এক দশকের ভবঘুরে



 ODD বাংলা ডেস্ক: পৃথিবীটাকে ঘুরে দেখার পণ নিয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আজ এক দশক পরেও নিজের এ ভবঘুরে জীবন অব্যাহত রেখেছেন টম গ্রন্ড।


একসময় নেদারল্যান্ডের সরকারি দপ্তরে কাজ করতেন গ্রন্ড। তবে এখন আর নিজের পুরনো জীবনে ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই নিজেকে যাযাবর বলা এই ডাচ ব্লগারের।


সিরিয়া, জর্ডান, কলম্বিয়া, বুরকনা ফাসোসহ বিশ্বের ১৩০টি দেশে ভ্রমণ করে ফেলেছেন টম গ্রন্ড। একবার তো পুরো বছরে ৫৮ বার বিমান ভ্রমণ করেছিলেন তিনি।


ভবঘুরে জীবন শুরু করার আগে একেবারে খালি হাতে অগস্ত্যযাত্রা করেননি গ্রন্ড। প্রায় তিনবছর চলার মতো অর্থ নিয়েই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। খরচের জন্য দৈনিক ৩০ ডলার বাজেট রেখেছিলেন। আর সব পর্যটকদের মতোই বিভিন্ন হোটেলে রাত কাটাতেন তিনি। অনেক হিসাব করে অবশ্য খরচ করতে হতো তাকে।


ট্রাভেলটমটম নামেও পরিচিত গ্রন্ড। তার ভাষায়, 'মানুষ ধরে নেয় আমি নিশ্চয়ই অনেক পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। কথাটা মিথ্যা নয়। আমি নেদারল্যান্ডের মানুষ, তার মানে আমার পাসপোর্টটা খুব উঁচুদরের।'


যাযাবর জীবন


২০১০ সালের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। গ্রন্ড বুঝতে পারেন তার অ্যাডভেঞ্চারগুলো এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করলে হাতে দু'পয়সা আসবে।


২০১৪ সালে ইনস্টাগ্রামে একটি অ্যাকাউন্ট চালু করেন গ্রন্ড। দ্রুতই অনেক ফলোয়ার জুটে যায় সেখানে। অল্প কয়দিনেই ৩০ হাজারের মতো ফলোয়ার পেয়ে যান তিনি।


অবশ্য ট্রাভেল বিষয়ক ব্লগ লেখার চল আগে থেকেই ছিল। কিন্তু 'ট্রাভেল ইনফ্লুয়েন্সার'; অর্থাৎ যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নিজেদের বিশ্বভ্রমণের কথা জানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের সংখ্যা কেবল ধীরে ধীরে বাড়ছিল।


সেইসময় বিভিন্ন হোটেল ও অর্গানাইজেশন গ্রন্ডের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। হোটেলে বিনামূল্যে থাকার বিনিময়ে সেগুলোর কথা ফলোয়ারদের জানাতেন (প্রমোশন) গ্রন্ড।


'প্রথম প্রথম আমার খুব ভালো লাগতো,' গ্রন্ড বলেন। 'মানুষ আমাকে চিনতে শুরু করলো, সেটা চমৎকার একটা অনুভূতি ছিল।'


কিন্তু ধীরে ধীরে তার ওপর নিয়মিত কন্টেন্ট তৈরির চাপ বাড়তে থাকলো। গ্রন্ড বুঝতে পারলেন, এভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না।


২০১৬ সাল। নিজের ব্লগ ট্রাভেলটমটম চালু করলেন গ্রন্ড। এখান থেকে হওয়া আয় দিয়েই বর্তমানে নিজের ভ্রমণ খরচ তুলে নিতে পারছেন তিনি।


তবে এখনো ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এসব প্লাটফর্মে নিজের ভ্রমণের গল্প শেয়ার করেন টম। এই দুই প্ল্যাটফর্মে মোটমাট তার তিন লাখের মতো ফলোয়ার আছে।


অশেষ সব বিদায়বেলা


ব্লগ থেকে আয় শুরু হওয়ার পর নিজের ভবঘুরে জীবনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে গ্রন্ডের। তবে ভ্রমণের বিষয়ে নিজেকে একটুও বদলাননি তিনি।


