নিরাপদে নারীদের বিশ্ব ঘুরিয়ে আনবে 'ওয়ান্ডার উইমেন'

 


ODD বাংলা ডেস্ক: কর্মক্ষেত্রে নারীরা পারদর্শিতার সাথে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে ভ্রমণ ইচ্ছা ও দেশ-বিদেশ ঘুরে বিশ্বকে জানার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হচ্ছে। কিন্তু, ভ্রমণ পিপাসু অনেক নারী নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে একা বা শুধু নারীরা মিলে কোথাও ভ্রমণে বের হন না। বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে আর এই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় যাদের এতো অবদান, তারা কেন এখনো এইদিক থেকে পিছিয়ে থাকবে?


নারীদের বাধাহীন ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন পূরণে কাজ করছে 'ওয়ান্ডার উইমেন' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ফেসবুকে তাদের পেজটি খোলা হয়েছে নারীদের ভ্রমণ বিষয়ক সবরকম সহায়তা দিয়ে তাদের ভ্রমণ ইচ্ছা পূরণ করার লক্ষ্যে। 'ওয়ান্ডার উইমেন' প্রতিষ্ঠানের উদ্যাক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা সাবিরা মেহরিন। তিনি নিজেও একজন ভ্রমণ পিপাসু, সেখান থেকেই তার এই চিন্তার উদ্ভব। দীর্ঘ সময় সাবিরা মেহরিন পাহাড়ি অঞ্চলে কাটিয়েছেন। প্রকৃতির কাছাকাছি বড় হওয়াতে ভ্রমণের প্রতি সবসময় তিনি আলাদা টান অনুভব করতেন।


সাবিরা মেহরিন বলেন, "এখন আর নিরাপত্তার কথা ভেবে নারীদের নিজেদেরকে ভ্রমণ করা থেকে বিরত রাখতে হবে না। কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই নারীদের নিরাপদে ভ্রমণের ব্যবস্থা ও তা নিশ্চিত করতে সবসময় কাজ করে যাচ্ছে 'ওয়্যান্ডার উইমেন'। আমরা স্বপ্ন দেখি এমন একদিনের যেদিন নারীরা দেশ-বিদেশ নিরাপদে ভ্রমণ করে বিশ্বকে জয় করবে এবং বহুদূর এগিয়ে যাবে।"


চিন্তা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত


ওয়ান্ডার উইমেন নামটি শুনলেই আমাদের কল্পনায় ভেসে আসে ডিসি কমিকসের এমন একজন নারী চরিত্র, যার মধ্যে সুপারপাওয়ার রয়েছে এবং তার এই শক্তির বলে অসাধ্য জটিলসব কাজ তিনি একাই সাধন করতে পারেন। বাংলাদেশের ভ্রমণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান 'ওয়ান্ডার উইমেন' একজন নারীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে একদল নারী বিভিন্ন পদে কাজ করছেন। 'ওয়ান্ডার উইমেন' এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে বিশ্বাস করা হয় প্রতিটি নারীর মধ্যেই রয়েছে এমন শক্তিশালী ক্ষমতা, যার বলে নারীরা চাইলেই বিশ্বের বুকে অবিরাম বিচরণ করতে পারবে। আর তা বাস্তবায়নে পথপ্রর্দশক হিসেবে কাজ করে যাবে তারা।


সাবিরা মেহরিনের 'ওয়ান্ডার উইমেন' প্রতিষ্ঠার চিন্তার উদ্ভব হয় যখন তিনি নিজের জীবনের কঠিন কিছু অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-তে অধ্যায়নকালীন তিনি বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। সেখান থেকে তার দেশের বাইরে কনফারেন্সে যোগদান ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ আসতে শুরু করে। কিন্তু একজন মেয়ে হয়ে একা দেশের বাইরে যাবেন এটা নিয়ে তার পরিবারের থেকে ঘোর আপত্তি ছিল। এভাবেই তিনি একে একে নিজের স্বপ্নগুলো চোখের সামনে ভেঙ্গে যেতে দেখছিলেন। কিন্তু একটা সময় পরে যখন তিনি তার পরিবার থেকে অনুমতি পেলেন, তখন তিনি বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন।


