সাইবারঅস্ত্র জগতে পেগাসাসের প্রতিদ্বন্দ্বীরা আসছে!
ODD বাংলা ডেস্ক: সাইবারঅস্ত্র জগতে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মতো 'অস্ত্র' এখনো আসেনি। ইসায়েলের বেসরকারি সংস্থা- এনএসও এটি তৈরি করলেও, তা স্বাধীনভাবে বিক্রির ক্ষমতা সংস্থাটির নেই। বিক্রির আগে এনএসওকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। এই অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতাকে পুরোপুরি নিজ স্বার্থ উদ্ধারের কাজে লাগায় ইসরাইল। অথবা এই কাজে লাগানোর কথা ভেবেই এনএসওসহ অপর সংস্থাগুলোকে সাইবার বা প্রচলিত অস্ত্র স্বাধীনভাবে বিক্রির সুযোগ রাখেনি ইসরায়েল। কিন্তু সাইবারঅস্ত্র জগতে পেগাসাসের প্রতিদ্বন্দ্বীরা আসছে বলেই ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে।
মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের তেল আবিবভিত্তিক স্টাফ রাইটার রনেন বার্গম্যান এবং দুই দফা পুলিৎজার বিজয়ী ওয়াশিংটনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক ম্যাজজেনটি যৌথভাবে এক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। প্রতিবেদনে ইসরায়েলের সাইবারঅস্ত্র কূটনৈতিক বিজয় অর্জনের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে। ফাঁস করা হয়েছে- এ সম্পর্কিত আরো তথ্য। রনেন বার্গম্যানের সর্বশেষ বই 'রাইজ অ্যান্ড কিল: দ্য সিক্রেট হিস্টোরি অব ইসরাইল'স টারগেটেড অ্যাসাসিনেশন' সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। আর মার্ক ম্যাজজেনটির সর্বশেষ বইয়ের নাম- 'দি ওয়ে অব নাইফ: দ্য সিআইএ, এ সিক্রেট আর্মি, অ্যান্ড আওয়ার অ্যাট দা এন্ডস অব দি আর্থ।'
কয়েক বছর আগে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণী সাবেক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সুনীতি বিষয়ক কমিটি গঠন করে এনএসও। এ কমিটিতে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেট উভয় দলের সাবেক কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সম্ভাব্য খদ্দেরদের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার লক্ষ্যে গঠন করা হয় এ কমিটি। সৌদি ভিন্ন মতাবলম্বী জামাল খাশোগিকে হত্যার পর পেগাসাস নিয়ে নানান খবর এবং কাহিনি প্রচার হতে শুরু করে। এবারে সুনীতি কমিটি এ বিষয়ে দ্রুত বক্তব্য দেওয়ার জন্য এনএসও'কে অনুরোধ করে।
এনএসও'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শালেভ হুলিও স্পষ্ট ভাষায় খাসোগি হত্যায় পেগাসাসের জড়িত থাকার কথা বেমালুম অস্বীকার করেন। তবুও সুনীতি কমিটি সৌদি আরবের পেগাসাস ব্যবস্থাকে বন্ধ করার জন্য এনএসওকে অনুরোধ করে। এনএসও, সে অনুরোধ রক্ষা করে। সৌদি আরবে হ্যাকিং সিস্টেম পুনরায় চালু করার ইসরায়েল সরকারের পরবর্তী অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ এনএসওকে দেয় সুনীতি কমিটি। সৌদি আরবে পেগাসাস ব্যবস্থা তখন বন্ধই থাকে।
তার মানে এই নয় যে, পেগাসাসের সেবার দ্বার সৌদি আরবের কাছে চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৯-এ এসে সৌদি আরবে পেগাসাস ব্যবস্থা আবার চালু করতে সম্মত হয় এনএসও। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বৈশ্বিক বিনিয়োগ সংস্থা ফ্রান্সিসকো পার্টনারস ১৩০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে এনএসও'র ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছিল। এর আগে, ২০১৯'এ এসে ফ্রান্সিসকো পার্টনারসের শেয়ার ১ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় ব্রিটিশ প্রাইভেট-ইক্যুইটি ফার্ম নোভালপিনা। কেনার কাজে নোভালপিনাকে সহযোগিতা করেন হুলিও। মার্কিন সংস্থাটি যে দামে এনএসও'র শেয়ার কিনেছিল এবারে তারচেয়ে পাঁচগুণ দাম দেওয়া হয়। আর এর পরই সৌদি আরবে আবার পেগাসাস ব্যবস্থা চালু করা হয়। তবে এ দুইয়ের মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কিনা সে কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
