প্রথম প্রেম আমাদের ওপর আজীবনের জন্য যে প্রভাব রেখে যায়

 


ODD বাংলা ডেস্ক: প্রেম কি নিতান্তই আবেগীয় কোনো বস্তু?  আবেগ ছাড়া আর কোনোভাবে কি দেখা যায় প্রেমকে? আপনার-আমার কাছে প্রেম কেবল মানবমনের আবেগের আদানপ্রদান হলেও বিজ্ঞান বলছে প্রেম কোনো আবেগ নয়, বরং এটি মূলত একধরনের মোটিভেশন প্রক্রিয়া।


২০০৫ সালে জীবতাত্ত্বিক-নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার এক গবেষণায় এমনটাই প্রমাণ করেছেন। রোমান্টিক প্রেমে মত্ত, এমন মানুষদের মস্তিষ্ক ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং (এফএমআরআই) পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে ফিশার ও আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী এমন তথ্যই খুঁজে পেয়েছেন।


আপনি যখন প্রেমে পড়েন, তখন আপনার মাথার ভেতর কী ঘটে, এমনটা কখনো ভেবেছেন? ২০১৭ সালে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের বিজ্ঞানীরা আরেকটি গবেষণায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করেছেন।


প্রেমে পড়লে মস্তিষ্কে অক্সিটোসিন হরমোন ক্ষরণ হয়। এ হরমোনকে 'লাভ হরমোন'ও বলা হয়। মানবমনে অনুরাগ ও অন্তরঙ্গতার অনুভূতি সৃষ্টি করে এ হরমোন।


প্রেমের ক্ষমতা কেবল একটি হরমোনেই সীমাবদ্ধ নয়। ভালোবাসার কারণে মস্তিষ্কে ডোপামিন, নোরাপেনাফ্রিন, সেরোটৌনিন ইত্যাদি হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। ডোপামিন মস্তিষ্কে 'প্রেরণা' বা 'পুরস্কার'-এর অনুভূতি সৃষ্টি করে। এর ফলে আমরা প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়ি। নিজেদের প্রেম থেকে কিছু না কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে তীব্র হয়।


ওদিকে নোরাপেনাফ্রিন হরমোনও কিছুটা ডোপামিনের মতো কাজ করে। আমরা যখন কারও প্রতি মুগ্ধ হই বা প্রেমের প্রাথমিক পর্যায়ে থাকি, তখন নোরাপেনাফ্রিন আমাদের মনকে অস্থির করে তোলে। সেজন্যই মানুষ প্রথম প্রেমে পড়লে দিন-দুনিয়া ভুলে গিয়ে কেবল নিজের প্রিয়জনের কথা চিন্তা করতে থাকে।


প্রেমে পড়লে অনেক লাজুক বা ভীতু মানুষকেও এমন সব সাহসী কাজ করে ফেলতে দেখা যায়, যা তাদের চারপাশের মানুষকে অবাক করে। এই হঠাৎ পরিবর্তনের পেছনেও নোরাপেনাফ্রিন হরমোনই ইন্ধন যোগায়।


প্রেমের সাথে শরীরের হরমোনের পরিমাণ সবসময় সমানুপাতিক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হরমোন নিঃসৃত না হয়ে কমতেও পারে। এরকম একটি হরমোন হলো কর্টিসল। কর্টিসল একপ্রকার 'স্ট্রেস হরমোন'। অর্থাৎ আমরা যখন মানসিকভাবে চাপবোধ করি, তার পেছনের কারণ হচ্ছে কর্টিসলের ক্ষরণ।


প্রিয়জনের সাথে শারীরিক সম্পর্কের সময় শরীরে কর্টিসল হরমোনের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে সঙ্গমকালে ব্যক্তি পারিপার্শ্বিক চাপের কথা প্রায় ভুলে থাকেন। একইভাবে প্রেমের অনুভূতি হলে শরীরে সেরোটোনিন হরমোনের মাত্রাও হ্রাস পায়।


হার্ভার্ড-এর বিজ্ঞানীদের এ গবেষণাটির ফলাফল হেলেন ফিশারের গবেষণার সাথে সমন্বয় করে বিজ্ঞানীরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, যেহেতু প্রেম আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের রাসায়নিক ফিডব্যাক প্রদান করে, তাই মস্তিষ্কও চায় এ ধরনের ফিডব্যাক নিয়মিত পেতে। মস্তিষ্কের এ চাওয়া পূরণ করতেই মানুষ প্রেমেই মগ্ন থাকতে চায়। অর্থাৎ এ রাসায়নিক ফিডব্যাকটিই প্রেমে পড়ার বা নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের অনুভূতি লাভ করার জন্য মোটিভেশন হিসেবে কাজ করে।


