আলোকচিত্রী ডেভিড ইয়ারোর দুনিয়াজোড়া বিখ্যাত সব ছবির গোপন রহস্য!



 ODD বাংলা ডেস্ক: ১৯৮৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার জয়ের পর দিয়েগো ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত ছবিটির কথা মনে আছে? স্টেডিয়ামে লাখো জনতা, চারপাশে ঘিরে আছে অগণিত ক্যামেরা, তারই মধ্যে থেকে যেন ফুটবল ঈশ্বর রূপে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। আর এই ছবিটির কারিগর ব্রিটিশ আলোকচিত্রী ডেভিড ইয়ারো।


ডেভিড ইয়ারো যেদিন ক্রীড়া জগতের অন্যতম এই আইকনিক ছবিটি তোলেন, তার ভাষ্যে- সেদিন তিনি ছিলেন 'ক্যামেরা হাতে দাঁড়ানো এক সামান্য ভক্ত মাত্র!' মেক্সিকোতে সেই ফাইনাল ম্যাচের দিন ইয়ারোর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর! এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে, তুলেছেন লাখ লাখ ছবি, পেয়েছেন হাজারো সম্মাননা। এবার সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে ইয়ারো জানিয়েছেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু ছবির পেছনের গল্প ও ক্যামেরার কারসাজি।


ফাইনাল ম্যাচের দিন ম্যারাডোনার ছবিটি তোলার মাত্র বছরখানেক আগে আলোকচিত্রী হিসেবে ফুটবল দু্নিয়ায় প্রবেশ করেন ইয়ারো। স্থানীয় একটি পত্রিকার জন্য স্কটল্যান্ডে ফুটবল ম্যাচের ছবি তুলে বেড়াতেন তিনি; সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াও চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিশ্বকাপের ভেন্যুতে প্রবেশ করা যে তাকে মর্যাদা ও খ্যাতির সিঁড়িতে পৌছে দিবে, তা হয়তো জানতেন না ইয়ারো! 


সেদিন পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছিল নীল-সাদার আলবিসেলেস্তেরা। বিজয়ের মুহূর্ত পরেই ট্রফি উচিয়ে ধরেন অধিনায়ক ম্যারাডোনা। ছবি তুলতে মাঠে ছুটে যান ডেভিড ইয়ারো এবং তুলে ফেলেন হাস্যোজ্জ্বল ম্যারাডোনার কালজয়ী ছবিটি। পরবর্তীতে তার তোলা এই ছবি সিন্ডিকেট করা হয় এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়।


কথা বলতে বলতে স্মৃতিতে ডুবে যান ৫৬ বছর বয়সী আলোকচিত্রী ডেভিড ইয়ারো। ছিয়াশির সেই দিনটির কথা স্মরণ করে বলেন- "এটা ছিল খুব বিশেষ একটা ছবি। আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। আমার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল বা লেন্স খুব একটা ভালো ছিল না, কিন্তু ঠিক ঐ মুহূর্তেই ম্যারাডোনা আমার দিকে তাকান। আর তখনই তার খুব কাছে চলে যাওয়ার একটা অনুভূতি আসে।"


কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ম্যারাডোনার এই দুর্দান্ত ছবিটি তোলার পরপরই ইয়ারোর ক্যারিয়ার শীর্ষে ওঠেনি। বরং ১৯৮৮ সালে ক্যামেরা ছেড়ে ব্যাংকের চাকরিতে যোগদান করতে হয়েছিল তাকে! পরবর্তীতে তিনি নিজেই নিজের হেজ ফান্ডের অর্থায়ন করেন। তবে ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় তার এই উদ্যোগও ধ্বসে পড়ে। কিছুকাল ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ থাকলেও, ছবি তোলার নেশা ছিল ইয়ারোর হৃদয়ে। তাই শেষ পর্যন্ত নিজের ভালোবাসাকেই ক্যারিয়ার রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা আটছিলেন মনে মনে।


জাপানের জিগোকুদানি মাংকি পার্কে এই ম্যাকাক বানরের ছবিটি তোলেন ডেভিড ইয়ারো। আলোকচিত্রীর মতে, খারাপ আবহাওয়ার জন্য ছবিটির ফোকাস স্পষ্ট না থাকলেও এর মধ্যে মানবিক আবেগ আছে।"

এরপর দীর্ঘ ৪ বছর শুধু নিজেকে প্রস্তুত করেছেন ডেভিড ইয়ারো। তিনি বলেন, "আমি নিজেকে এমন একজন আলোকচিত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি, যে কিনা ছবি তুলেই জীবনযাপনের সব ব্যয় বহন করতে পারবে।"


ছবিতে জীবন!


