শেষ বিদায় নিয়েই জঙ্গলে যান মৌয়ালরা

 


ODD বাংলা ডেস্ক: সেরা মধুর প্রাপ্তিস্থান প্রসঙ্গে বলতে গেলে, সুন্দরবনের নামটি সবার প্রথমে থাকবে। বনের প্রকৃতি ও বন্য জীবন দেখতে পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণ করেন। ফেরার পথে খাঁটি মধু খোঁজেন অনেকেই। তবে কীভাবে সুন্দরবনের এই খাঁটি মধু সংগ্রহ হয়, তা অনেকেই অজানা। আজকের লেখাটি সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ প্রসঙ্গে। মৌয়ালদের কাছে, এ যেন এক জীবননির্ভর অভিজ্ঞতা। 

প্রতি বছর সাধারণত এপ্রিল-জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা হয়। সুন্দরবনের কাছের গ্রামের মৌয়ালেরা এ সময়ে মধু সংগ্রহ করতে বনে যায়। সাতক্ষীরা জেলার বুড়িগোয়ালিনীর অনেক মানুষ মধু সংগ্রহের কাজ করেন। এ ছাড়া রূপসা, পশুর, চুনকুড়ি, শিবসা নদীর আশপাশের জনপদে অনেকেই এই পেশায় জড়িত। 


সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ বেশ কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ এখানকার বাস্তবতা। প্রতিবছরই বাঘের আক্রমণে অনেক মৌয়াল প্রাণ হারান, এ ছাড়া বিষধর সাপের ভয় তো আছেই। আর তাই, যে মৌয়ালরা বনে ঢুকবে, তারা ঢোকার আগের দিন মিলাদের আয়োজন করেন। মিলাদে মৌয়ালদের নিরাপদ যাত্রা ও সাফল্যের জন্য দোয়া করা হয়।


বাদাবনের কাদা, শ্বাসমূল আর ঝোপ পেড়িয়ে মধু সংগ্রহ করতে বহু বছরের অভিজ্ঞতা আর দক্ষতাই মৌয়ালদের একমাত্র ভরসা। তাই যাত্রার আগের দিন তারা পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেন, পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ করে দেন। এ যেন জেনেশুনে স্বেচ্ছায় নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। তবুও কিছু বাড়তি আয় করার আশায় জীবিকার তাগিদে প্রতিবছর হাজারো মৌয়াল পাড়ি জমান সুন্দরবনের গহিনে।


মৌয়ালরা কমপক্ষে ১৫ দিনের জন্য জঙ্গলে প্রবেশ করেন, তাই এ প্রবেশের আগের দিন তারা বেশ ব্যস্ত থাকে প্রস্তুতি নিয়ে। নৌকা মেরামত করে রং করা, ১৫ দিন জঙ্গলে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করা—এসব নিয়ে বেশ ব্যস্ততা থাকে তাদের। যাওয়ার দিন সকাল হতেই নৌকায় মৌয়ালেরা জড়ো হতে শুরু করে। প্রতিটি ডিঙি নৌকায় সাত-আটজন করে মৌয়াল বনে যায়। তাদের একজন নেতা থাকেন, যাকে ‘বহরদার’ বলা হয়। ফরেস্ট স্টেশন থেকে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহের পাস দেওয়া হয়। পাস সংগ্রহের পরই মৌয়ালেরা বাইচ করে পাল্লা দিয়ে সুন্দরবনের দিকে এগোতে শুরু করে। সবার আগে সব থেকে ভালো জায়গা খুঁজে বেশি মধু সংগ্রহ করাই তাদের উদ্দেশ্য থাকে।


যেখানে মৌচাক থাকার সম্ভাবনা বেশি, এমন একটা জায়গা পছন্দ করে মৌয়ালেরা। যতটা সম্ভব নিজেদের আবৃত করে নেয়, যাতে মৌমাছির আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করা যায়। যদিও দক্ষ মৌয়ালরা এসবের বালাই করলেন না। মৌয়ালেরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মৌচাক খুঁজতে খুঁজতে চলার সময় পটকা ফাটিয়ে ‘আল্লা আল্লা বলরে’সহ নানা চিৎকার করেন। এতে বাঘ ভয় পেয়ে দূরে থাকে।


মৌচাকের খোঁজে এ যাত্রাকে মৌয়ালদের ভাষায় বলা হয় ‘ছাটা’ দেওয়া। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মৌয়ালরা হাঁটে, যা বেশ কঠিন। কারণ, শ্বাসমূল, আঠালো কাদা, কোথাও হাঁটু জল আবার কোথাও বুক সমান জল থাকে। 


এমন ঘন জঙ্গলে বাঘের সামনে পড়লে দৌড়ে পালানোর কোনো পথ থাকে না। ঝোপ-জঙ্গল আর কাদাজল পেড়িয়ে হাঁটার পর মৌয়ালেরা মৌচাক খুঁজে পায়। কোনো চাকে মধু কম থাকে, আবার কোনোটিতে কম। 


কাজের সময় কেউ উচ্চ শব্দে কথা বলে না, তাতে মৌমাছির আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবুও মৌমাছিরা এসে মৌয়ালদের আক্রমণ করে। মৌমাছির হুলে নাজেহাল অবস্থা হয় তাদের। হুল ফোটানো থেকে বাঁচতে জলে লাফ দিলেও মৌমাছির হাত থেকে রক্ষা হয় না। মৌমাছিরা তাড়া করতে বেশ পটু। তবে, আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ানো যায়। আর সেই কৌশলই নেয় মৌয়ালরা। 


মৌয়ালেরা শুকনা পাতা জোগাড় করে একত্র করে আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে। একে তারা ‘কারু’ বলে থাকেন। কারু তৈরি হয়ে গেলে তাতে আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে চাকের নিচে ধরতেই মৌমাছিরা সরতে শুরু করে। এ ফাঁকে একজন দ্রুত গাছে উঠে অল্প সময়েই চাক কেটে ফেলেন। কাটা টুকরাগুলো বাঁশ দিয়ে বিশেষভাবে বানানো একটি ঝুড়িতে রাখেন তারা। কাজ শেষে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করে। ফের শুরু হয় নতুন চাকের সন্ধান। এভাবেই চলে মধু আহরণ। 


ঠিক ভর দুপুরে ছাটা দিতে তাদের গুরুজনদের নিষেধ আছে। তাই তাদের কথা মেনে দুপুর বেলায় চাক কাটেন না মৌয়ালেরা। প্রতি মুহূর্তে গা ছমছম করা অনুভূতি এখানে, এই বুঝি বাঘ এল। প্রতিকূল দুর্গম বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা কিংবা মৌমাছির আক্রমণ সবই যেন জীবননির্ভর অভিজ্ঞতা।


কম হলেও দুই সপ্তাহ বনেই কাটে মৌয়ালদের। রাতে নৌকায় ঘুমান, তাদের মধ্যেই একজন নৌকায়ই রান্না করে। এমন করেই শেষ হয় মধু সংগ্রহ অভিযান। দিন-রাত জঙ্গলে কাটিয়ে বাড়ি ফিরবেন তারা। কেউ ফিরবেন, হয়তো কেউ যেতে পারেন বাঘের পেটে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.