রবিঠাকুরের রসিকতা

 


ODD বাংলা ডেস্ক: রবিঠাকুর একবার মংপুতে মৈত্রেয়ীদেবীকে বলেছিলেন, ‘তোমার ছবি আঁকব। অবশ্য আশাও কোরো না যে সে ছবি তোমার মতো হবে।’

মৈত্রেয়ী দেবী সেই কিশোরবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের রসবোধের সঙ্গে পরিচিত। তাই আশা আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি সেই রসিকতার সঙ্গী হয়েছিলেন। মজার ছলে রবীন্দ্রনাথ একটা ঘটনা বলেছিলেন। এমন এক লোক শিল্পীর কাছে নিজের ছবি আঁকিয়েছিলেন, যিনি মোটেও সুদর্শন ছিলেন না। কিন্তু পরে নিজের ছবি আনতে গিয়ে রেগে অস্থির। রেগে গিয়ে শিল্পীকে অপমান করে নিজের ছবিকেই বলে বসলেন, It is a very bad work of art. সেই শিল্পীও লোকটিকে মুখের উপর বলেছিলেন, You must admit that you are a bad work of nature।


রবীন্দ্রনাথ এই গল্প বলার পর মৈত্রেয়ীদেবীকে বলেছিলেন, ‘দেখ আমি তোমাকে একথা কখনোই বলব না, কিছুতেই না, সত্যি হলোেও না, মনে হলোেও চেপে যাবো।’ পরমাসুন্দরী মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে একথা বলা রসিকতা ঠিকই, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ—কথা বলায় নান্দনিকতার স্পর্শ। 


মংপুতে বসে প্রবাসী পত্রিকার জন্য লেখা পাঠাতেন। একবার ‘মধু’ বিষয়ে লেখা পাঠিয়েছেন আর সেই কবিতা প্রকাশের পর জনৈক ভক্ত সত্যি এক বোতল মধু পার্সেল করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বেশ খুশি! বললেন, ‘দেখেছো তো? মধুর বিষয়ে কবিতা লেখার পর মধু আসছে।’ তখন রবীন্দ্রনাথের ডাক্তারবাবু মন্তব্য করলেন, ‘মধুর কবিতা লিখে যদি মধু আসে, তাহলোে মধুর বদলে বধূর কবিতা লিখতে পারতেন।’ শুনে রবীন্দ্রনাথ বেশ মজা করে বললেন, ‘সাধু, এ তো উত্তম প্রস্তাব, ভেরি গুড সাজেশন।’


শান্তিনিকেতনে তো নাটক অভিনয় লেগেই থাকতো। একবার অনিল কুমার চন্দকে ‘তাসের দেশ’ নাটকে অভিনয় করতে হয়েছিল। রুইতনের ভূমিকায়, সংলাপ ছিল সামান্য। কিন্তু অনিল কুমার চন্দ বেঁকে বসলেন। কারণ তার কথায় সিলেটি টান, মেঘকে বলেন ‘ম্যাগ’! রবীন্দ্রনাথ তার জন্যেই মেঘের জায়গায় লিখলেন, ‘কুয়াশা’। মহড়া চলছে। একদিন এসে হাজির বনমালী। বললেন, ‘অমুক দিদিমণি ক্যাক করে পাঠিয়েছেন। আপনি একটু ক্যাক খান।’ রবীন্দ্রনাথ সেই থালা এগিয়ে দিলেন অনিল চন্দের দিকে। যুক্তি এই যে, যারা মেঘকে ‘ম্যাগ’ বলে, তাদেরই তো ‘ক্যাক’ খাওয়া উচিত।


একবার রবীন্দ্রনাথ ট্রেনে করে দাক্ষিণাত্যে যাচ্ছিলেন। প্রতি স্টেশনে লোকজন প্রিয় কবিকে মালা পরিয়ে দিচ্ছে। ক্লান্ত কবি এন্ড্রুজকে বললেন ভক্তদের বুঝিয়ে বলতে। এন্ড্রুজ ভোরবেলা একরাশ মালা পরে হাজির। লোকজন রবীন্দ্রনাথকে না পেয়ে এন্ড্রুজকেই মালা পরিয়েছে। এন্ড্রুজ যারপরনাই খুশি হয়ে রবীন্দ্রনাথকে বললেন, ‘দেখো গুরুদেব, তোমার হয়ে আমাকে কতো মালা পরতে হয়েছে।’


