আজও সাজানো আছে গ্যালিলিওর আঙুল!

ODD বাংলা ডেস্ক: ডিম্বাকার কাচের জারে সযত্নে আজও সাজানো আছে একটি শীর্ণকায় আঙুল। দেখে মনে হবে ঠিক যেন মমি। কিংবা জীবাশ্ম। ফ্লোরেন্স মিউজিয়ামে প্রতিদিন এই আঙুল দেখতেই ভিড় জমান হাজারো পর্যটক। সেই আঙুল তো আর যে-সে আঙুল নয়। কয়েকশো বছর আগে এই আঙুলই তারা দেখতে শিখিয়েছিল মানুষকে। শিখিয়েছিল আসলে প্রদক্ষিণ সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে পৃথিবী। এই আঙুল আধুনিক পদার্থবিদ্যার জনক গ্যালিলিওর।
স্বাভবিক নিয়মেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, কেবলমাত্র আঙুল কেন? সংরক্ষণ যদি করারই হতো তবে তো গ্যালিলিওর পুরো দেহটিকেই সংরক্ষণ করা যেত মিউজিয়ামে। তাহলে? আসলে এই আঙুলের পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

ইতালির ইউনিভার্সিটি অফ পাদুয়া। কারাবন্দি হওয়ার আগে পর্যন্ত সেখানেই অধ্যাপনা করেছেন গ্যালিলিও। সেইসময়েই তিনি লিখে রেখেছিলেন নিজের এপিটাফ। ইচ্ছেপ্রকাশ করেছিলেন, যেন মৃত্যুর পর তাকে সমাধিস্থ করা হয় তাসকানির সান্তা ক্রোসে ব্যাসিলিকায়। সেখানেই যে রয়েছে তার বাবা, মা এবং পূর্বপুরুষদের সমাধি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন এভাবেই কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি।

অধ্যাপক হিসাবে তার খ্যাতি কম ছিল না গোটা ইতালিজুড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পূর্ণতা পেল না তার সেই ইচ্ছে। বাধ সাধল স্বয়ং তারই আবিষ্কার। দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে গ্যালিলিও দেখালেন সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে নয়, বরং পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে। তার সেই আবিষ্কারই রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সমাজকে। কেননা, এই বক্তব্য যে ক্যাথোলিক চার্চ এবং পোপের ধর্মমতের বিরুদ্ধাচরণ। ফলে গোটা সমাজের শত্রু হয়ে উঠতে সময় লাগেনি খুব বেশি দিন।

গবেষণার সুযোগ তো বটেই, কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তার সব স্বাধীনতাই। জায়গা হয়েছিল ছোট্ট অন্ধকার কারগারে। আমৃত্যু সেখানেই দিনগুজরান করেছেন গ্যালিলিও। মৃত্যুর পরেও তাকে দেওয়া হয়নি যোগ্য সম্মানটুকু। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আবর্জনার মতোই তার দেহ ফেলে দিয়ে আসা হয়েছিল নিকটবর্তী একটি ছোট্ট ভগ্নপ্রায় চ্যাপেলে।

এরও বহু বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর গ্যালিলিওর আবিষ্কারকে স্বীকৃতি জানান এক তরুণ বিজ্ঞানী। আইজ্যাক নিউটন। গণিত এবং তত্ত্বের সাহায্যে তিনি পুনপ্রতিষ্ঠা করেন গ্যালিলিওর দাবিকে। প্রথাগত ধারণার সমীকরণটা বদলে যায় তখন। এমনকি নিউটনের আবিষ্কারকে বিশ্বের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সংস্থা মান্যতা দেওয়ার পর নড়ে-চড়ে বসেন পোপ ও শীর্ষস্থানীয় ধর্মগুরুরা। অপরাধের বোঝা সরিয়ে নেওয়া হয় গ্যালিলিওর ওপর থেকে। তুলে নেওয়া হয় গ্যালিলিওর আবিষ্কারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও।

সেটা ছিল ১৭১৭ সাল। তারও বছর কুড়ি পর গ্যালিলিওর অনুরাগী এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের দাবিতে, তার সমাধিস্থ মরদেহ সান্তা ক্রোশে ব্যসিলিকায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেইসময়েই তার কফিন থেকে তিনটি আঙুল, দাঁত এবং কশেরুকা একটি অংশ সংগ্রহ করে রাখেন তার বেশ কিছু ভক্ত।

একাধিক হাত ঘুরে ২০০৯ সালে সেই দেহাংশগুলো এসে পৌঁছায় পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে প্রাথমিকভাবে সেই দাবি মানতে চাননি প্রত্নতাত্ত্বিকরা। পরবর্তীতে সান্তা ক্রোশে ব্যাসেলিকা থেকে সংগৃহীত গ্যালিলিওর দেহাংশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয় এই আঙুলগুলোর ডিএনএ। আর তাতেই চমকে ওঠেন গবেষকরা। হ্যাঁ, এই আঙুল গ্যালিলিওরই।

এমন তথ্য প্রকাশ্যে আসার পরেই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে ফ্লোরেন্স মিউজিয়াম। সেগুলোর নিলামে বিক্রি হওয়া আটকায় মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। ব্যবস্থা করে সংরক্ষণের। আজও সেখানেই সংরক্ষিত রয়েছে গ্যালিলিওর সেই আঙুল। ফ্লোরেন্সের এই মিউজিয়ামের নামও পরবর্তীতে বদল করে রাখা হয়েছে গ্যালিলিওর নামেই।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.