কিছু মানুষ কেন সব সময় লেট-লতিফ!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: আমাদের আশেপাশে এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কেউ কেউ অন্যের কাঁধে কাজের ভার চাপিয়ে দায়মুক্তির কৌশল জানেন, কিন্তু অধিকাংশেই অপচয় করছেন মূল্যবান সময়। কাজের চাপ একান্ত জরুরি না হওয়া পর্যন্ত, তাদের হেলদোল দেখা যায় না। ফলে শেষমুহূর্তে এসেও ডেডলাইন মিস করেন। 


শুধু অফিসের কাজেই নয়, এর ছাপ তারা রাখেন ব্যক্তিগত কাজেও। নতুন ডেটের সাথে ডিনারের নিমন্ত্রণেও আধাঘণ্টা/ এক ঘন্টা- পর না আসলে যেন তাদের গতানুগতিকতাই রক্ষা হয় না। 


কর্মজীবন হোক বা ব্যক্তিগত সময়- অপেক্ষা করানোই যাদের অভ্যাস—তাদের ওপর আমাদের বিরক্ত না হয়ে উপায় থাকে না। তবে সহকর্মী হোক বা আপনজন, যার প্রতীক্ষায় বিরক্ত হচ্ছেন—জেনে রাখুন হয়তো তিনি নিতান্ত স্বার্থপরের মতো এমনটা করেন না সব সময়। দেরির এই মানসিকতার গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, মনোজগতের কিছু ত্রুটির কারণেই এমনটা হয়। তবে নিরাশ হবেন না- তা সারাইয়ের উপায়ও আছে। 


সমাধান জানার আগে দরকার কিছু ভুল ধারণার অবসান। তাহলেই জানা যাবে, দেরি রোগ সমাধানের মহৌষধ।  


দেরি করা মানুষরা কী সত্যি বিনয়হীন আর অলস?


সময়ানুবর্তী নয়, এমন লোকের ব্যাপারে সবার ধ্যানধারণা চিরকালই নেতিবাচক- তবে বেশিরভাগ সময়েই তা ভুলভাবে বিশ্লেষিত। 


লন্ডনবাসী কগনিটিভ বিহ্যাভেরিয়াল থেরাপিস্ট ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট হ্যারিয়েট মেলট বলছেন, "সহজেই তাদের অগোছালো, বিশৃঙ্খল, রুঢ় বলে ধারণা তৈরি হয়। মনে করা হয়, অন্যের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কেও তারা উদাসীন। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমি এমন অনেক রোগী পাই, ধৈর্য ধরে তাদের চিকিৎসা করি। কিন্তু, পেশার বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে কারো এমন গদাইলস্করি চালের শিকার হলে খুবই বিরক্ত হই।"  


সময়ানুবর্তীতাহীন ব্যক্তিরা আসলে এক ধরনের মানসিক সমস্যার শিকার, যাদের বলা যায় 'পাঙ্কচুয়ালি- চ্যালেঞ্জড'। অথচ একারণে অন্যদের কতোটা বিরক্তি উদ্রেক হতে পারে বা কাজের কতোটা ক্ষতি হতে পারে- তা নিয়ে কিন্তু তারা ভালো করেই বোঝেন এবং সে জন্য লজ্জা আর অপরাধবোধেও ভোগেন।  


দেরির স্বভাবের মানুষেরা আসলে কিছুটা কম সুশৃঙ্খল হলেও তারা কিন্তু বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা অফিসের বড় কর্তাকে আসলে খুশিই রাখতে চান। দেরি তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে, সম্মান ও ক্যারিয়ারে কতোটা ক্ষতিকর হতে পারে- তাও তাদের অজানা নয়। 

'নেভার বি লেট এগেইন' বইয়ের লেখিকা ডায়ানা ডিলোনজোর বলছেন, "বিকারগ্রস্ত কিছু মানুষ ইচ্ছে করে অন্যদের প্রতীক্ষায় রেখে আনন্দ পায়। তাদের কথা সত্যিই আলাদা। আপনি যদি সাধারণ সমস্যাভুক্তদের কাতারে পড়েন, তাহলে আপনি দেরি করতে একদম পছন্দ করেন না। অথচ, চটপটে না হওয়াটাই এক্ষেত্রে আপনার শত্রু হিসেবে রয়ে গেছে।"


অজুহাত আর অজুহাত:


আকস্মিক দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার মতো কিছু ক্ষেত্রে দেরির অজুহাত সবাই মেনে নেয়। কিন্তু, অন্যগুলি মেনে নেওয়া সহজ নয়। নিয়মিত দেরি করাদের অনেকে সময়নিষ্ঠ হওয়ার চেয়ে বিভিন্ন জটিল চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন থাকাকে এজন্য অজুহাত দিয়ে নিজেকে ব্যতিক্রম হিসেবে জাহির করেন। কেউবা বলেন, কাজের চাপ বাড়লেই তারা বেশি সাবলীল পারফর্ম করেন, আর কেউবা দোষ দেন রাতে না ঘুমানোর স্বভাবকে। 


তবে দেরি করাকে একেক জনের মতামত নির্ভর বিষয়ও বলে উল্লেখ করেন লন্ডনের জোয়ানা নামের এক শিক্ষিকা। কিছু কাজে দেরির অভিযোগ নিয়ে তিনি মাঝমধ্যেই বিব্রত হন। এবিষয়ে তার মন্তব্য, "অনেক সময় কোনো বন্ধু হয়তো তার বাড়ি যেতে বললো। ফোনে জানালো, সাতটার পর যেকোনো সময় চলে আসতে পারো। কিন্তু, আমি আটটায় হাজির হলেই, তখন মুখ বেজার করে বসে।"


