ডারউইনের মহাতীর্থে...

 


ODD বাংলা ডেস্ক: অবশেষে সারা পৃথিবী ঘুরে ঘরে ফিরলেন তরুণ প্রকৃতিপ্রেমিক, বিয়ে থা করে থিতু হলেন আপন ভুবনে। লন্ডন শহরের কোলাহল ছেড়ে কেন্ট কাউন্টির পাখির কূজন ভরা গ্রামে চলে গেলেন পরিবার নিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে; আসলে গবেষণা এবং নিবিড় চিন্তার জন্য।


কীসের এত চিন্তা তার? বিশ্ব ভ্রমণের সেই ৫ বছর মানুষটিকে আসলেই ভিতর থেকে আপাদমস্তক পাল্টে দিয়েছে, সেই সঙ্গে তিনি এটিও বুঝতে পারছেন, ভেতরের চিন্তা প্রকাশিত হলে এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি পরিবর্তিত হবে মানব সমাজ। কিন্তু পৃথিবী কি আদৌ প্রস্তুত এই জ্ঞানফলের জন্য! মানবসমাজের ওপর ভরসা পান না বিনয়ী, মহাজ্ঞানী আর অশেষ ধৈর্যধারী এই দার্শনিক। কিন্তু ঠিকই গভীর নিষ্ঠার সাথে চালিয়ে যান প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ। মনের অতল থেকে তুলে নিয়ে আসেন বিশ্বভ্রমণকালীন অদ্ভুত সব স্মৃতি যা তাকে দেয় বিশুদ্ধ আলোর সন্ধান। যে আলোকে বিশ্বকে অজ্ঞানতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করার জন্য আস্তে আস্তে রচনা করেন এক বিশ্ব পাল্টে দেওয়া পবিত্র গ্রন্থ, নাম তার- অন দ্য অরিজিন অব স্পেসিস বাই মিনস অভ ন্যাচারাল সিলেকশন, অর দ্য প্রিজারভেশন অব ফেভারড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ।


যদিও তার ইচ্ছে ছিল জীবদ্দশায় এই গ্রন্থ প্রকাশ না করার, কিন্তু মালয় দ্বীপপুঞ্জে গবেষণারত আরেক দিকপাল জীববিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের চিঠি এবং গবেষণাপত্র তার কাছে আসলে তিনি দেখেন বহু দশকের গবেষণার ফল অন্য বিজ্ঞানীর নামে চলে যাচ্ছে, মহানুভবতার পরিচয় দেখিয়ে একই সাথে রাসেল ও নিজের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং অবশেষে ১৮৫৯ সালে ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত হয় মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ। প্রথমবারে ছাপা ১,২৫০ কপি নিমেষে উধাও হয়ে যায় তপ্তভূমিতে বৃষ্টির প্রথম পতনের মত, আসতে থাকে একের পর এক সংস্করণ। এক পর্যায়ে প্রকাশকের চাপে নতুন সংক্ষিপ্ত নামে ছাপা হয় তুমুল আলোচিত এবং ভালোবাসার বিশুদ্ধ জ্ঞানের বইটি- অরিজিন অফ স্পেসিস।


কোথায় লিখেছিলেন তিনি এই সত্যদর্শনের গ্রন্থ? কেন্টের সেই বাড়িতেই, যেখানে ১৮৪২ সালে স্ত্রী এমা এবং দুই সন্তান নিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন, যেখানে ছিলেন আমৃত্যু, দীর্ঘ ৪০টি বছর সেখানে পরম মমতায় গড়ে তুলেছিলেন গবেষণাগার, ডুবে ছিলেন কত চিত্র-বিচিত্র রহস্যের সমাধানে। আমাদের আজকের যাত্রা সেই মহাতীর্থেই।


