মুঠো মুঠো ওষুধ খেলে অপকারই বেশি গ্যাসের সমস্যায়

 


ODD বাংলা ডেস্ক: আজকাল গ্যাসের সমস্যায় জেরবার প্রায় প্রত্যেকেই। সমস্যা হলে মুঠো মুঠো ওষুধ খেতে কেউ এতটুকু দেরি করেন না। কিন্তু জানেন কী, গ্যাসের ওষুধ খেলেই যে গ্যাস কমবে এমন কোনও কথা নেই। বরং দীর্ঘকাল খেয়ে গেলে অপকারই বেশি হয়। অনেক ধরনের রোগব্যাধি শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। লিখেছেন মাথাভাঙ্গা মহকুমা হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ শান্ত বর্মন


ডাক্তারবাবু, এত ওষুধ খাই, কিছুতেই গ্যাস কমাতে পারছি না। প্রতিদিন গ্যাসের ওষুধ খাই। কিন্তু গ্যাস কোনওমতেই কমে না। কত জায়গায় গিয়েছি, কত ডাক্তার দেখালাম! কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। তাই আপনার কাছে এলাম। আপনি যেভাবে পারেন আমার গ্যাস কমানোর ব্যবস্থা করে দিন ডাক্তারবাবু! আমি আর পারছি না!


-তা কত বছর ধরে ভুগছেন আপনি?

-বছর দশেকের উপর তো হবেই।

-ভীষণ কোষ্ঠকাঠিন্য ডাক্তারবাবু, ওষুধ না খেলে হতেই চায় না।


এরকম কথা আমরা প্রতিনিয়ত রোগীর থেকে শুনে থাকি। এটা ঠিক, যে গ্যাসের ওষুধ খেলেই গ্যাস কমবে এমন কোনও কথা নেই। অন্য কারণগুলো মুক্ত না করলে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন না আনলে কিন্তু সম্ভব নয়।


এখন পৃথিবীতে যত ওষুধ বিক্রি হয় তার মধ্যে গ্যাস কমানোর ওষুধ কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ স্থানে রয়েছে। গ্যাস কমানোর ওষুধ বলতে এখানে পিপিআই বা প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর-এর কথা বলা হচ্ছে। এই গ্রুপের মধ্যে যত ওষুধ আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্যান্টোপ্রাজল, ওমেপ্রাজল, এসওমেপ্রাজল, রেবিপ্রাজল ইত্যাদি। এই গ্রুপের সব ওষুধই কমবেশি প্রচুর পরিমাণে প্রতিনিয়ত বিক্রি হয়। এগুলো কিনতে কিন্তু চিকিত্সকের প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন হয় না। দোকানে চাইলেই দিয়ে দেওয়া হয়। এই সমস্ত ওষুধের মধ্যে প্যানটোপ্রাজলের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। তবে যে উপকারের আশায় অর্থাৎ গ্যাস কমানোর আশায় রোগীরা মুঠো মুঠো ওষুধ খেয়ে যান তাতে কিন্তু সেই উপকারটা আশানুরূপ আসে না।


অন্যদিকে, মানুষ যাকে গ্যাস বলে সেটা আসলে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (এইচসিএল)। পাকস্থলির ঝিল্লি পর্দা থেকে নিঃসরণ ঘটে। এই হাইড্রলিক অ্যাসিড খাবার হজম করতে সাহায্য করে। এইচসিএল পেপসিনোজেন নামক সুপ্ত এনজাইমকে ভেঙে সক্রিয় পেপসিন এনজাইম তৈরি করে। এই পেপসিন নামক এনজাইমটি আমিষ জাতীয় খাবারের কণাকে ভেঙে পরিপাক ও বিপাকে সাহায্য করে। কোনও কারণে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নিঃসরণ বেশি বেশি হলে তা অনেক সময় গ্যাস্ট্রিক মিউকোসায় বা ঝিল্লি পর্দায় ইনফ্ল্যামেশন বা ক্ষত তৈরি করে, যাকে গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পেপটিক আলসার বলা হয়।


হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড শুধু গ্যাস বা আলসার তৈরি করে না। আমিষ জাতীয় খাবার হজম করা ছাড়াও এর বিশেষ কিছু কাজ আছে। আমিষ জাতীয় খাবার ভেঙে যে প্রোটিন কণা তৈরি হয় তা শরীরের মাংসপেশি গঠনে বিশেষভাবে সাহায্য করে। এছাড়া সেল সিগনালিং, জিন এক্সপ্রেশন এবং বিভিন্ন ধরনের হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। খাবারের সঙ্গে মিশে থাকা বিভিন্ন ধরনের জীবাণু ও ব্যাকটিরিয়াকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে।