তাই বলা যায়, নিয়মিত দেরি করা হয়তো আপনার দোষ নয়, হতে পারে এটাই আপনার ধরন। নিয়মানুবর্তিতাহীন অনেকেরই ব্যক্তিত্বে আশাবাদের মাত্রাটা একটু বেশি থাকে। একেক জনের কাছে অতিবাহিত সময়ের ব্যক্তিগত উপলদ্ধিও ভিন্ন ভিন্ন হয়। অর্থাৎ, কেউ কেউ পাঁচ মিনিট বসে থাকলেই হাঁপিয়ে ওঠেন, কারো তাতে লাগে ৩০ মিনিট।    


ব্যক্তি-বিশেষে সময় সম্পর্কে ভিন্ন ধারণার প্রমাণ করতে ২০০১ সালে একটি মজার পরীক্ষা চালান সান ডিয়াগো স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেফ কন্টে। তিনি অংশগ্রহণকারীদের দুই ভাগে ভাগ করেন। প্রথম ধরন বা টাইপ-এ শ্রেণিতে রাখা হয় উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও প্রতিযোগী মনোভাবের ব্যক্তিদের। দ্বিতীয় বা টাইপ-বি'তে ছিলেন সৃজনশীল, চিন্তাশীল ও বিভিন্ন নতুন আইডিয়া নিয়ে ভাবতে অভ্যস্তরা। তিনি কোনো প্রকার ঘড়ি ছাড়াই কতক্ষণে এক মিনিট সময় পার হয়- তাদের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্ন রাখেন। দেখা যায়, ৫৮ সেকেন্ড পার হতেই টাইপ-এ'র অধিকাংশই এক মিনিট হয়ে গেছে বলে মত দেন। আর দ্বিতীয় দলের ব্যক্তিরা সেকথা জানান গড়ে ৭৭ মিনিট পর। 


নিজেই যখন নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু:

 

টেড টকের বক্তা ও নিজেকে সবকাজে 'লেট-লতিফ' দাবি করা টিম আরবান ২০১৫ সালে এক নিবন্ধে লেখেন, "আমার মতো মানুষরা আসলে নিজেকেই হারানোর এক অদ্ভূত তাগিদ অনুভব করে।" তিনি এমন ব্যক্তিদের (নিজেকেসহ অবশ্যই) নাম দেন- সিএলইপি বা ক্রনিকালি লেট ইনসেন পারসন। 


মজার কথাটি বাদ দিলে, বলা যায় দেরি করার রয়েছে হাজারো কারণ। অধিকাংশক্ষেত্রেই সে ব্যাখ্যা নিয়ে দেরিকারী ব্যক্তিরাই মানসিকভাবে দ্বিধা-সংশয় থাকেন। অনেক সময় একটি কাজকে সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে করতে চাওয়া মানুষেরাও অহেতুক দেরির দোষে অভিযুক্ত হন। অনেকে কিছু কাজে ভয় বা অবসাদ অনুভব করলেই স্বাভাবিক গতি হারান।  


যেমন স্কুল শিক্ষিকা জোয়ানার জন্য সবচেয়ে চাপের কাজ স্কুল রিপোর্ট লেখা। নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, "আমি কখনো রিপোর্ট জমা দেওয়ার ডেডলাইন দেই না। এতে মনে হতে পারে, কাজটির ব্যাপারে আমি যত্নশীল নই। আসলে আমি রিপোর্ট নিয়ে কয়েক সপ্তাহ চিন্তা করি। প্রতিটি শিশুকে যথাযথ মূল্যায়নে গভীর মনোযোগ দেই। তাই আমাকে 'লেট' বলে আমার কাজেরই অবমূল্যায়ন করা হয়।" 


মনোচিকিৎসক মেলটে বলেন, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেরি আসলে তাদের অবসাদগ্রস্ত মানসিক স্বাস্থ্য বা মস্তিস্কের নিউরোলজিক্যাল সমস্যার ফসল।


"যেমন অবসাদগ্রস্ত অনেকেই কিছু পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চান। কারো কারো নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি থাকে, এতে তাদের কোনো কাজ করতে তুলনামূলক বেশি সময়ও লাগে। তাছাড়া, অবসাদ আমাদের কর্মশক্তিকে কমায়, ফলে নিজেকে কাজের উৎসাহ দেওয়াই হয়ে যায় কঠিন।"  


মগজকে পোষ মানালেই সময়মাফিক চলা সম্ভব? 


আমেরিকার নিউইয়র্ক নগরীর মনোচিকিৎসক ড. লিন্ডা সাপাডিন মনে বলেন, "ক্রমাগত দেরির অভ্যাস তৈরি হয় অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনার সমস্যা থেকে।"  


সরলভাবে বললে, কোনো কাজকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে করা ব্যক্তি যদি কাজের মানের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাবেও ভোগেন, তাহলে তিনি নির্ঘাত নির্ধারিত সময়ে তা শেষ করার ডেডলাইন মিস করবেন। অফিসের কোনো মিটিঙয়ের যোগ দিতেও দেরি করবেন। এখানে ভয়ই তার মনে কাজ পেছানোর ইন্ধন যোগাতে থাকে। 


তাই নিজের সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নও জরুরি। চাই আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি। আর সেজন্য মনোরোগ চিকিৎসকের সুপরামর্শ আপনার ভীষণ কাজে দেবে। কারণ, একবিংশ শতকের জীবনের এই দৌড়ে আমরা কেউই আসলে সবার শেষে থাকতে চাই না।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.