গ্রীষ্মের এক মঙ্গলবারে লন্ডন মহানগরীর বিকট ট্র্যাফিক জ্যামকে পিছনে ফেলে বিখ্যাত ইংলিশ কান্ট্রি সাইডে চক্ষু সার্থক করতে করতে সরু পথ ধরে একাধিকবার সবুজ বেষ্টনীতে গোত্তা খেয়ে অবশেষে ডারউইনের সেই বিখ্যাত বাড়ী পাওয়া গেল, যার ফটকে এক ধাতব ফলকে লেখা মহান বিজ্ঞানীটি জীবনের চার চারটি দশক এইখানেই অতিবাহিত করেছিলেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে বাড়ির দেয়ালে বেড়ে ওঠা সবুজ লতানো গাছগুলো দেখার আগেই বোঝা হয়ে গেল ভুল জায়গায় গাড়ি থামানো হয়েছে, রাস্তায় নেমে ছবি তোলার উপায় নেই। ঘুরিয়ে পার্কিংএ নিজে যেয়ে তবেই শান্তি।  


প্রথমেই টিকেট কাটার কক্ষ, সেখানে ডারউইনের লেখা বই যেমন থরে থরে সাজানো, তেমন শোভা পাচ্ছে তাকে নিয়ে লেখা বইও, এমনকি তার স্ত্রী এমাকে নিয়ে লেখা বইও আছে সেলফের এক প্রান্তে।


সেই সাথে আছে নানা স্যুভেনির, নকল জীবাশ্ম, বিগল জাহাজের ক্ষুদে মডেল, বিবর্তন এবং জীবজগত সম্পর্কিত নানা বই। তাদের আবেদন উপেক্ষা করে ১০ পাউন্ডের টিকেট কেটে ঢুকে পড়া হল জাদুঘর অংশটিতে, যদিও মেজাজ শুরুতেই খিচড়ে গেল বাড়িটির ভিতরে ছবি তোলা যাবে না শুনে! কী এক কপিরাইট আইনে জানি এমন স্মরণীয় মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কী ফালতু অজুহাত! আসলে নিজেরাই ছবি তুলে ভিউকার্ড হিসেবে বিক্রি করে, এই ব্যবস্থা মনোপলি করবার ফন্দি ছাড়া আর কিছুই না। যা হোক ছবি তো তোলা হবেই সুযোগ পেলে, কিন্তু আরাম মতো আর হলো না এই আর কি।


প্রথমেই সেই বিখ্যাত স্টাডিরুম, যেখানে বিজ্ঞানীপ্রবরের বিখ্যাত সোফা, দীর্ঘ জীবনের গবেষণার নানা নিদর্শন, তার কাজের টেবিলের কাছের চেয়ারটিতেই রাখা সেই বিখ্যাত কালো গোলাকৃতি টুপি, যা অমর হয়ে আছে মহান বিজ্ঞানীর স্মৃতির অংশ হিসেবে। তার সংগ্রহের বইগুলোতে চোখ বুলাতেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল, তাকের মাঝের বইটা যে ডাস ক্যাপিটাল, যা ডারউইনকে উপহার দিয়েছিলেন স্বয়ং কার্ল মার্কস!


কী অসাধারণ ইতিহাসের সাক্ষর বাড়িটির কোণে কোণে! আর তাদের মাঝে বিশেষভাবে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল এই ঘরটি, এইখানেই যে নিত্য বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতেন তিনি। এটি যেন ছিল এথেন্সের সেই প্রাচীন বিদ্যালয়ের নতুন সংস্করণ যেখানে শুদ্ধ জ্ঞান চর্চায় মেতে থাকতেন ডারউইন- হ্যাক্সলিরা।


