আপনি কি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, অন্তর্মুখী, নাকি স্রেফ ‘বেশি সংবেদনশীল মানুষ’?

 


ODD বাংলা ডেস্ক: কখনো কি আপনার মনে হয় আপনি এমন কিছু অনুভূতির মুখোমুখি হচ্ছেন যা অন্যরা টেরই পাচ্ছেনা? খুব সহজেই আঁতকে ওঠেন আপনি? আপনার চারপাশের মানুষগুলোর কারণে কি আপনার খুব দ্রুতই মুড সুইং ঘটে? যদি এসবের মাঝে আপনি নিজেকে খুঁজে পান, তাহলে খুব সম্ভবত আপনি একজন অতি সংবেদনশীল মানুষ বা হাইলি সেনসিটিভ পার্সন (এইচএসপি)।


এইচএসপি-তে ভোগা মানুষের অনেক কিছু নিয়েই মাত্রাতিরিক্ত সংবেদনশীলতা থাকে। এই যেমন কেউ বেশি আলো পছন্দ করেন না, কেউ বা আবার কড়া সুগন্ধীর গন্ধে বিব্রত বোধ করেন। অনেকে আছেন যারা ভিড়ের মধ্যে যেতে পছন্দ করেন না।


হালের লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ও সেল্ফ-হেল্প ব্লগগুলোতে এইচএসপি নিয়ে অনেক আলোচনা করা হচ্ছে। অতীতে অনেক সেলিব্রিটিরই এইচএসপি জনসমক্ষে প্রকাশ পেয়েছে। এ তালিকায় আছেন কানাডিয়ান-আমেরিকান গায়ক-গীতিকার অ্যালানিস মরিসেট, মার্কিন র‍্যাপার কানিয়া ওয়েস্ট ওরফে ইয়ে, অভিনেত্রী নিকোল কিডম্যান, নিউজিল্যান্ডের শিল্পী লর্ড ইত্যাদি।


উচ্চ সংবেদনশীলতাকে প্রায়শই ডিপ্রেসন বা বিষণ্ণতার প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। তবে মূল ব্যাপারটা আরেকটু জটিল। একজন ব্যক্তির উচ্চ সংবেদনশীলতা বা নিম্ন সংবেদনশীলতা; উভয়রেই সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই রয়েছে। এগুলো নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। আর এ নিয়ে নিজেদের কিছুটা জানা থাকলে আমরা সহজেই এই মানসিক পরিস্থিতিগুলোর যথাযথভাব সামলাতে পারি।


হিস্টিরিয়া


মানুষের মধ্যে উচ্চ সংবেদনশীলতার ধারণা সেই ১৯ শতক থেকেই দেখা যায়। তখন মানুষ হিস্টিরিয়া (মৃগীরোগ) ও নিউরাস্থেনিয়া (স্নায়বিক অবসাদ) ইত্যাদি সমস্যায় ভুগতেন। সে সময় এ ধরনের সমস্যায় পড়লে মানুষকে বিশ্রামের পরামর্শ দেওয়া হতো।


আধুনিক সময়ে ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে এইচএসপি নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়। দুই মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ এলাইন ও আর্থার অ্যারন গবেষণা শুরু করেন বিষয়টি নিয়ে।


এ গবেষকদের লক্ষ্য ছিল একজন মানুষ যে কোনো শারীরিক, সামাজিক বা আবেগীয় উদ্দীপনায় কীভাবে সাড়া দেয় তা জানা। এ প্রক্রিয়াটিকে গবেষকেরা 'সেনসরি প্রসেসিং সেনসিটিভিটি' বলে অভিহিত করেছেন।


তবে তারা এক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া বা নেতিবাচক সাড়া নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। তাদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র কোনো উদ্দীপনায় কীভাবে সাড়া দেয় তা নিয়ে বিশদ জানা।


এ গবেষণাটি সম্পাদনের জন্য গবেষকেরা অংশগ্রহণকারীদের কিছু প্রশ্ন করেন। তারপর সে প্রশ্নগুলোর উত্তর মাপার জন্য এক থেকে সাত মাত্রার একটি স্কেল ব্যবহার করেন। এ স্কেলটি পরে সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণায় এইচএসপি স্কেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।


ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর রিসার্চ ফেলো ডক্টর শার্লট বুথ বলেন, 'সব উচ্চ সংবেদনশীল মানুষই যে অন্তর্মুখী হবেন তা কিন্তু নয়।' তবে সাধারণত এইচএসপি থাকা মানুষদের কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা চারপাশের মানুষদের তুলনায় বেশি হয়। যেমন খুবই মৃদু কোনো শব্দও টের পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন উচ্চ সংবেদনশীল মানুষেরা।


উচ্চ সংবেদনশীল মানুষেরা অন্যদের অনুভূতিও টের পেয়ে যান মাঝেমধ্যে। নেদারল্যান্ডের রেডবাউড ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সেন্টারের অধ্যাপক করিনা গ্রেভেন জানান, 'একজন উচ্চ সংবেদনশীল মানুষ তার চারপাশের মানুষদের ওপর একবার নজর বুলিয়েই বলে দিতে পারেন কে কীরকম অনুভব করছে, কে চাপবোধ করছে, কে একটু আগে তার প্রিয়জনের সাথে ঝগড়া করে এসেছে ইত্যাদি।'


