ইঞ্জিন নয়, হাতি আর গরু দিয়ে চলত বাংলার ট্রেন!
ODD বাংলা ডেস্ক: ১৮৭৮ সালে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন শুরু করা হয়েছিল। তার কিছুদিন পর চালু হয় দার্জিলিং মেল। তখন এই ট্রেন শিয়ালদহ, রানাঘাট, অবিভক্ত বাংলার ভেড়ামারা, সারা সেতু, ঈশ্বরদী, সান্তাহার, হিলি, পার্বতীপুর, নীলফামারী, হলদিবাড়ি, জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়িতে প্রবেশ করত। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনেই তা থামত। তখন শিয়ালদহ স্টেশনের নাম ছিল ক্যালকাটা স্টেশন।
১৯১৫ সালে দার্জিলিঙের লেখক ইসি ডজ তার এক বইতে লেখেন, সেই সময় ভারতের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন ছিল দার্জিলিং মেল। দার্জিলিং মেলের অনেক পর শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন পর্যন্ত নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস চালু হয়।
১৮৮১ সালে দার্জিলিং মেল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন পর্যন্ত এলে তাকে ঐ নাম দিয়েই বড়ো লাইন থেকে ছোটো লাইনে ছোটো কামরা দিয়ে দার্জিলিং নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর এর সঙ্গে সঙ্গেই দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের টয় ট্রেন চালু করার কাজ চলে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে নেতাজি, স্বামী বিবেকানন্দসহ বাংলার বহু মনীষীদের অধিকাংশই দার্জিলিং মেলে কলকাতা থেকে পাহাড়ে এসেছেন।
তারা শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে নেমে টয় ট্রেনে করে পাহাড়ে গিয়েছেন। পরে ষাটের দশকে এনজেপি স্টেশন চালু হলে এই ট্রেন শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের পরিবর্তে এনজেপি ও শিয়ালদহের মধ্যে চলাচল শুরু করে।
এই দার্জিলিং মেল হল দেশের পূর্ব অঞ্চলের একটি কিংবদন্তি ট্রেন। শিয়ালদহ থেকে এনজেপি পর্যন্ত এই ট্রেনের দূরত্ব ৫৬৭ কিলোমিটার। সাধারণভাবে এর গড় যাত্রা সময় ৯ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। এর সাধারণ গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার।
সর্বোচ্চ গতি ১১০ কিলোমিটার। এই ট্রেন ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৯০ কিলোমিটার গতিতে চলে। তবে এসবের আগে ১৮৬৯ সালে কলকাতা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চলত বুলক ট্রেন। বার্ড কোম্পানি এই ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নেয়। সেই কোম্পানির প্রধান ছিলেন স্যাম বার্ড। তার মাথা থেকেই বলদের সাহায্যে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা হয়।
তবে সেই ট্রেনে যাত্রী ছিল না। যখন দার্জিলিং মেল বা টয় ট্রেন চালু হয়নি সেই সময় ব্রিটিশরা পাহাড়ের চা বাগানের চা ব্যবসা বা অন্য পণ্য পরিবহনের জন্য বুলক ট্রেনের সাহায্য নিতেন। সাহেবগঞ্জ থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত চলত এই ট্রেন। কারাগোলা ঘাট হয়ে পুরনিয়া ভায়া চলত ট্রেনটি। তখন হিলকার্ট রোডের নাম ছিল ওল্ড কার্ট রোড। মোট ১৮৮ মাইলের যাত্রাপথ। এই ট্রেন বিভিন্ন স্থানে দাঁড়াত পণ্য ওঠানো নামানোর জন্য। ট্রেনের কামরা ছিল বাক্সের মতো। দুইপাশে দুটি চাকা, কামরার মাথায় থাকত ত্রিপলের ছাউনি। দুটি বলদ সেইসব কামরা টেনে নিয়ে যেত। কোনো লাইন ছিল না। একটি বলদ অসুস্থ হলে তার জন্য বাড়তি বলদ তৈরি করা থাকত।
বর্ষাকালে আবার হাতিতে টানত সেই পন্যবাহী কামরা। আর এসব চালাতে বার্ড কোম্পানি একটি ১৩০০ টাকা দিয়ে হাতিও কিনেছিল। আরেকটি হাতি এর জন্য মাসে ২০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে আসা হয়েছিল। ট্রেন পাহারা দেওয়ার জন্য আবার লাঠিধারী চাপরাশি থাকতেন একজন। তবে সেই সময় এই ট্রেন চালাতে গিয়ে কোনো ছিনতাই বা অশান্তির ঘটনা ঘটেনি।
এইভাবে ১৪ বছর চলার পর ১৮৮১ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে স্থাপিত হয়। বার্ড কোম্পানির তরফে পল বার্ড রেলের সঙ্গে সমঝোতা করে সেই বুলক ট্রেন পরিষেবা চালু রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু সফল হননি। শেষমেশ সেই বার্ড কোম্পানি ২০ হাজার টাকায় তাদের সব গোডাউনসহ অন্য সামগ্রী রেলের কাছে বিক্রি করে দেন।
ইতিহাসের বুক থেকে হারিয়ে যায় সেই বুলক ট্রেন। পাহাড়ে চলে আসে টয় ট্রেন বা খেলনা ট্রেন। আর কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন এবং টাউন স্টেশন থেকে ছোটো লাইনে ছোটো ট্রেন দার্জিলিং মেল নামেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।
Post a Comment