টাতে কি এত বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব? আইনস্টাইন কি সত্যিই নিজের ভাবনার জাল দিয়ে এতসব তত্ত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন, নাকি সে সময়ের অন্য বিজ্ঞানীদের কাজ থেকে ধারণা নিয়ে নিজের কাজগুলোকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন তিনি? চলুন জেনে আসা যাক আইনস্টাইনের আবিষ্কারক-জীবন কেমন ছিল।


আইনস্টাইনের আবিষ্কার করা তত্ত্বের তালিকায় রয়েছে ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট, স্পেশাল রিলেটিভিটি, ভরশক্তির সূত্র, জেনারেল রিলেটিভিটি ইত্যাদি। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তার অনুসন্ধানের অনেকগুলো পেপার প্রকাশ করেন। তার সেসব অনুসন্ধান সেসময় পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছিল। আইনস্টাইনের এ আবিষ্কারের সময়টুকুকে 'মিরাকল ইয়ার' বলা হয়। 


প্রচলিত বিশ্বাস, আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের জগতে মোটামুটি অনধিকার প্রবেশই করেছিলেন। কিন্তু সত্যিটা হলো, পদার্থবিজ্ঞানে তার বড় ডিগ্রি ও বিশদ অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা ছিল।


জার্মানিতে জন্ম নেওয়া আইনস্টাইন সুইজারল্যান্ড যান পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত পড়ার জন্য। ১৭ বছর বয়সে জুরিখে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে ডিপ্লোমা পড়তে শুরু করেন তিনি। ১৯০০ সালে জুরিখ থেকে নিজের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন আলবার্ট আইনস্টাইন।


সে সময় সুইস পেটেন্ট অফিসে কাজ নিয়েছিলেন আইনস্টাইন। একইসাথে পড়ালেখাও চালিয়ে গিয়েছিলেন। বন্ধু ও সহপাঠী মার্সেল গ্রসম্যানের সূত্রে ওই কাজটি পান আইনস্টাইন।


পেটেন্ট অফিসে কাজ করার সময় আইনস্টাইনকে প্রায়শই ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হতো। ওই সময়টাতে একদল পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ বন্ধুর সাথে পদার্থবিজ্ঞান পড়তে শুরু করেন আইনস্টাইন।


এ বন্ধুদলের মধ্যে ছিলেন আর্নস্ট মাক, ও হেনরি পয়েনকেয়ার। এ দুজনই ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ। স্বভাবতই তাদের কাজের সাথেও তখন পরিচয় ঘটে আইস্টাইনের। ওই সময়ই প্রফেসর আলফ্রেড ক্লেইনারের সাথে মিলে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন আলবার্ট আইনস্টাইন।


১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের উদ্ভাবনগুলো একেবারে শূন্য থেকে আসেনি। বরং, তিনি পরামর্শ ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন তার বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক, ও মেন্টরদের কাছ থেকে। একইভাবে তার প্রথম স্ত্রীরও ভূমিকা ছিল তার অর্জনে।


তার প্রকাশ করা পেপারগুলোতে তিনি প্ল্যাঙ্ক, লরেন্টজ, ফিটজেরাল্ড, থমসন, হেভিসিড, হাসেনর্ল, পয়েনকেয়ার প্রমুখ বিজ্ঞানীর পূর্ববর্তী গবেষণার সহায়তা নিয়েছিলেন আইনস্টাইন। আসলে, পয়েনকেয়ার আইনস্টাইনের আগেই ১৯০০ সালে স্বাধীনভাবে ভরশক্তির সূত্র E = mc² খুঁজে পেয়েছিলেন। খুব সম্ভবত আইনস্টাইন তার স্টাডি গ্রুপের অংশ হিসেবে পয়েনকেয়ারের ওই পেপার পড়েছিলেন।


আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব নিয়ে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ১৯০৭ সালের দিকে এই তত্ত্বের আবিষ্কার ছিল তার 'সবচেয়ে সুখী চিন্তা'। আইনস্টাইনের সাবেক প্রফেসর হারম্যান মিনকোওস্কি তার শিষ্যের আবিষ্কার সম্পর্কে বলেছিলেন, 'আমার জন্য এটা ছিল বিশাল আশ্চর্যের ব্যাপার। কারণ ছাত্রজীবনে আইনস্টাইনের মতো অলস আর একটাও ছিল না। গণিত নিয়ে তার কখনো বিশেষ মাথাব্যথা দেখিনি।'


পরে অবশ্য আইনস্টাইনের কাজের ওপর ভিত্তি করে স্থান-সময়ের তত্ত্ব গঠন করেন এ অধ্যাপক। ধারণা করা হয়, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের কিছু ভিত গড়ে দিয়েছিল হেনরি পয়েনকেয়ারের মঙ্গলগ্রহের ঘূর্ণন নিয়ে করা কাজ।


ইকুইভ্যালেন্স প্রিন্সিপল নিয়ে আইনস্টাইন ধারণা করলেও তার সাবেক সহপাঠী ও বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যানই নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির সাহায্যে ইউনিভার্সকে ইকুইভ্যালেন্স প্রিন্সিপলের স্পেইসটাইম ফ্যাব্রিক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।


১৮৬৯ সালে এলউইন ক্রিস্টোফেলন অ্যাবসলিউট ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাস-এর সূচনা করেন। আইনস্টাইনের সময়ে ১৯০০ সালে গণিতের এ ফিল্ডটিকে সম্পূর্ণ করেন গ্রেগরিও রিচি ও তুলিও লেভি-সিভিতা। ওই সময় অনেক গণিতবিদই এই ফিল্ড নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ডেভিড হিলবার্ট। তিনি তার গবেষণার মাধ্যমে এমন সমীকরণ প্রায় আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন যে তা আইনস্টাইনের অনেক আগেই বিশ্বের মাধ্যাকর্ষণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হতো।


মডার্ন আইনস্টাইন ফিল্ড ইকুয়েশন থিওরির পেছনে অবদান রেখেছিলেন ডেভিড হিলবার্ট। আইনস্টাইন-হিলবার্ট অ্যাকশন প্রিন্সিপল থেকেই পরে ফিল্ড ইকুয়েশন থিওরি তৈরি হয়।


বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্য এই নয় যে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের অবদানকে ছোট করে দেখা। তিনি অবশ্যই মহান একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। এ লেখায় কেবল এ ধারণাটাই পরিষ্কার করা যে আলবার্ট আইনস্টাইন কোনো 'লোন জিনিয়াস' ছিলেন না, তার আবিষ্কারগুলোর জন্য তিনি অন্য অনেক বিজ্ঞানীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা পেয়েছিলেন।


গত বছর আমি 'আইনস্টাইন না থাকলে কী হতো?' শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সেখানে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম, আইনস্টাইনের সময়ের অপরাপর বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা। আইনস্টাইন যদি জন্ম না নিতেন, তাহলে কী হতো?  তিনি না থাকলেও তার আবিষ্কারগুলো তার সময়ের বিজ্ঞানীরা কোনো একসময়ে নিজেরা খুঁজে পেতেন।


এমনকি জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্বও যদি আইনস্টাইন না দিতেন, তাহলে অন্য কোনো বিজ্ঞানীর হাত ধরে সেটি উপহার পেত পৃথিবীবাসী। তার সময়ের অনেকেই এই তত্ত্বের অনেক কাছাকাছি গিয়েছিলেন। আর তার চারপাশের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শ না পেলে, তাদের গবেষণা, আইডিয়াগুলো জানতে না পারলে আইনস্টাইন নিজে জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্বসহ তার অন্য যুগান্তকারী তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করতে পারতেন কিনা তা তর্কসাপেক্ষ।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.