বেশ বড় বাড়িটি, দোতলা-একতালা মিলিয়ে অনেকগুলো কক্ষ, প্রায় সবগুলোতেই সেই সময়ের আবহ ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে আসল আসবাবপত্র, জানালার পর্দা রেখে। কিছু বিশেষ কক্ষে কাঁচের দেয়ালের ভিতরে সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছে মহা মূল্যবান রোজনামচার খাতা- ডারউইনের একাধিক নোটবুক! যা তিনি বিগল যাত্রার সময়ে উরুগুয়ে এবং আর্জেন্টিনায় ব্যবহার করেছিলেন। সেই মহামতির সত্যিকারের হস্তাক্ষর পর্যন্ত স্পষ্ট পড়া গেল কাঁচের দেয়াল ভেদ করে।


এর পরপরই বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাখা অরিজিন অফ স্পেসিসের অতি দুর্লভ এবং দুর্মূল্য প্রথম সংস্করণের একটি কপি! আহা, যে বইটি নিজের একটি ইতিহাসে, চলমান বহমান ইতিহাস, যাকে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা শতবর্ষ পরেও। মনে পড়ে গেল এক তথ্যচিত্রে প্রিয় মুখ ডেভিড অ্যাটেনবোরো নিজের সংগ্রহ থেকে অরিজিন অফ স্পেসিসের ষষ্ঠ সংস্করণটি দেখিয়ে বলেছিলেন ১ম সংস্করণ সংগ্রহের অক্ষমতার কথা। এও মনে পড়ল এই তীর্থটি কিন্তু প্রথম দেখেছিলাম আরেক প্রিয় মুখ রিচার্ড ডকিন্সের বিখ্যাত তথ্যচিত্র দ্য জিনিয়াস অফ চার্লস ডারউইন-এ।


দুইতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠলে একপাশের মাঝারি আকৃতির কাঠের শোকেসে তরুণ জীববিজ্ঞানীর সংগৃহীত নানা পাখির চমৎকার সব নমুনা চোখে পড়ে, অধিকাংশই ক্রান্তীয় অঞ্চলের বৈশিষ্টমণ্ডিত, রং ঝলমলে পালকাবৃত। যদিও বিগল যাত্রার সময়ে তার সংগৃহীত অসাধারণ সব নমুনা, যা কিনা ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি করে ছিল সেই সময়ে, প্যাতাগোনিয়ার বিলুপ্ত বিশালদেহী স্লথের জীবাশ্মসহ প্রায় সবগুলোই স্থান পেয়েছে অন্যসব জাদুঘরে। তারপরও নজর ভরে দেখে গেলাম প্রায় দুইশ বছর আগে সংগ্রহ করা রত্নগুলো, যেগুলো সেই তরুণ জীববিদ সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত হন নি, জীবনের শেষ বছরগুলো এর গ্রহণযোগ্য বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দেবার সফল চেষ্টা করেছেন।


এক জায়গায় সেই বিচিত্র বইগুলোর সমাহার যেখানে না বুঝে, না বোঝবার চেষ্টা করে, সম্পূর্ণ অন্যায়, অন্যায্য, ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে জীববিজ্ঞানের শ্বাসত রহস্য বিবর্তনকে এবং সেই আক্রমণের স্বীকার হয়েছেন স্বয়ং চার্লস ডারউইন। অরিজিন অফ স্পেসিস প্রকাশের পর থেকেই এমন মূর্খদের বিশেষ করে প্রচলিত ধর্মের ধ্বজাধারীদের তোপের মুখে পড়ে তার তত্ত্ব, এবং এখনো নিরন্তর চেষ্টা চলে বিবর্তনকে ভুল প্রমাণ করার! কিন্তু সেটি তো আর সম্ভব নয়, তাই গায়ের জোরে একজন হারুন ইয়াহিয়া ঘোষণা করে বিবর্তন সঠিক এটি প্রমাণ করতে পারলেই সে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেবে! একজন জাকের নায়েক বিবর্তন সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা না নিয়ে কথার ফুলঝুরি দিয়ে তা মিথ্যে প্রমাণ করতে গিয়ে উল্টো করে যায় মিথ্যের বেসাতি। আর মানুষ–বানরের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা, যা ডারউইন তত্ত্বের সাথে কোনমতেই খাপ খায় না, সেগুলোর কার্টুন আর এমন কিছু বস্তাপচা বই দেখে মনে হল এগুলোতো ইতিহাসের অংশ নয়, এগুলো হচ্ছে আস্তাকুড়ের আবর্জনা, কিন্তু এগুলো রাখা হয়েছে মানুষকে এটা শিক্ষা দেবার জন্য- তোমার যা ইচ্ছা বিশ্বাস কর, সত্য সত্যই। একদিন তা প্রকাশ পাবেই, তোমরা মানো বা না মানো।