ভ্রমণে বের হয়ে তিনি বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হোন এবং দেখতে পান দেশের ভিতরে ও বাইরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে একজন নারীকে নানারকম সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। সেখান থেকেই তার চিন্তার শুরু হয় কীভাবে তিনি নারীদের কাছে ভ্রমণকে সহজলভ্য করে তুলে তাদের স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে তিনি সহজেই মানুষের কাছে নিজের কাজ তুলে ধরতে পারবেন বলে সেখানেই শুরু করেন তার পথচলা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে 'ওয়ান্ডার উইমেন' নামের একটি পেজ খুলেন। বর্তমানে ফেসবুকের এই পেজটিতে প্রায় ১৬ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। কিন্তু 'ওয়ান্ডার উইমেনের' বিস্তার ছড়িয়ে পড়েছে দূর-দূরান্তের মানুষের কাছে। তাইতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন না এমন অনেকেই এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্নরকম তথ্যসেবা নিয়েছেন এবং বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছেন।


প্রতিষ্ঠাতা সাবিরা মেহরিন বলেন, "প্রথমদিকে এই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করানো আমার জন্য সহজসাধ্য ছিলনা। নারীরা বিভিন্ন দিক থেকে স্বাধীন থাকলেও নারী হয়ে একা ভ্রমণে বের হবেন, এটা ভাবতে অনেকের মধ্যেই দ্বিধা কাজ করতো। তাই এইরকম কিছু বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটা নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু কাজটি শুরু করার পর আমি ভালো সাড়া পেয়েছিলাম নারী পুরুষ সকলের কাছ থেকে। বাংলাদেশে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি থাকলেও শুধু নারীদের জন্য কোনো প্লাটফর্ম ছিলনা, যেখানে ভ্রমণের পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের কাজ এগিয়ে নিতে সহায়তা করা হবে।"


নারীদের জন্য প্লাটফর্মটি তৈরি করা হলেও 'ওয়ান্ডার উইমেন' নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে তাদের সেবা ও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে। কোনো নারী চাইলে তার পরিবারের পুরুষ সদস্য বা বন্ধুদের নিয়ে এই প্লাটফর্ম থেকে ভ্রমণে যেতে পারবেন। অনেক নারী আছেন যারা ট্রাভেলস গ্রুপের সাথে নারী-পুরুষ একত্রে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। আবার নিরাপত্তার কথা ভেবে শুধু নারীরা কোথাও ভ্রমণে যাবেন সে কাজটিও করা হয়ে উঠে না। তাই সবার কথা বিবেচনায় রেখে 'ওয়ান্ডার উইমেন' তাদের সেবাসমূহ পরিচালনা করে থাকে।


ভ্রমণ বৃত্তান্ত


'ওয়ান্ডার উইমেন' ভ্রমণ সংক্রান্ত পরামর্শ, তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি এ পর্যন্ত ২৫০টি ট্যুরের আয়োজন করেছে। এরমধ্যে দেশের বাইরে ১২টি রাষ্ট্রে ভ্রমণ আয়োজন করা হয়, যার বেশিরভাগই ছিল এশিয়া মহাদেশে। মূলত মৌসুমের ওপর ভিত্তি করে ভ্রমণের স্থানসমূহ নির্ধারণ করা হয়। যেমন শীতের সময় পাহাড়ে যাওয়া এবং বর্ষায় ঝর্ণা, লেক ও হাওরের মতো স্থানগুলোতে ট্যুর প্লান করা হয়।