সৌদিদের খুশি রাখা নেতানিয়াহুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে সময় তিনি ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা নিয়ে গোপন কূটনৈতিক উদ্যোগের মাঝামাঝি ছিলেন। নেতানিয়াহু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তার এই কূটনৈতিক উদ্যোগ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার ভূমিকাকে স্থায়ী এবং মজবুত করবে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেতানিয়াহু, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আব্রাহাম চুক্তিতে সই করেন। তারা একে এই অঞ্চলের জন্য শান্তির একটি নতুন যুগ হিসেবেও ঘোষণা দেন।
তবে এই শান্তিচুক্তির পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্র বাজার। আমিরাতের কাছে এফ-৩৫ জয়েন্ট স্ট্রাইক ফাইটার বিমান এবং রিপার ড্রোন বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল অতীতের মার্কিন প্রশাসন। ট্রাম্প সে নিষেধাজ্ঞা বাতিলে সম্মত হন। মধ্যপ্রাচ্যে কেবল ইসরায়েলই আর এফ-৩৫ বিমানের অধিকারী রইল না বলে; তেল আবিবের উদ্বেগ প্রশমনে কয়েক সপ্তাহ ব্যয় করে ট্রাম্প প্রশাসন। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, আব্রাহাম চুক্তির জন্য আবুধাবির যুবরাজ এবং কার্যত শাসক এমবিজেড নামে পরিচিত শেখ মোহাম্মাদ বিন জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের সম্মতি আদায়ে "গুরুত্বপূর্ণ" ভূমিকা পালন করেছে বিমান সংক্রান্ত চুক্তি। আব্রাহাম চুক্তির ঘোষণা যখন দেওয়া হলো, ততদিনে এই চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী প্রায়ই সব দেশের কাছেই 'পেগাসাস' বিক্রি করছে ইসরায়েল।
পেগাসাসের সৌদি রফতানি লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস পরে সত্যিকার মুশকিল দেখা দিল। এই লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি নির্ভর করছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর নির্ভর করে। সৌদি আরবে পেগাসাসের অপব্যবহার হয়েছে উল্লেখ করে, নবায়ন করতে অস্বীকার করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। সাইবার অস্ত্রটির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। কিন্তু লাইসেন্স ছাড়া এনএসও'র পক্ষে সে কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে পেগাসাসের তৎপরতায় ধস নামতে থাকে। এটি অকেজো হয়ে পড়তে থাকে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদের সহযোগীবৃন্দ, এনএসও নির্বাহীরা, মোসাদ এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অসংখ্য ফোনালাপ হলো, কিন্তু তারপরও এ সমস্যার সমাধান হলো না। এ পরিস্থিতিতে সৌদি যুবরাজ জরুরি ফোন করেন নেতানিয়াহুকে। ফোনালাপের বিষয়ে অবহিত ব্যক্তিরাই এ কথা জানান। যুবরাজ পেগাসাসের সৌদি লাইসেন্স নবায়ন করার জন্যেই ফোনটি করেন।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদের হাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষমতা রয়েছে। তার অসুস্থ পিতা, বাদশাহ সালমান আনুষ্ঠানিকভাবে আব্রাহাম চুক্তিতে সই করেননি। কিন্তু অন্যান্য স্বাক্ষরকারীকে তার নিরঙ্কুশ আশীর্বাদ প্রদান করেন তিনি। চুক্তিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশকে বাস্তবায়নের অনুমতিও দেন তিনি। এটি হলো, পারস্য উপসাগরের পূর্বমুখী যাত্রার জন্য ইসরায়েলি বিমানকে প্রথমবারের মতো সৌদি আকাশপথ ব্যবহার অনুমতি দেওয়া। সৌদিরা যদি তাদের আকাশসীমা ব্যবহার নিয়ে তাদের মত পরিবর্তন করে, তবে আব্রাহাম চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ্য ও গণমুখী উপাদান বিলীন হয়ে যেতে পারে।
