কেন একজন ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: যেকোনো কাজে ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একজন ব্যবস্থাপকের দক্ষতা এবং পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার যোগ্যতার ওপরেই কাজের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। ব্যবস্থাপকের ছোট্ট ভুলও অনেক সময় বয়ে আনে ব্যর্থতা। সেইসঙ্গে, খারাপ ব্যবস্থাপনা কর্মীদের ওপরেও অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপ ও দুর্দশা বয়ে আনতে পারে। ধরুন, কর্মস্থলে আপনি কোনো ভুল করে বসলেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই আপনি গ্রাহকের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারেন। আপনাকে কটাক্ষ করে প্রশ্ন করা হতে পারে, "আপনার ম্যানেজার কে?" কর্মস্থলে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার বোধহয় আমরা কমবেশি সকলেই হয়ে থাকি। আপনি যদি একজন ব্যবস্থাপক হন, তাহলে আপনার যেকোনো ভুলের প্রাথমিক প্রভাব আপনার অধীনস্থ কর্মীর ওপর দিয়েই যাবে। তবে, এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আপনার ক্যারিয়ারের ওপরেও পড়তে পারে।


আবার, কেবল নেতিবাচক বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিলে তা ব্যবস্থাপক ও ব্যবস্থাপনার ভালো দিকগুলোকে আড়াল করে ফেলে। লক্ষ্যে পৌঁছাতে অধস্তন কর্মীরা নির্দেশনা অনুযায়ী যে কাজ করছে, তার প্রশংসা এবং ভুলগুলো শুধরে দেওয়া ব্যবস্থাপকের অন্যতম দায়িত্ব। এর মাধ্যমে তাদের চোখে যেমন একজন ব্যবস্থাপক 'ভালো ব্যবস্থাপক' হয়ে ওঠেন, তেমনি অধস্তনরা আরও উদ্যমের সঙ্গে কাজ করার স্পৃহা পান।


সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস লকডাউনের সময় ডিজিটাল যোগাযোগব্যবস্থার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবস্থাপকদের একাংশের অপ্রয়োজনীয়তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, অধস্তন ব্যবস্থাপকদের গুরুত্ব অনেকটাই কমেছে। কারণ মহামারিকালীন অনলাইনে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নিম্নপর্যায়ের একজন কর্মচারীর যোগাযোগ সহজে এবং কম সময়ে হয়েছে। যদি কর্মস্থলে এই যোগাযোগের প্রয়োজন পড়তো, তাহলে নিঃসন্দেহে সময় বেশি লাগতো, সেইসাথে 'অফিসের বসের সঙ্গে দেখা করা উপলক্ষ্যে' কিছু অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতারও প্রয়োজন হতো। অর্থাৎ, মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের কি-বোর্ডের বোতাম চেপেই যে প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপকদের প্রয়োজন মেটানো যায়- তা এই মহামারিজনিত লকডাউন আমাদের ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়ে গেল।


তবে এই সংকট একজন ভালো ব্যবস্থাপকের প্রয়োজনীয়তা বোঝতেও সাহায্য করেছে। একজন দক্ষ ব্যবস্থাপক কর্মীদের মাঝে সহযোগিতাকে উৎসাহ দেন, তারা সবার সঙ্গে স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করেন, তারা নৈতিকতা এবং সহানুভূতির সঙ্গে কাজ করেন এবং তারা গ্রাহকের নিকটতম অধস্তন কর্মীকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেন। যখন তারা কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেন, তখন এটি বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই 'বস' হিসেবে নয় বরং সর্বজনবিদিত 'নেতা' বা 'কমান্ডার' হিসেবে করে থাকেন। তারা আদেশ দেওয়ার পরিবর্তে তারা উন্মুক্ত আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেন এবং সবার মাঝে দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ বণ্টন করেন।