'ওয়ান্ডার উইমেন' থেকে আয়োজিত প্রতিটি ট্যুরে ১০-১৪ জন সদস্যের বেশি নেওয়া হয়না। সদস্য সংখ্যার সীমাবদ্ধতা নিয়ে সাবিরা মেহরিন জানান, "অন্যান্য ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে অর্ধশতাধিক মানুষজন নিয়েও ট্যুর আয়োজন করতে দেখা যায়। কিন্তু 'ওয়ান্ডার উইমেন' খুব বেশি সদস্য নিয়ে ট্যুরে না যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে- আমরা সবাইকে সমান গুরুত্ব দিতে চাই। ভ্রমণকারীদের ভ্রমণকে আরামদায়ক করতে তুলতে আমরা সবরকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। হোটেলে থাকার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া সবকিছুর মান বজায় রাখতে আমরা সচেষ্ট থাকি। তাই সীমিত সংখ্যার সদস্য নিয়ে আমরা আমাদের ট্যুরগুলোর আয়োজন করে থাকি।"


"কম সংখ্যক মানুষ কোথাও গেলে যেরকম খরচ পরে, একত্রে অনেকজন মিলে গেলেও প্রায় একইরকম খরচ পরছে। এক্ষেত্রে সেবার মান নিচে নামলেও ট্রাভেল এজেন্সির লাভের হার টা বেশি থাকে। কিন্তু আমরা মানের দিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি, যার ফলে লাভের দিকটা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারপরেও আমরা চাই 'ওয়ান্ডার উইমেন' ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশের পাশাপাশি মানুষের আস্থার জায়গায়টাও ধরে রাখুক।"


'ওয়ান্ডার উইমেনের' কার্যক্রম


ভ্রমণের পাশাপাশি 'ওয়ান্ডার উইমেন' নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে 'ওয়ান্ডার ভেঞ্চারস' নামের প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এখানে ৩০০ জনের বেশি নারী উদ্যোক্তা নিয়ে মেলার আয়োজন করা হয়, যেখানে তারা তাদের তৈরি করা পণ্য বিক্রি করেন। এছাড়াও এয়ার টিকেট বুকিং, হোটেল বুকিং, যোগব্যায়াম কর্মশালা, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট, ট্রেকিং ট্রেনিং ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে নারীদের আত্মরক্ষা, সাঁতার ইত্যাদি শেখানোর জন্য ডব্লিউডব্লিউ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে 'ওয়ান্ডার উউমেন'। প্রতিটি ওয়ার্কশপ থেকে ২০-২৫ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।


প্রথা ভেঙে দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ভ্রমণকারীদের উৎসাহ দেওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি 'ওয়ান্ডার উইমেন' জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বৈশ্বিক উদ্ভাবন কর্মসূচি 'আনলিশ প্লাস ২০২১' জিতে ২০ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছে।


সাবিরা মেহরিনের পরিকল্পনা এই অর্থ দিয়ে তিনি 'ওয়ান্ডার উইমেনের' জন্য ওয়েবসাইট নির্মাণ করবেন। বর্তমানে ভ্রমণ সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানতে গ্রাহকরা ফেসবুক পেজটিতে যোগাযোগ করেন। 'ওয়ান্ডার উইমেন' তাদের এই গ্রাহক সেবা ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে, যেন গ্রাহকরা যেকোনো সময় নিজের প্রয়োজনে এখান থেকে  তৎক্ষণাৎ তথ্য পেতে পারেন। এছাড়াও বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে 'ওয়ান্ডার উইমেন' চুক্তিবদ্ধ হয়ে একত্রে কাজ করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যেখান থেকে গ্রাহকরা ট্রাভেল লোনসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধা পাবে।


এবছরের মধ্যে ট্রেকিং ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে 'ওয়ান্ডার উইমেন' গ্রুপটি। নারীরা তাদের জড়তা কাটিয়ে যেন নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে বিশ্বের বুকে ঘুরে বেড়াতে পারে, তা নিশ্চিত করতে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে 'ওয়ান্ডার উইমেন'।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.