'আমি এখনো চাই নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে, স্থানীয় লোকদের সাথে মিশতে, তাদের জীবনযাপনের গল্প জানতে,' বলেন গ্রন্ড। 'এ উচ্ছ্বাসটা নিজের মধ্যে না থাকলে আমি অনেক আগেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যেতাম।'


ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিজের ভ্রমণের পরিবর্তনের পাশাপাশি বাস্তবেও পথের মানুষ গ্রন্ড অনেক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছেন। ২০২০ সালের করোনা মহামারিতে পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। এরপর ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের কারণে বৈশ্বিক ভ্রমণে আরেকটু অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।


কোভিডের কারণে গ্রন্ডকে কয়েক সপ্তাহের জন্য বিভিন্ন স্থানে থিতু হতে হয়েছিল। গ্রন্ড বেছে নিয়েছিলেন মেক্সিকো ও তুরস্কের মতো দেশগুলোকে। কারণ এসব দেশে কোভিড বিষয়ক নীতিমালা কিছুটা সহজ ছিল।


ভবঘুরে জীবন নিজের ইচ্ছেতে বেছে নিলেও এর একটা দুঃখের দিকের কথাও বললেন গ্রন্ড। সবসময় ভ্রমণের ওপরে থাকার কারণে মানুষের সাথে সম্পর্ক রক্ষা তার জন্য কিছুটা কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।


'কোনো একটা সম্পর্কে জড়ানো আমার জন্য অসম্ভব একটি ব্যাপার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দৌলতে আজকাল যেকারও সাথেই হয়তো যোগাযোগ রাখা সম্ভব। কিন্তু আমি প্রতি এক-দুই সপ্তাহে এমনকি কখনো কখনো কয়েক দিনের বিরতিতে নিজের অবস্থান বদলাচ্ছি,' গ্রন্ড বলেন।


'ধরুন এমন কারও সাথে দেখা হলো যার সাথে আপনার ঘুরতে ভালো লাগে, আড্ডা দিতে ভালো লাগে। তখন ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। আমি আদতে সবসময় মানুষকে বিদায় জানিয়েই আসছি। আমাকে মানুষের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয় প্রতি কয়েকদিন অন্তর অন্তর। এটা একটা লড়াই আমার জন্য।'


নিজের দশ বছরের জীবনে ইতিবাচক ঘটনার সংখ্যাই বেশি গ্রন্ডের। তবে মাঝেমধ্যে যে আতান্তরে পড়েননি তাও নয়। একবার পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গ্যাবনে অভিবাসন-পুলিশ তাকে আটক করে। সে-সময় রাজ্যের আইনি ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে নিজের পরিবার-প্রিয়জনদের কথা বারবার মনে পড়ছিল তার।


তবে গ্রন্ড জানান, বাড়ির লোকদের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। এমনকি যাত্রাপথে বানানো বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ রাখেন তিনি। 'ওদের মিস করার মতো সময় আমার নেই,' গ্রন্ডের ভাষায়।


দৃষ্টিভঙ্গির নিয়ত পরিবর্তন


নিজের ভ্রমণ করা অসংখ্য স্থানে মধ্যে সিরিয়ায় ভ্রমণ গ্রন্ডের জীবনে অনেক বড় প্রভাবে ফেলেছিল। ২০১৯ সালে এক এজেন্সির সহায়তায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে প্রবেশের সুযোগ পান তিনি।


'অনেক খরুচে একটা ট্রিপ ছিল সেটি,' গ্রন্ড মনে করেন। 'নিরাপত্তাসহ অন্যান্য অনেক জিনিসের জন্য অর্থ খরচ করতে হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো জলে যায়নি।'


গ্রন্ড বলতে থাকেন, 'অনেকগুলো শহর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেবল কয়েকটি ভবন ছাড়া আর কিছু অক্ষত নেই, এমন অবস্থা হয়েছিল শহরগুলোর। কিন্তু সেখানতার স্থানীয়দের মধ্যে যে পরিমাণ দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাস দেখেছিলাম, তা আমাকে বিস্মিত করেছিল।' সিরিয়ার পর পাকিস্তান ও ইরাক ভ্রমণ করেছিলেন গ্রন্ড। এসব দেশে ভ্রমণ নিয়ে অনলাইনে তার অনুসারীদের প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হয়েছিলেন তিনি।


