নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় যেসব পরীক্ষা নিয়মিত করা উচিত

 


ODD বাংলা ডেস্ক: কারো কোনো অসুখ না হলে চিকিৎসকের কাছে সাধারণত যান না। এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও প্রয়োজন বোধ মনে করেন না অনেকে। নারীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও রয়েছে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি। নিয়মিত মেডিক্যাল চেকআপের মাধ্যমে দেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা অসুখগুলো নিরূপণ করে সঠিক চিকিৎসা দিয়ে জটিলতা এড়ানো যায়।


নারীদের সুস্থ রাখা মানে একটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুস্থ রাখা। কিন্তু নারীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কর্মজীবী হোক বা গৃহিণী, উচ্চশিক্ষিত হোক বা স্বল্পশিক্ষিত, অসচেতনতা যেন সব জায়গায়!


আমাদের দেশের বেশির ভাগ নারী, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নারীরা ক্যালসিয়ামের ঘাটতি, স্তন ক্যান্সার, জরায়ুর ক্যান্সার, যৌন ও প্রজননবিষয়ক রোগ, ঋতুস্রাবসংক্রান্ত জটিলতা, বিষাদগ্রস্ততা, হরমোন সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগে থাকেন। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তাঁরা কারো সঙ্গে খোলামেলাভাবে আলোচনা করতে পারেন না।


অসাবধানতাবশত এই সমস্যাগুলো দিনের পর দিন তাঁরা লুকিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে নারী স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি আরো প্রকট আকার ধারণ করে।

 

কিছু নিয়মিত পরীক্ষা


নারীর স্বাস্থ্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে নিজেদেরই। ভয় ও লজ্জা কাটিয়ে সচেতনতা অবলম্বন করে স্বাস্থ্য রক্ষার্থে কিছু নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। যেমন—


রক্ত পরীক্ষা :


সারা দেশে নারীদের মধ্যে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে রক্তাল্পতার সমস্যা। তাই মাঝে মাঝে রক্ত পরীক্ষা এবং অন্যান্য পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং চিকিৎসকের নির্দেশমতো খাদ্যাভ্যাস পাল্টাতে হবে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ না খেয়েও রক্তাল্পতা দূর করা যায়।


ডায়াবেটিস : সেন্টার ফর ডায়াবেটিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন  ৪৫ বছরের বেশি বয়সের নারীদের ডায়াবেটিসের পরীক্ষার সুপারিশ করেছে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস আছে অথবা ওজন বেশি—এমন নারীরা কম বয়সী হলেও এ পরীক্ষা নিয়মিত করা উচিত।


থাইরয়েডের সমস্যা : নারীর শারীরিক, মানসিক, প্রজনন ও যৌনজীবনের নানা ক্ষেত্রে নানা পর্যায়ে নানা বিচিত্র উপসর্গ নিয়ে দেখা দেয় থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা। এই গ্রন্থির প্রভাব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। খুব সামান্য বা ক্ষুদ্র, প্রায় অনুল্লেখ্য উপসর্গকেও তাই আমলে আনা উচিত।


রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল : অধিক কোলেস্টেরল কিংবা রক্তচাপ নারীদের স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই ২০ বছরের বেশি বয়সের নারীদের অবশ্যই বছরে কমপক্ষে দুবার রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল পরীক্ষা করা উচিত।


হাড়ের ক্ষয় :


মেরুদণ্ড বা নিতম্বের হাড়ের ক্ষয় মাপা এবং অস্টিওপোরোসিস রোগ নির্ণয়ের জন্য ডুয়াল এনার্জি এক্স-রে অ্যাবজর্পটিওমেট্রি অথবা স্ট্যান্ডার্ড বোন ডেনসিটি পরীক্ষা করা হয়। হাড়ের ঘনত্ব বেড়ে গেলে হাড় ভাঙার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ৬০ বছর ও তার থেকে বেশি বয়সের নারীদের হাড়ের ঘনত্বের পরীক্ষা করা উচিত।


স্তন ক্যান্সার :


৪০ বছর ও তার থেকে বেশি বয়সী নারীদের স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে অবশ্যই ধারণা থাকা দরকার। কারণ এটা বয়স বাড়ার সঙ্গে হতে পারে। মেমোগ্রাম করানোটা দরকার, যেহেতু এতে স্তন ক্যান্সারের প্রবণতা হওয়ার আশঙ্কা বোঝা যায়। মেমোগ্রাম হলো স্তনের এক্স-রে এবং স্তন ক্যান্সারের প্রাথমিক ধাপ বোঝার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকর। গবেষণা বলছে, ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ক্ষেত্রে মেমোগ্রাম স্ক্রিনিং স্তনের ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুর হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমায়।