মহামারিকালীন এবং এর আগে উভয় সময়ের বিস্তৃত গবেষণায় দেখা গেছে, ভালো ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের জন্য অধরা সাফল্য বয়ে আনতে সক্ষম। আশ্চর্যজনকভাবে, যেসব সংস্থা লকডাউনের আগে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতো, সেগুলো লকডাউনের সময় দূরবর্তী অনলাইন মাধ্যমে আরও ভালোভাবে পরিচালিত হয়েছে। অনলাইন কাজে নিজেরদের অভ্যস্ত করার পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠানের বিক্রিও বেড়েছে কর্মী ও ব্যবস্থাপকদের দক্ষতায়। একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখবো, মহামারি পরিস্থিতির আগের তুলনায় এখন আমাদের দেশে অনলাইন কেনাকাটা কী পরিমাণ বেড়েছে! ঘরের দৈনন্দিন বাজার থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, জুতা, এমনকি আসবাবপত্র পর্যন্ত মানুষ এখন অনলাইনে অর্ডার করছে। এর ফলে একদিকে যেমন নিজের সময় বেঁচে যাচ্ছে, অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে আরেকজনের কর্মসংস্থান। আর এ সবকিছুই সম্ভব হচ্ছে দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।


ভালো ব্যবস্থাপনা যে গুরুত্বপূর্ণ একটি মানবিক গুণ, তা আমরা মহামারির দুই বছরে ভালোভাবেই উপলদ্ধি করতে পেরেছি। অস্ট্রেলিয়ান-আমেরিকান ব্যবস্থাপনা চিন্তাবিদ পিটার ড্রাকার বলেছেন, "ব্যবস্থাপনা হলো 'লিবারেল আর্ট' বা উদারনৈতিক শিল্প, কারণ এটি ব্যবহারিক ফলভিত্তিক কাজকে 'নৈতিক বিষয়গুলোর' সঙ্গে একত্রিত করে। এটি মানুষ এবং তার মূল্যবোধ, বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ে কাজ করে থাকে।"


'মানিয়ে চলা' বা 'মোকাবেলা করা'-কে আমরা 'ব্যবস্থাপনার' সমর্থক শব্দ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। ২০২০ সালের পর এখন এটি হয়তো অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, ভালো ব্যবস্থাপকরা কেবল নিজের টিমকে এক করে রাখার জন্যই বাহবা পাওয়ার যোগ্য। মাঝে মাঝে শুধু দুই/একটি প্রশ্ন ('কাজ কেমন চলছে?', 'কোনো সাহায্য প্রয়োজন আছে কিনা?') বা ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করার মাধ্যমেই তারা পুরো টিমকে ম্যানেজ করতে পারে।


ভিক্টোরিয়ান যুগের বিখ্যাত মনীষী জন রাসকিন নেতৃত্ব নিয়ে একবার বলেছিলেন, শ্রমিকের সুখ ৩টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে- "কাজটির জন্য তারা উপযুক্ত, এই অনুভূতি তাদের মধ্যে থাকতে হবে; নির্দেশনার বাইরে তাদের খুব বেশি কিছু করা উচিত নয়; এবং কাজের পর তাদের মধ্যে অবশ্যই সাফল্যের অনুভূতি থাকতে হবে।"


এই তিনটি শর্ত পূরণের জন্য ব্যবস্থাপকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবস্থাপককেই এই বিষয়টি তিনটি নিশ্চিত করতে হবে। যদিও কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সাফল্য বিরল একটি ব্যাপার, তারপরেও রাসকিনের শেষ শর্তটি ব্যবস্থাপককে বিশেষভাবে পূরণ করতে হবে। কারণ কর্মক্ষেত্রে বিজয়ের জন্য কর্মীদের মাঝে সাফল্যের অনুভূতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছোট ছোট অর্জনের মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে সামনে, এই অনুভূতি ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সকলের মধ্যেই থাকা চাই।


সুতরাং আপনি যদি একজন ব্যবস্থাপক হন এবং আপনার কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে লক্ষ্যপূরণ ও সফল হওয়ার অনুভূতি পেয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.