যাঁরা অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকেন, যাঁরা ব্যথা কমানোর ওষুধ ঘনঘন খান, যাঁরা মশলাদার খাবার বেশি খান এবং জল পরিমাণে কম খান, তাঁদের ক্ষেত্রে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সক্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। গ্যাস্ট্রিক মিউকোসা বা ঝিল্লি পর্দায় আঘাতের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে যায় এবং গভীর ক্ষত তৈরি হয়। কখনো কখনো পেট ফুটো হয়ে যেতে পারে। যাকে বলে পেপটিক পারফোরেশন। এটা দুধরনের হয়- মেলিনা এবং হিমাটোমেসিস। সেক্ষেত্রে খাদ্যনালী বা অন্ত্রে রক্তক্ষরণ হতে পারে। আলকাতরার মতো কালো পাতলা পায়খানা হতে পারে। তাকে বলা হয় মেলিনা। আবার কালো রক্তবমি হলে তাকে বলা হয় হেমাটোমেসিস। আবার কারও চোঁয়া ঢেঁকুর ওঠে, বুকজ্বালা হয়। একে বলা হয় গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিস (জিইআরডি)। এসব ক্ষেত্রে এই ওষুধগুলো অর্থাৎ পিপিআই বা প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ কিছুদিনের জন্য ব্যবহার করতে বলা হয়। পাকস্থলীতে থাকা প্রোটন পাম্প হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নিঃসরণ করে। পিপিআই জাতীয় ওষুধ হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নিঃসরণে বাধা দেয়। কোনও চিকিত্সকই কখনও বলবেন না যে, এই সব ওষুধ আপনি দীর্ঘকাল ধরে খেয়ে যান।


কিছু মানুষ আছেন যাঁরা প্রতিদিন, এমনকি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই জাতীয় ওষুধ খেয়ে যান। অথচ তাঁদের সমস্যা দূর হয় না। পেট ফাঁপা, পেট ভুটভাট করা, পায়খানা পরিষ্কার না হওয়া -এই ধরনের সমস্যা থেকেই যায়। এ ধরনের মানুষেরা সাধারণত খাদ্যরসিক হন। খেতে ভালোবাসেন, বিশেষ করে মশলাদার খাবার। কিন্তু জল খেতে ভুলে যান। অথচ খাবার হজমে জলের বিশেষ ভূমিকা আছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ জল না খেলে পেট গরম হয়ে যায়। এদের পায়খানা সাধারাণত পরিষ্কার হয় না। নানা ধরনের ওষুধ খেয়ে পায়খানা পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। আবার যথারীতি একই ধরনের খাবার খান। খাবারের তালিকা পরিবর্তন করেন না। ফলে গ্যাসের সমস্যা থেকেই যায়। স্বাভাবিক নিয়মে খাবার হজম করার জন্য হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নিঃসরণ হবে।


খাবার হজমের জন্য শরীরের কোষ ও রক্তনালিকা থেকে জল টেনে নিয়ে খাবার হজম করতে চেষ্টা করবে, যেটা ঠিক জল নয়, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ছাড়াও কিছু ক্ষতিকারক, অপ্রযোজনীয় এঞ্জাইমেটিক গরম তরল পদার্থ। ফলে পেট গরম হয়ে পেট ফুলতে থাকবে। পেটে ভুটভাট শব্দ হতে পারে, গলা-বুক জ্বলতে পারে, চোঁয়া ঢেঁকুর উঠতে পারে এবং সমস্যাগুলো বাড়তেই থাকবে। সুতরাং, পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে হবে।


জল কি শুধু খাবার হজম করে? না, জলের অনেক কাজ। যাঁরা প্রচুর পরিমাণে জল খান, তাঁদের সাধারণত কিডনি বা পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।


পিপিআই বা প্যানটোপ্রাজল জাতীয় ওষুধগুলো যত বেশি খাবেন, তত বেশি গ্যাস তৈরি হবে অর্থাত্ হাইড্রলিক অ্যাসিড বাড়তেই থাকবে। যেহেতু আমাদের হাইড্রলিক অ্যাসিড খাবার হজমে দরকার, তাই একগুচ্ছ ট্যাবলেট খেয়ে জোর করে গ্যাস কমানোর চেষ্টা করলে আমাদের শরীর নিজস্ব নিয়মে আরও বেশি করে হাইড্রলিক অ্যাসিড নিঃসরণ করার চেষ্টা করবে। এই ঘটনাকে বলা হয় রিবাউন্ড ফেনোমেনা। অর্থাত্ আপনি যাকে ধাক্কা দিচ্ছেন সে আপনাকে উলটো দিকে ধাক্কা দিল। আপনি প্রতিদিন গ্যাসের ওষুধ খাচ্ছেন, আবার স্বাভাবিক নিয়মে বেশি বেশি গ্যাস তৈরি হচ্ছে। আদতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।


এটাকে দূর করতে গেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল, হালকা খাবারদাবার খেতে হবে। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, সেলুলোজযুক্ত খাবারে কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য হয় না। যেমন গোরু-ছাগল, ঘোড়া সাধারণত ঘাস পাতা অর্থাত্ সেলুলোজ জাতীয় খাবার খেয়ে থাকে। ফলে এদের কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.