নেতানিয়াহুকে পেগাসাস নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে চলমান সংকটের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি। সৌদি যুবরাজের সাথে ফোনালাপের পরেই তার দফতর তৎপর হয়ে ওঠে। অবিলম্বে সমস্যাটি সমাধান করার নির্দেশ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেয়। সে রাতেই মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ফোন করেন এনএসওর অপারেশন রুমে। তিনি সৌদি আরবের পেগাসাস তখনই চালু করার নির্দেশ দেন। কিন্তু দায়িত্বে থাকা এনএসও কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত লাইসেন্স ছাড়া এ নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন। তখন তাকে জানানো হয় যে, এই আদেশ সরাসরি নেতানিয়াহুর কাছ থেকে এসেছে। এবারে এনএসও কর্মকর্তা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত ইমেইল গ্রহণ করতে রাজি হলেন। এর কিছুক্ষণ পরই সৌদি আরবে অচল হয়ে থাকা পেগাসাস আবার চালু হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্তাবাহক এনএসও সদর দফতরে হাজির হয়। তিনি সিলমোহর মারা এবং সিলগালা লাগানো অনুমতিপত্রটি পৌঁছে দেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার নিয়ে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের জন্য ইসরায়েলে পদার্পণ করেন হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। এনএসও'কে মার্কিন কালোতালিকাভুক্ত করার কয়েক সপ্তাহ পরে এ সফরে যান তিনি। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে ফেরা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম অগ্রাধিকার তাই অবহিত করা হয় ইসরায়েলকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মূল চুক্তি বাতিল করার তিন বছর পরে আবার চুক্তিতে ফিরতে চাইছে আমেরিকা।
সুলিভানের এ সফর অপরিসীম ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করছে। ইরানি কর্মকর্তাদের সাথে সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি সম্পর্কে ২০১২ সালে যেসব মার্কিন কর্মকর্তা প্রথম আলোচনা করেছিলেন তাদের অন্যতম সুলিভান। প্রেসিডেন্ট ওবামা সে সময় ইরানিদের সাথে সে বৈঠকগুলো ইসরায়েলিদের কাছ গোপন রেখেছিলেন। ইরানিদের সাথে আলোচনাকে ইসরায়েল নস্যাৎ করে দিতে পারে ,এই ভয়ে গোপনীয়তার পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল। বৈঠকের কথা জানার পর, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা রাগে-দুঃখে ফেটে পড়েছিলেন। কয়েক বছর পরে এবারে ইরানের কূটনীতির বিপরীতে ঐক্যবদ্ধ জোট গঠনের জন্য জেরুজালেমে আসেন সুলিভান।
তবে আরেকটি বিষয় নিয়েও প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ইসরায়েলি কর্মকর্তারা আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিষয়টি হলো এনএসও'র ভবিষ্যৎ। এনএসও'কে কেন মার্কিন কালো তালিকায় ফেলা হলো- তা জানার জন্য সুলিভানের ওপর ইসরায়েলিরা চাপ সৃষ্টি করেন। পাশাপাশি তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, যদি এনএসও দেউলিয়া হয়ে যায় তবে রাশিয়া এবং চীন যে শূন্যতা পূরণ এগিয়ে আসতে পারে এবং দেশদুটি নিজেদের প্রভাব বিস্তারও করতে পারে। ইসরায়েলের কাছ থেকে হ্যাকিং সাজ-সরঞ্জাম যেসব দেশ কিনতে পারবে না, তাদেরকে এমন যন্ত্রপাতি বিক্রির প্রস্তাব দিতে পারে ওই দুই দেশ।
আরো ইসরায়েলি সাইবারঅস্ত্র এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কালোতালিকা-ভুক্ত হওয়ার পরে ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার অধিদফতরের প্রধান উন্না বলেন, তিনি বিশ্বাস আরো বড় কিছুর অংশ হিসেবে ইসরায়েলি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সাইবারঅস্ত্রের জগতে ইসরায়েলের প্রাধান্যকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা এটি । তিনি বলেন, "ইসরায়েল সততার সাথে সুনাম অর্জন করেছে তা বজায় রাখার জন্য আমাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।"