আপনার যদি কোনো উচ্চ সংবেদনশীল বন্ধু থাকে তাহলে খেয়াল করে দেখবেন তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় নিচ্ছেন, যে কোনো বিষয় নিয়ে বেশি ভাবেন, এবং চটুল কথাবার্তার পরিবর্তে গম্ভীর কোনো বিষয়ে আলাপ করতে বেশি পছন্দ করেন।


নেদারল্যন্ডের আরেকজন মনস্তত্ত্ববিদ ইভা জান্দ হাই সেনসিটিভ মানুষকে সমুদ্রের মাঝে অনেকগুলো জাহাজের মাঝে একটি ছোট নৌকার মতো তুলনা করেছেন। জাহাজগুলো স্থির থাকলেও ছোট একটি ঢেউতে ওই নৌকা দুলে উঠবে। এরকম পরিবেশে একজন উচ্চ সংবেদনশীল মানুষের মন ভালো করার জন্য কারও কাছ থেকে একটি মৃদু হাসিই যথেষ্ঠ।


বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো দেখে মনে হতে পারে উচ্চ সংবেদনশীল মানুষরা বুঝি পৃথিবীটাকে একটু বেশিই অনুভব করেন। কিছু গবেষণার মতে, অন্যান্য ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলোর মতো সেনসরি প্রসেসিং সেনসিটিভিটিও একটি প্রাকৃতিক ও জিনগত বৈশিষ্ট্য। কোন ধরনের জিন এর জন্য দায়ী তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। সেরোটোনিন ট্রান্সপোর্টার জিন নামে মানবদেহে একটি জিন রয়েছে, যেটি স্নায়ুকোষে নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সেরোটোনিন মানুষের মানসিক অবস্থা ও মনোযোগ সামঞ্জস্য করার কাজটি করে থাকে।


ডেইজি বনাম অর্কিড


কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর অধ্যাপক মাইকেল প্লুয়েস জানাচ্ছেন, বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষের মধ্যে উচ্চ সংবেদনশীলতায় ভোগা মানুষদের সংখ্যা বেশি। গবেষণা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি কতটুকু সংবেদনশীল হবেন তা তারা বেড়ে ওঠা পরিবেশের সাথেও সম্পর্কিত।


মেরি ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে করা একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্কের সাথে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য জড়িত। গবেষণাটি থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী দেখা গেছে যেসব মানুষ উচ্চ সংবেদনশীল তাদের বিষণ্নতয়ায় ভোগার আশঙ্কাও বেশি। আর এ ধরনের মানুষরা ছোটবেলায় মা-বাবার কাছ থেকে বেশি আদর-যত্ন পাননি। আর যেসব মানুষ ছোটকাল থেকেই প্রিয়জনের স্নেহের ছায়ায় বড় হয়েছেন, তাদের উচ্চ সংবেদনশীলতা থাকলেও বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার কোনো ঝুঁকি ছিল না।


এসব ফলাফলের সূত্র ধরে গবেষকেরা উচ্চ সংবেদনশীল মানুষদের অর্কিডের সাথে তুলনা করেছেন। অর্কিড ফুলকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রচুর পরিচর্যার দরকার। অন্যদিকে যেসব মানুষের সংবেদনশীলতার অনুভূতি কম তাদেরকে দেখা হচ্ছে ডেইজি ফুল হিসেবে। ডেইজি ফুল নিজে নিজেই বেড়ে উঠতে পারে, এর জন্য বিশেষ কোনো পরিচর্যার দরকার হয় না। আর এ দুই শ্রেণীর মাঝে যারা পড়েন, তারা কোন ফুল? তাদেরকে মাঝেমধ্যে টিউলিপ হিসেবে দেখা হয়।


মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বা কোপিং মেকানিজম


কোনো উচ্চ সংবেদনশীল মানুষের জন্য অফিসের পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদের অফিসের আবহাওয়া যদি বিন্দুমাত্র নেতিবাচক হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়ে তাদের ওপর। এমনকি যদি দুই কলিগ তাদের সামনে ঝগড়া করতে শুরু করেন, তাহলে সে ঝগড়ায় দূরতম সম্পর্ক না থাকলেও একজন উচ্চ সংবেদনশীল মানুষের মন আপনা থেকেই খারাপ হয়ে যাবে, তাদের অফিসে কাজ করতে অস্বস্তি হবে।


অন্যদিকে চমৎকার পরিবেশে একজন উচ্চ সংবেদনশীল মানুষ দারুণ কর্মক্ষম হয়ে উঠতে পারেন। তাদের গভীর চিন্তার ক্ষমতা কর্মক্ষেত্রে তাদেরকে অন্যের সাহায্য ছাড়াই নতুন কিছু শিখে নিতে সহায়তা করে। সহকর্মীদের অনুভূতি বা মুডের কথা মাথায় রাখেন বলে এ ধরনের মানুষরা দলগত কাজে অধিক ভূমিকা রাখতে পারেন।


জীবনের অনেকক্ষেত্রেই একজন উচ্চ সংবেদনশীল মানুষ কিছু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। তারা যেকোনো কাজে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন। আপনি অর্কিড, ডেইজি, বা টিউলিপ; যা-ই হোন না কেন, আপনার পক্ষে আপনার পছন্দের কাজটি খুঁজে পাওয়া কখনোই অসম্ভব কিছু হবে না।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.