যৌন মিলনের দ্বারা বাহিত সংক্রমণ : যৌন মিলনের দ্বারা বাহিত রোগ যেকোনো নারীর হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)-এর বরাতে জানা যায়, যাঁরা নিয়মিত দাম্পত্য সম্পর্ক যাপন করেন তাঁদের প্রতিবছর গনোরিয়া পরীক্ষা করে দেখা উচিত।


জরায়ু ক্যান্সার : জরায়ুর ক্যান্সার হলো এক ধরনের ক্যান্সার, যা যোনি ও জরায়ুর সংযোগস্থলের কোষে ঘটে। ২১ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদের জন্য প্রতি তিন বছরে তাদের প্যাপস্মিয়ার করা গুরুত্বপূর্ণ। ৩০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের অবশ্যই তাদের প্যাপস্মিয়ারের সঙ্গে একটি এইচপিভি-ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।


সুস্থ থাকার জন্য প্রত্যেক মানুষের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। জীবনের নানা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ভালো থাকার জন্য রোগ সম্পর্কে আগে থেকেই জেনে নেওয়াটা তাই বুদ্ধিমানের কাজ।


শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য করণীয় 


শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য আরো যা করা যেতে পারে তা হলো :


খাদ্যাভ্যাস


রুটিনমাফিক পরিমিত খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত প্রয়োজন। বয়স বাড়লে বিভিন্ন হরমোনজনিত কারণে মেয়েরা একটু মোটা হয়ে যেতে পারে। আর এই শরীর ভারী হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা সঠিক খাদ্যাভ্যাস থাকলে সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। কী খাবার খাচ্ছেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। তৈলাক্ত এবং অত্যধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার এড়িয়ে খাদ্যতালিকায় শাকসবজি, ফলসহ পুষ্টিকর খাবার বেছে নিন।


খাওয়ার সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঠিক সময়ে খাওয়া। তাই একটু সচেষ্ট হয়ে রুটিনমাফিক খাওয়াদাওয়া করলে নিজের যত্ন অনেকাংশেই নিশ্চিত করা যায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্যাপ্ত জল পান করা।


পরিমিত বিশ্রাম


পর্যাপ্ত ও শান্তির ঘুম না হলে মানসিক প্রশান্তি আসবে না। শুধু পর্যাপ্ত ঘুম নয়, প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিশ্রামেরও। এ ক্ষেত্রে রুটিনমাফিক বেশি রাত না জেগে তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে যাওয়া এবং খুব ভোরে দিন শুরু করলে শরীর ও মন দুটোই প্রাণবন্ত রাখা সম্ভব।


ব্যায়াম কিংবা ইয়োগা


প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা হালকা ব্যায়াম অথবা ইয়োগা সত্যিই শরীর ও মন দুটোই নিমেষেই করে ফেলতে পারে চাঙ্গা। এক্সারসাইজ বলতে একেবারেই জিমে যেতে হবে এমন নয়। বর্তমানে অনেক নারীকেই মেডিটেশন করার ব্যাপারে উৎসাহী হতে দেখা যাচ্ছে। আর মেডিটেশন যদি না-ও শুরু করা হয়, তবে দেহ-মনের আড়ষ্টতা দূর করতে বডি ম্যাসাজও বেশ কার্যকর।


প্রতিদিন ভোরে একটানা কোনো পার্ক অথবা নিদেনপক্ষে ঘরের ভেতরেই হেঁটে বেড়ালেই শরীর অনেকটাই ফিট রাখা সম্ভব। প্রতিদিন এক্সারসাইজের জন্য হার্ট রেট বজায় থাকবে, শরীরের রক্তসঞ্চালনপ্রক্রিয়াও স্বাভাবিক থাকবে।


 

শৌখিন কিছু করা


মনে রাখা জরুরি, জীবনটা শুধু দায়িত্ব পালনের জন্যই নয়; পাশাপাশি এনজয় করাটাও সবারই প্রাপ্য। নারী মানে ব্যস্ততা থাকবেই। কিন্তু এর পরও নিজেদের মনে আনন্দের খোরাকের জন্য মাঝে মাঝে কিছুটা সময় তাঁদের পছন্দমতো কিছু একটা করা সত্যিই উচিত। সেটা হতে পারে বই পড়া, গান শোনা (আর নিজে কোনো একসময় গুন গুন করার অভ্যাস থাকলে রেওয়াজটা শুরুই করে দেওয়া), যেটাই মন চায়।


এমনকি বাড়ির ছাদে অথবা বারান্দায় একটি ছোট বাগানের পরিচর্যা করলেও মন ভালো হয়ে যায়।


সুস্থতা বলতে আমরা শুধু শারীরিক সুস্থতাকেই বুঝি। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বেঁচে থাকতে হলে আমাদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.