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা গভীর ষড়যন্ত্রের এই ধারণাকে সরাসরি নাকচ করে দেন। তারা বলেন যে, এনএসও'র সিদ্ধান্তের সাথে একটি বিপজ্জনক সংস্থার রাশ টেনে ধরার বিষয়টি জড়িত। এতে আমেরিকার সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কের কিছুই নেই। বরং একটি হ্যাকিং ফার্মের ভাগ্য নির্ধারণের চেয়ে কয়েক দশক পুরানো জোটের সামনে অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে। ইসরায়েলে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্টিন ইন্ডিক ঐকমত্য পোষণ করে বলেন, "দেশগুলোকে তাদের নিজের নাগরিকদের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার পথ করে দিয়েছিল এনএসও।" তিনি আরো বলেন, "আমি বিষয়টি সরলভাবে দেখছি। সমস্যাটি ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ে নয়, বরং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এমন কিছু নিয়ে।"
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে এনএসও'এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহের কালো মেঘ জমা হয়েছে। মার্কিন প্রযুক্তির উপর একক নির্ভরতার কারণে এমনটি হয়নি। বরং মার্কিন কালোতালিকায় নাম থাকায়, অনেক সম্ভাব্য খদ্দের এবং এনএসও'র অনেক অভিজ্ঞ কর্মী ভয় পাবেন। ইসরায়েলি শিল্প অভিজ্ঞ একজন বলেন "জলের হাঙ্গরগুলো এবারে রক্তের গন্ধ পাবে।" ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এবং শিল্প নির্বাহীরা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, কয়েকটি মার্কিন কোম্পানির গোয়েন্দা এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে; তারা হয়তো এনএসও কিনতে আগ্রহী। এমনটি ঘটলে, নতুন মালিক এনএসও'কে মার্কিন নিয়মনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে তুলতে পারে। সিআইএ এবং এফবিআইএর কাছে হয়তো এনএসও'র সাইবারপণ্য বিক্রি শুরু করতে পারবে। এছাড়া, এনএসও'র সাইবারঅস্ত্রের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য অন্যান্য মার্কিন সংস্থাগুলো অর্থ দিতে মোটেও দেরি করবে না।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখন এনএসও-র কৌশলগত দখলের আশঙ্কা করছেন। সেক্ষেত্রে অন্য কোনও সংস্থা বা দেশ — কীভাবে এবং কোথায় সাইবারঅস্ত্রটি ব্যবহার করা হবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে। ইসরায়েলের এক প্রবীণ কর্মকর্তা বলেন, "এই ধরনের কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ হারানোর অনুমতি কখনোই দিতে পারে না ইসরায়েল।" কেন এই ধরনের চুক্তি হতে পারে না তারও ব্যাখ্যা দেন তিনি। "তাদের জনশক্তি, তাদের অর্জিত জ্ঞান।" এসব কোম্পানির বেলায় বিদেশী মালিকানা হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। শর্ত মেনে বিক্রিও চলবে। আর সে শর্ত হলো, "শুধুমাত্র ইসরায়েলের স্বার্থ এবং কর্মের স্বাধীনতা বজায় থাকবে।"
ইসরায়েলের সাইবারঅস্ত্র জগতে প্রায় একচেটিয়া আধিপত্যের দিন শেষ হয়েছে - বা শিগগিরই হবার পথে রয়েছে। আক্রমণাত্মক হ্যাকিং সাজ-সরঞ্জামগুলো নিয়ে সম্ভাব্য মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর নজর পড়ছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বোল্ডেন্ড নামের সাইবারঅস্ত্র সংস্থা প্রতিরক্ষা-শিল্প খাতের দানব হিসেবে পরিচিত রেথিয়নের কাছে একটি বিক্রয় প্রস্তাব দেয়। বোল্ডেন্ড এর এ সংক্রান্ত একটি উপস্থাপনা সংগ্রহ করতে পেরেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে কোম্পানিটি বিভিন্ন মার্কিন সরকারী সংস্থার কাজের জন্য সেলফোনসহ অন্যান্য ডিভাইসে হামলার উপযোগী নিজস্ব সাইবারঅস্ত্রের ভান্ডার প্রদর্শন করেছে।
