টিপু সুলতান: ভারতবর্ষে ইংরেজদের পরাজয়ের ছবি এত মূল্যে কেন বিক্রি হলো!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: ১৭৮০ সালে পলিলুর যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পরাজিত করেন মহীশুরের শাসক টিপু সুলতান। সেই বিজয়ের মুহূর্তকে উপজীব্য করে আঁকা ১০ মিটার প্রস্থের একটি পেইন্টিং বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়েছিল লন্ডনে। ছবিটি বিক্রি হয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় ৬ কোটি রুপিতে।


প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল ছবিটিকে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় শাসকদের জয়ের অন্যতম সেরা ছবি বলে অভিহিত করেছেন একে।


বিখ্যাত পলিলুর যুদ্ধে হায়দার আলি ও তার ছেলে টিপু সুলতানের কাছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাহিনীর পরাজয়ের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিটিতে।


উইলিয়াম ড্যালরিম্পল বলেন, এ পরাজয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।


নিজের শাসনকালে কোম্পানির সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুতে পরিণত হন মহীশুরের বাঘ টিপু। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর অবশেষে ১৭৯৯ সালে তাকে পরাজিত ও হত্যা করে ব্রিটিশরা। 


পলিলুর যুদ্ধের নানা দৃশ্য ১৮৭৪ সালে স্বয়ং টিপুর তত্ত্বাবধানে আঁকা হয়। টিপুর নিজের প্রাসাদ দরিয়া দৌলত বাগ ও প্রাসাদের প্রাচীরে আঁকানো হয় দেয়ালচিত্র।


কিছু ছবি কালি ও জলরঙের রঞ্জক দিয়ে অন্তত দুবার কাগজে আঁকা হয়েছিল।


ওসব ছবির একটি ২০১০ সালে নিলামে বিক্রি হয়। ছবিটি কেনে কাতারের মিউজিয়াম অভ ইসলামিক আর্ট। 


ওই ছবিটি ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন কর্নেল জন উইলিয়াম ফ্রিজ। তার পরিবার পরে ছবিটি ১৯৭৮ সালে এক ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের কাছে বিক্রি করে দেন। ওই সংগ্রাহক ছবিটি ২০১০ সালে বিক্রি করে দেন।


দ্বিতীয় ছবিটি আজ নিলাম হবে সদেবি'স-এ। এই ছবিটির স্রষ্টা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এটিও কোনো ব্রিটিশ অফিসার ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন। 


দ্বিতীয় ছবিটি প্রথম নিলামে ওঠে ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে। এরপর ১৯৯০ ও ১৯৯৯ সালে অল্প কিছু সময়ের জন্য ছবিটি প্রদর্শিত হয়।


১৭৮০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সকালের ঘটনাবলি নিপুন দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিটিতে। 


কর্নেল উইলিয়াম বেইলির নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনীকে পলিলুর গ্রামের কাছে (চেন্নাইয়ের অনতিদূরে অবস্থিত) অতর্কিতে আক্রমণ করেন টিপু। হায়দার আলি বাড়তি সৈন্য নিয়ে আসতে আসতে টিপু ততক্ষণে অর্ধেক কাজ সেরে ফেলেছেন।


১০-তা কাগজের ওপর আঁকা ৩২ ফুট দৈর্ঘ্যের ছবিটিতে দেখা যায়, টিপু একটি হাতির ওপর বসে নিজের বাহিনীর তদারকি করছেন। ছবির অপরপ্রান্তে তার অশ্বারোহী বাহিনী কোম্পানির বাহিনীকে দুদিক থেকে হামলা করেছে। আর পালকিতে বসে থাকা আহত বেইলিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে।


ছবিতে আরও দেখা যায়, গোলাবারুদভর্তি একটি গাড়ি বিস্ফোরিত হচ্ছে। 


উইলিয়াম ড্যালরিম্পল ছবিটিকে আখ্যায়িত করেছেন মনোমুগ্ধকর মাস্টারপিস হিসেবে।


কেন এই ছবি নিয়ে এত আগ্রহ


উইলিয়াম ড্যালরিম্পল বলেন, টিপু সুলতান সম্ভবত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে ভয়ানক শত্রু দিলেন। টিপু দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ভারতীয়রাও পাল্টা লড়াই করতে জানে, সেই লড়াইয়ে জিততে পারে, এবং ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের কৌশল খাটিয়ে তাদের হারাতে জানে। 


ভারতে ইউরোপীয় বাহিনী সর্বপ্রথম হেরেছে পলিলুরের যুদ্ধে। 


ড্যালরিম্পল বলেন, ব্রিটিশরা টিপুকে উপস্থাপন করেছে 'আগ্রাসী মুসলিম দানব' ও 'ভয়ংকর বর্বর' হিসেবে। কিন্তু আদতে টিপু ছিলেন দূরদর্শী শাসক, যিনি ব্রিটিশদের বিপজ্জনক বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। 


ইসলামি ও ভারতীয় শিল্পের বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টিনা সান বলেন, গত পনেরো বছরে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে টিপু সুলতানের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পকর্ম সংগ্রহের প্রবণতা বেড়েছে। তবে এবারের ছবিটি পাওয়া গেছে প্রায় নিখুঁত ও অক্ষত অবস্থায়। এ কারণেই এ ছবিটি নিয়ে শিল্পরসিকদের মধ্যে আগ্রহ এত বেশি। 


তাছাড়া ভারতীয় শাসকদের মধ্যে টিপুকেই ব্রিটিশরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেত বলে জানান উইলিয়াম ড্যালরিম্পল। তিনি ছিলেন ওই সময়ের একমাত্র ভারতীয় শাসক, যিনি কখনও ইংরেজদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেননি। 


আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে ইউরোপে সামরিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টিপুর বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পেয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ১৭৮০ সালে টিপু ইংরেজদের হারিয়ে দেন।


পলিলুর যুদ্ধে টিপুর সেনাবাহিনীর কাছে অপেক্ষাকৃত উন্নত বন্ধুক, উন্নত কামান ছিল। এছাড়া উদ্ভাবন ও কৌশলের দিক থেকেও তার অশ্বারোহী বাহিনী এগিয়ে ছিল। নিজেদের উটের পিঠ থেকে রকেট ছোড়ে তারা। এই কৌশল থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে পরে ব্রিটিশরা নিজেদের রকেট উদ্ভাবন করে। 


তবে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় শাসকদের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোনো ঐক্য গড়ে না ওঠায় ইংরেজরা গোটা ভারতের দখল নেয়। টিপুকেও শেষতক হার মানতে হয় ব্রিটিশদের কাছে। 


এমন প্রতাপশালী প্রতিপক্ষকে শ্রদ্ধা করত ব্রিটিশরাও। তাই তার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহও একটু বেশিই। তাছাড়া যে ছবিটি নিলামে তোলা হচ্ছে, সেটিতে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয় শাসকের বিজয়ের মুহূর্ত। কাজেই এ ছবি নিয়ে সবার আগ্রহ বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.