প্রথম প্রেমের স্মৃতি দীর্ঘ হয়


মন ভাঙার অনুভূতি একটি জটিল আবেগীয় ব্যাপার। কিন্তু প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর মনে যে আঘাত লাগে, তার সাথে আর কোনো ভগ্নহৃদয়ের তুলনাই চলে না।


২০১৭ সালে জার্নাল অব পজিটিভ সাইকোলজিতে প্রকাশিত গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, ৭১ শতাংশ মানুষ সম্পর্ক ভাঙার তিন মাস পর কিছুটা সে ধাক্কা কাটিয়ে ওঠেন। তবে এখানে কাটিয়ে ওঠা বলতে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা 'নিজেদের পুনরায় আবিষ্কার করা' বা 'আগের চেয়ে বেশি ইতিবাচক আবেগীয় অনুভূতি'-কে বুঝিয়েছেন।


অর্থাৎ যেকোনো সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরে একটা দীর্ঘ সময় ধরে মানুষ দুঃখ, ক্ষোভ, অপমান, বেদনা ইত্যাদি বোধ করে। কিন্তু মোটামুটি তিন মাস পার হলেই মানুষ নতুন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পায়।


কিন্তু প্রথম প্রেম এত সহজে ভোলা যায় না কেন?


কারণ প্রথমবার প্রেমে পড়লে আমাদের মস্তিষ্কেও প্রথমবারের মতো হরমোনের এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সূচিত হয়। মস্তিষ্কে ইতিবাচক হরমোন বেশি তৈরি হয়, নেতিবাচক হরমোনের মাত্রা হ্রাস পায়।


অনেকগুলো গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আমরা যখন প্রেমে পড়ি তখন আমাদের মস্তিষ্কে একধরনের আসক্তির অনুভূতি তৈরি হয়। আর এ ধরনের অনুভূতির ক্ষেত্রে প্রথমবারের ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রথমবার যখন মস্তিষ্ক এ আসক্তির স্বাদ পায়, তখন তা পরেরবারের জন্য ভিত হিসেবে কাজ করে।


অনেক মানুষই বয়ঃসন্ধির সময় প্রথম প্রেমে পড়েন। সেটা পাক্কা প্রেম না হলেও বয়ঃসন্ধিতেই আমাদের কাউকে ভালো লাগা শুরু হয়। আর এ সময়টাতে আমাদের মস্তিষ্ক বিকাশের পর্যায়ে থাকে।


যদিও প্রথম প্রেমে পড়া সেই হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের কথা আমরা আবেগের কারণে বারবার মনে করি, কিন্তু এর ছাপটা আমাদের মস্তিষ্কে রেখে যায় ওই হরমোনগুলোই। কারণ মস্তিষ্কের বিকাশের পর্যায়ে ওই হরমোনাল অনুভূতিগুলো এর সেন্সরি এরিয়াতে চিরস্থায়ী হয়ে যায়।


মনস্তত্ত্ববিদ জেফারসন সিঙ্গারের মতে, বেশিরভাগ মানুষ ১৫ থেকে ২৬ বছর বয়সে একধরনের 'মেমরি বাম্প'-এর অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এ সময়টাতেই মানুষ বেশিরভাগ প্রথম অভিজ্ঞতাগুলো যেমন প্রথম গাড়ি চালানো, প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়া, প্রথমবার চুমু খাওয়া ইত্যাদি অর্জন করেন।


এই বয়সে মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে সচল ও কর্মক্ষম থাকে। তাই মানুষ এ সময়ে যা যা অনুভূতি লাভ করে, তা জীবনের পরেভাগে তাদের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে।


সিঙ্গার বলেন, 'আমরা চাইলেই এ অভিজ্ঞতাগুলোর কথা আবার চিন্তা করতে পারি, কল্পনা করতে পারি, পুনরায় পেতেও পারি।'


এ ধারণাটি সমর্থন করেন এমআইটি'র বিজ্ঞানীরাও। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ১৮ বছর বয়সেই মানব মস্তিষ্কের সামগ্রিক প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা ও স্মৃতির বিস্তৃতায়ন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে।


প্রথম প্রেম আমাদের মনস্তাত্ত্বিকভাবেও আক্রান্ত করে। নিউ ইয়ের্কের কাপল থেরাপিস্ট ডক্টর নিলু দার্দাস্তির মতে, আমাদের প্রথম প্রেমের অনুভূতির কথা মাথায় রেখেই আমরা পরবর্তী জীবনে নতুন প্রেমের সন্ধান করি। সোজা কথায়, রোমান্টিক প্রেম বিষয়ক আমাদের ধারণা আমাদের প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়।


মানব মস্তিষ্কের ওপর ভালোবাসার প্রভাব নিয়ে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে যে, কেবল সম্পর্ক চলাকালীন সময়েই যে আমরা ভালোবাসার আনুভূতি লাভ করি তা নয়, এ অনুভূতি পরবর্তী জীবনেও আমাদের জৈবিক বিষয়ের ওপর প্রভাব রাখে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.