ভ্রমণ জীবনের প্রথমদিক থেকেই যে বিশ্ব প্রদক্ষিণের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেননি গ্রন্ড। প্রায় সাতবছর ভ্রমণের পর তিনি ঠিক করেন বিশ্বের প্রতিটি দেশ ঘুরতে হবে তাকে। 'এসব দেশে গিয়ে সেগুলো নিয়ে আমাদের পূর্ববর্তী দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারা দারুণ একটি ব্যাপার,' গ্রন্ড ব্যাখ্যা করেন।


তবে আপাতত এ চ্যালেঞ্জ পূরণে তাড়াহুড়ো করছেন না গ্রন্ড। তিনি ধীরেসুস্থে সব দেশ ভ্রমণ করতে চান। তার কাছে জীবনটা উপভোগের, কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর কোনো দৌড় নয়।


যে অভিযানের শেষ নেই


টম গ্রন্ডের মতো অনেক ভ্রমণকারী আছেন যারা তার মতো বিশ্বের সবকটি দেশ ঘুরে বেড়ানোর প্রতিজ্ঞা করেছেন। সেজন্য তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। ভ্রমণের তালিকায় নতুন নতুন দেশ যোগ করার তাদের এ চেষ্টাকে ইঁদুরদৌড় হিসেবে দেখেন করেন গ্রন্ড।


'আমি যখন তাদেরকে অনলাইনে দেখি, তখন মনে হয় তাদের কাছে এ বিশ্বভ্রমণ স্রেফ একটা সংখ্যার বিষয়। আমি এ ইঁদুরদৌড়ের অংশ হতে চাই না,' গ্রন্ডের চিন্তা এমনই।


এখন পর্যন্ত ভ্রমণ করা ১৩০টা দেশের মধ্যে প্রায় ৭১টি দেশে দুইবার গিয়েছেন গ্রন্ড। নিজের প্রিয় ভ্রমণ গন্তব্যে বারবার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো আপত্তি নেই।


'পাকিস্তানে আমি চারবার গিয়েছি। থাইল্যান্ডে তো ১৭ বার যাওয়া হয়ে গিয়েছে। তুরস্ক বছরে দুইবার দেখা হয় আমার। ইস্তাম্বুল আমার ভালোবাসার একটি শহর।'


আগবাড়িয়ে কোনো পরিকল্পনা করে বসে থাকেন না গ্রন্ড। এমনও হয় পরের সপ্তাহে কোথায় থাকবেন সে নিয়েও চিন্তা করেন না তিনি। বর্তমানে গ্রন্ড পানামা আছেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তার বোগোতা পৌঁছানোর কথা রয়েছে। সেখান থেকে উড়াল দেবেন প্যারাগুয়েতে।


'আমার আপাতত প্রাথমিক পরিকল্পনা হচ্ছে কয়েক সপ্তাহ দক্ষিণ আমেরিকায় কাটানো, এরপর খানিকটা সময়ের জন্য মধ্য আমেরিকায় যাওয়া। এরপর একবার নেদারল্যান্ডে গিয়ে পরিবারের সাথে দেখা করে আসব।'


আগামী মাসগুলোতে পশ্চিম আফ্রিকায় রওনা দেবেন গ্রন্ড। সেখানে সপ্তাহ আটেক সেনেগাল, গাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, ঘানা, ইকুয়েটর গিনি ইত্যাদি দেশে কাটাবেন তিনি। আফ্রিকা নিয়ে গ্রন্ডের আগ্রহের অন্ত নেই। তার গত দুই বছরের ভ্রমণ জীবনে আফ্রিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।


গ্রন্ড বলেন, 'মানুষ প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে বাড়ি ফিরব কবে। কিন্তু আমার তো কোনো বাড়ি নেই। আর আমার এ ভবঘুরে জীবনে কখন থিতু হবো তারও কোনো ঠিক নেই'।


আগামী ডিসেম্বরে নিজের ভূপর্যটনের এক দশক উদযাপন করবেন টম গ্রন্ড। তবে সেদিনটিকে কীভাবে উদযাপন করবেন সে বিষয়ে তার ভ্রমণ পথের মতোই এখনো অনিশ্চিত গ্রন্ড।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.