রবীন্দ্রনাথ বললেন অন্য কথা। বললেন, ‘মালা যারা পরিয়েছিল তাদের মধ্যে কেউ মেয়ে ছিল না তো?’ এন্ড্রুজ কতোটা বুঝেছিলেন জানা নেই, তবে এইসব স্মৃতিচারণ প্রতিভাবান মানুষের প্রফুল্ল মুখাবয়ব মনে জাগিয়ে তোলে। ভুবনে আনন্দধারার সৃজনই ছিল তার কাজ।


রাণু মুখোপাধ্যায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অক্ষরগুলো ছিল বড়ো আনন্দময়। একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘ইংরাজিতে প্রিয় বলে না এমন মানুষই নেই, সে অমানুষ হলোেও তাকে বলে—এমন কি, সে যদি দোঁহা না লিখতে পারে তবুও। আমার মত হচ্চে এই যে রাস্তাঘাটের সবাইকেই যদি প্রিয় বলতে হবে এমন নিয়ম থাকে, তবে দু এক জায়গায় সে নিয়মটা বাদ দেওয়া দরকার। ---প্রিয় মার্ত্তণ্ড লিখো না—তাহলোে বরঞ্চ লিখো প্রিয় মার্তণ্ড দাদা, প্রচণ্ডপ্রতাপেষু। ---যদি আমি রবি দাদা তখন ওটা (‘প্রিয়’) বাদ দিলেও চলে— ও যেন সকালবেলায় বাতি জ্বালানো, যেন তার ফাঁসি হয়েছে তাকে কুড়িবছরের দ্বীপান্তর দেওয়া। অতএব আমি যেন থান ধুতি পরা ঠাকুরদাদা। আমার কোনো পাড় নেই— আমি নিতান্তই রবিদাদা।”


একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। কবির বসার জায়গার উপরেই পাখার ব্লেডে বড়ো বড়ো গাঁদাফুল এমনভাবে রাখা হয়েছিল যে পাখা খোলার সঙ্গে সঙ্গে সব ফুল তার মাথায় পড়তে লাগল। রবীন্দ্রনাথ পাশে বসা রমেশচন্দ্রকে বলেছিলেন ‘রঘুবংশ’-এর ইন্দুমতীর কথা! ফুলের ঘায়ে যার প্রাণবিয়োগ হয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এক সাহিত্যের বড়ো রহস্যের সমাধান হলো’। আগে তিনি ভাবতেন ফুলের ঘায়ে মৃত্যু নিছক এক কল্পনার কাব্যিক প্রকাশ মাত্র। কিন্তু শূন্য থেকে ছুটে আসা ওই গাঁদাফুল যেন রবীন্দ্রনাথকে নতুন বোধের পৃথিবীতে নিয়ে গিয়েছিল। 


এমন কতো টুকরো টুকরো স্মৃতি সময়ের সিন্দুকে রয়ে গিয়েছে মূল্যবান মোহরের মতো। রবীন্দ্রসাহিত্যের মতো এই আনন্দময় মুহূর্তগুলোও অসীম। রসিকতা করার এই প্রবণতা তরুণ বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথের ছিল। একবার এপ্রিল মাসের প্রথম দিনে দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাজলেন পার্শী। তিনি নাকি বোম্বাই থেকে অক্ষয় চৌধুরীর সঙ্গে ইংরাজি সাহিত্য রচনা করতে চান। অক্ষয় চৌধুরী আপনভোলা মানুষ। চিনতেই পারলেন না দাড়ি গোঁফওয়ালা রবীন্দ্রনাথকে। গম্ভীরভাবে শেলি, বায়রণ প্রভৃতিদের নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। তারপর যখন তারকনাথ পালিত এসে, ‘কে রবি?’ বলে রবীন্দ্রনাথের মাথায় একটা থাপ্পড় মারলেন, তখন কৃত্রিম সাজপোশাক খসে গেল বটে, মজাটা কিন্তু জমজমাট হলো। এমনি সব মুহূর্তের আনন্দকে সম্পদ মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। তার জীবনপথে চলার সূত্রটাই তো অন্যরকম —জীবনকে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার চেয়ে হেসে উড়িয়ে দেওয়া অনেক ভালো। দীর্ঘজীবনে কান্নার কারণ ছিল অনেক। শোকে বিহ্বল হওয়ার কারণও কিছু কম ছিল না। তবু রবীন্দ্রনাথ আনন্দে বেঁচেছেন। নিজের চারিদিক ভরিয়ে দিয়েছেন খুশিতে। আর দুঃখ? সব দুঃখ, যন্ত্রণা শব্দের ছদ্মবেশে অমর হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.