বিশেষ করে, এ উপস্থাপনার একটি স্লাইড সাইবারঅস্ত্র ব্যবসার জটিল প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্লাইডে দাবি করা হয় যে, ফেসবুকের মালিকানাধীন জনপ্রিয় বার্তা আদানপ্রদানের মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাক করার একটি উপায় বোল্ডেন্ড খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু, হোয়াটসঅ্যাপের একটি আপডেটের পরে বোল্ডেন্ড সে সক্ষমতা হারায় বলেও জানায়। এই দাবিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর কারণ, একটি স্লাইড অনুসারে, বোল্ডেন্ডের প্রধান বিনিয়োগকারী হলো ফাউন্ডারস ফান্ড। ধনকুবের পিটার থিয়েল ফেসবুকে প্রথম বিনিয়োগকারীদের একজন এবং এখনও এর বোর্ডে রয়েছেন। ফাউন্ডারস ফান্ড হলো তারই পরিচালিত কোম্পানি। হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাক করার সক্ষমতা "বর্তমানে কারোই নেই।" উপস্থাপনা অনুসারে, মার্কিন সরকার এবং গোয়েন্দা সম্প্রদায় হ্যাক করার সে সক্ষমতা পেতে আগ্রহী।
২০১৯ সালের অক্টোবরে এনএসও'র বিরুদ্ধে মামলা করে হোয়াটসঅ্যাপ। মামলায় বলা হয়, হোয়াটসঅ্যাপের দুর্বলতাকে পুঁজি করে বিশ্বব্যাপী এনএসও'র সাইবারঅস্ত্র দিয়ে ১,৪০০ ফোন হ্যাক করা হয়েছে। কে বা কারা এই সাইবারঅস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে এই প্রশ্নের সাথে সাথে এ অস্ত্র ব্যবহারে যে ক্ষতি হচ্ছে; তার জন্য আইনের দৃষ্টিতে কে দায়ী হবে তাও তোলা হয়। এনএসও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে যেয়ে সবসময় বলছে, এ কোম্পানিটি শুধুমাত্র বিদেশী সরকারের কাছে প্রযুক্তি বিক্রি করে। নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সাইবার অস্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে এনএসও'র কোনো ভূমিকা নেই। দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র প্রস্ততকারকরা, সে রেথিয়ন বা রেমিংটন যেই হোক না কেন, গণযোগাযোগের এ ধারা অনুসরণ করছে।
ফেসবুক সেটা প্রমাণ করতে চেয়েছে, অন্তত আত্মপক্ষ সমর্থনে এনএসও যে বক্তব্য দিয়েছে তা মিথ্যা। প্রযুক্তি-দানব ফেসবুক আরো যুক্তি তুলে ধরে যে, হ্যাক করার কাজে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে এনএসও। হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টে সাইবার হামলায় ব্যবহৃত কয়েকটি কম্পিউটার সার্ভার ভাড়া দিয়েছে খোদ এনএসও। ফেসবুক যুক্তি দেয় যে, এনএসও'এর ক্রমাগত সম্পৃক্ততা ছাড়া তাদের অনেক খদ্দেরই বন্দুকই তাক করতে পারবে না।
এনএসও'র বিরুদ্ধে তাদের মামলা উপস্থাপন করার সময় ফেসবুকের আইনজীবীরা ভেবেছিলেন, তাদের কাছে ইসরায়েলি কোম্পানির বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ বা আলামত আছে। মার্কিন কোনো ফোন নম্বর হ্যাক করার কাজ থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকে বলে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করছে এনএসও। এনএসও'কে মার্কিন নম্বর হ্যাক করা থেকে ঠেকিয়ে রাখছে ইসরায়েল সরকার। ফেসবুক দাবি করেছে যে, ওয়াশিংটন এরিয়া কোড সহ কমপক্ষে একটি নম্বরে পেগাসাস দিয়ে সাইবার হামলা করা হয়েছে- সে প্রমাণ তাদের কাছে আছে। এতে পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ একজন মার্কিন নম্বরের ওপর নজরদারি করার জন্য এনএসও সফটওয়্যার ব্যবহার করেছে।
তবে ঘটনার পুরো ছবি এই প্রযুক্তি দানবের কাছে ছিল না। ফেসবুক যা জানতে পারেনি তা হল একটি মার্কিন ফোন নম্বরে হামলার ঘটনা কোনো বিদেশী শক্তি পরিচালিত সাইবার আক্রমণ নয়। এফবিআই'এর কাছে এনএসও তৈরি পেগাসাস-ফ্যান্টমের কার্যকারিতা তুলে ধরার অংশ হিসেবে এ সাইবার হামলা করা হয়। পেগাসাসের সাধারণ সংস্করণ দিয়ে মার্কিন কোনো নম্বরে ঢোকা যাবেই না। কিন্তু পেগাসাস-ফ্যান্টম দিয়ে সে কাজটি নির্বিবাদে করা যাবে এবং মার্কিনীদের নিজেদের ব্যবহৃত স্মার্টফোনগুলোকে "গোয়েন্দা তথ্যের সোনার খনি" বানানো যাবে!
Post a Comment