লন্ডনের ন্যাশনাল হিস্ট্রি মিউজিয়মে ডারউইনের প্রতিকৃতির সামনে লেখক

করিডোরে ডারউইনের বেশ প্রমাণ আকারের ধাতব ভাস্কর্য, ঘরের দেয়ালে চমৎকার পোট্রের্ট। একাধিক কক্ষে মাথা খাটানোর মজার খেলা, সবই জীবজগত সম্পর্কিত। কিন্তু আরও বিশাল আকর্ষণ তখন রয়ে গেছে আমাদের জন্য, বাড়ীর বাহিরে! বাগান, ডারউইনের বাগান!


বেশ ছড়ানো বাগানটিতেই তিনি প্রতিদিন অতিবাহিত করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, গ্রিনহাউজ গড়ে তুলে মেতেছিলেন উদ্ভিদজগতের নানা রহস্যের দিকে আলোকপাত করতে। তিনি বিশেষ উৎসাহী ছিলেন অর্কিড এবং পতঙ্গভুক উদ্ভিদের ব্যাপারে, গ্রিন হাউসটিতে বর্তমানেও এই দুই জাতের গাছের সংখ্যা অনেক বেশী। অনেক ভিতরের অনেক ঘরে আবার ছিল মৌমাছির কৃত্রিম মৌচাক! সেটির বাহিরেও খোলা আকাশের নিচে নানা বাহারি বর্ণের ফুলের সমাহার, যদিও বাগানে এখন আলু, ধনে গাছও লাগানো হয়েছে।


শুনেছিলাম ডারউইনে কেঁচোদের উপরে সঙ্গীতের প্রতিক্রিয়া নিয়েও গবেষণা করেছিলেন, যদিও এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে কোন সদুত্তর পেলাম না, তাই চললাম বাগানের শেষ প্রান্তে সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে সেই বিখ্যাত মেঠো পথটির দিকে যার নাম স্যান্ড পাথ, বালির পথ- এইখানেই প্রত্যহ পায়চারী করতে করতে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো চিন্তা করতেন আমাদের বিজ্ঞানী, বলা হয়ে থেকে এই পায়চারী তার শরীর চর্চার অংশ হিসেবেও কাজ করত, কিন্তু প্রতিদিন ঠিক কতখানি হাঁটলেন এই চিন্তা যেন তাকে বিব্রত না করে তাই পথের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কিছু খণ্ড খণ্ড পাথর রেখেছিলেন তিনি, প্রতিবার পাশ দিয়ে যাবার সময় একটি পাথর লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিতেন, ফলে পরের বার কাছে আসলে খুব সহজেই বুঝতে পারতেন কতখানি দূরত্ব অতিক্রম করেছেন পদব্রজে! ১৮৮২ সালের ১৯ এপ্রিল ৭৩ বছর বয়সে মহাপ্রয়াণের আগ পর্যন্ত তিনি এই বাড়িতেই ছিলেন, এবং তার স্ত্রী এমাও ১৮৯৬ সালে জীবনপ্রদীপ নেভার আগ পর্যন্ত এইখানেই থাকতেন।


আমরাও হাঁটলাম ডারউইনের পথে, চোখে-মুখে রোমাঞ্চ নিয়ে, ভালোলাগার বিহ্বলতায়, ভালোবাসার আবেগে, সত্যিকারের জ্ঞানতীর্থে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.