২০১৫ সালে 'ম্যানকাইন্ড' শিরোনামের একটি ছবি আবারও ডেভিড ইয়ারোকে তুমুল খ্যাতি এনে দেয়। দক্ষিণ সুদানের একটি চারণভূমিতে দিনকা সম্প্রদায়ের পশুপালকদের পশু চরানোর এই অভূতপূর্ব ছবিটি তোলেন ইয়ারো।


"আমি জানতাম আমি এই ছবিটা লাখ লাখ ডলারে বিক্রি করতে পারবো। এর মধ্যে আবেগ আছে, গভীরতা আছে, এটা একেবারেই আদি ও অকৃত্রিম একটা ছবি এবং সম্ভবত এখন পর্যন্ত আমার তোলা সবচেয়ে আকাঙ্খিত একটা ছবি! আর হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিকই ছিল। এখন ওরকম একটা ছবির জন্যই মানুষ ১০০,০০০ ডলার দিতে রাজি।"


সেই দিন থেকেই ফটোগ্রাফি জগতে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম খোদাই করতে শুরু করেন ডেভিড ইয়ারো। প্রকৃতি-মানুষ, মডেল, ল্যান্ডস্কেপ, ওয়াইল্ডলাইফ... সবকিছুর ছবি তুলেছেন ইয়ারো। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার একাধিক বই। এগুলোর মধ্যে 'হাও আই মেইক ফটোগ্রাফস' শীর্ষক পকেট-সাইজ বইটি খুবই বাস্তবধর্মী ও ব্যবহারিক ভঙ্গিতে লেখা। এ বইয়ে তিনি আগামীর আলোকচিত্রীদের জন্য দিয়েছেন সেরা কিছু পরামর্শ। সেই সাথে হেজ ফান্ড ম্যানেজার থেকে বিশ্বসেরা ফটোগ্রাফার হয়ে ওঠার যাত্রাও শেয়ার করেছেন এই বইয়ে।


অনেকে ডেভিড ইয়ারোকে একজন বিখ্যাত ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে আখ্যা দিলেও, আলোকচিত্রী নিজে এই ট্যাগ লাগানো পছন্দ করেন না। তার ভাষ্যে, "আমি কখনোই শুধুমাত্র ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হওয়ার কথা ভাবিনি। আমি শুধু একজন ফটোগ্রাফার। আমি বুঝিনা আপনার ছবির সাবজেক্টের সাথে মিলিয়েই কেন ফটোগ্রাফারকে সেই নামে আখ্যায়িত করতে হবে। অন্য কোনো পেশার ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।"



ডেভিড ইয়ারোর কাছে ছবি তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি? তা হলো- পরিকল্পনা করার গুরুত্ব। তার 'ম্যানকাইন্ড' ছবিটিতেও দেখা গেছে এর প্রতিফলন। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর কারণেই তিনি সেই ছবিটি তুলতে পেরেছিলেন।


"আনসেল অ্যাডামস আমাদের শিখিয়েছেন যে এই পৃথিবীতে ২ ধরনের আলোকচিত্রী আছে। প্রথমত, যারা শুধু ছবি তোলে এবং দ্বিতীয়ত, যারা ছবি বানায়। আর অ্যাডামস নিজে ছিলেন ছবির স্রষ্টা", বলেন ইয়ারো।


ক্যামেরা হাতে ধরার আগেই ওই বিষয়ে গবেষণা এবং সুষ্ঠু প্রক্রিয়ামাফিক চলা দরকার।


ইয়ারোর ছবি তোলার আরেকটি নীতি ছিল- ঘনিষ্ঠ হওয়া; যা তিনি ম্যারাডোনার ঐতিহাসিক ছবিটি তোলার সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে চিতাবাঘ, মহিষ বা মেরু অঞ্চলের ভাল্লুকশ বিভিন্ন প্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ শটে তা প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। ইয়ারোর মতে, আই কনটাক্ট বা চোখে চোখ রাখা মানেই আবেগ সৃষ্টি করা।


তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে একজন আলোকচিত্রীকে হতে হবে সাহসী। কারণ তিনি মনে করেন, শ্রেষ্ঠ ছবির মধ্যে ২টি প্রধান বিষয় কাজ করে- দর্শক যেন ছবিটির দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকতে পারে এবং সেই ছবি যেন আর দ্বিতীয়বার তোলা সম্ভব না হয়!


ডেভিড ইয়ারোর কাজ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক বই, যেখানে তিনি ফটোগ্রাফি সম্পর্কে অনেককিছুই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এর একটির কথা আগেই বলা হয়েছে। অন্যগুলোর মধ্যে রয়েছে 'ওয়াইল্ড এনডেঞ্জারড: আইকনিক ফটোগ্রাফস অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ভ্যানিশিং এনিমেলস অ্যান্ড কালচারস', যা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়। বিশ্বের ৭টি মহাদেশে ওয়াইল্ডলাইফ নিয়ে ইয়ারো যা যা কাজ করেছেন, তার প্রায় সবগুলো সম্পর্কে জানা যাবে এ বইটি থেকে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.