রাত আটটা বাজলেই...! জানুন প্রাচীন বাংলার ভয়ঙ্কর ডাকাতের ইতিহাস

ODD বাংলা ডেস্ক: সুদূর অতীতের নানা কাহিনিতে আমরা খুঁজে পাই বিখ্যাত সব ডাকাতদের কথা। তারা রাতে ডাকাতি করতেন। আর দিনে কৃষক, শ্রমিক বা নৌকার মাঝির কাজে যুক্ত থেকে গোপনে বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করতেন। দেশ বিভাগের আগে কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চল ও শিমলাপল্লিতে ডাকাতদের বিরাট আস্তানা ছিল।

জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ইংল্যান্ডের রানির হাতে শাসনভার অর্পিত হলে, প্রাদেশিক শাসন থেকে ক্রমে কেন্দ্রীয় শাসন শুরু হয়। এতে দেশীয় জমিদার আর রাজাদের প্রাদেশিক ক্ষমতাভার হ্রাস পায় এবং অগণিত পাইক-লাঠিয়াল তাদের জীবিকা হারায়। পরে বাধ্য হয়ে তারাই গভীর বনে বা গুহার আড়াল থেকে ডাকাতিকে পেশা হিসেবে নিয়ে নেয়।

‘অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, বিভিন্ন স্থানের ডাকাতদের স্থান পরিবর্তনের কথা, যেখানে বীরভূমের ডাকাতরা বর্ধমানে অথবা বর্ধমান জেলার ডাকাতরা নদিয়াতে গিয়ে ডাকাতি করত। ওই বইতে সেইসব ডাকাতদের সংখ্যার একটা নমুনা দিয়েছিলেন। যা স্থান হিসেবে উত্তরবঙ্গে ৩০০ থেকে ৪০০ জন, মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গে প্রায় এক হাজার!

এলাকার ভিত্তিতে ডাকাতি করার একটা যুক্তি ছিল যে, সহজে লোক তাদের চিনতে পারবে না। তাই বারবার জেলা পালটে পালটে ডাকাতির ছক কষত তারা। অনেক ক্ষেত্রেই আগে থেকে চিঠি দিয়ে ডাকাতির দিন ঘোষণা করাকেও বীরত্বের নজির হিসেবে মনে করত। তবে তারা শুধু জমিদার বাড়িই ডাকাতি করত না, নদীপথে নৌকা বা খোদ কলকাতার রাস্তাতে জুড়িগাড়িতেও ডাকাতি করত।

পলাশীর যুদ্ধের তিন দশক পরেরও কলকাতাতে রাত ৮টার পর মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে চাইত না ডাকাতদের ভয়ে।

তৎকালীন ডাকাতরা ছড়িয়েছিল বাংলার প্রতিটি জেলায় জেলায়। পরে সেই বিখ্যাত ডাকাত দলের সর্দারের নাম থেকে বিভিন্ন জায়গায় নামকরণও হয়। যেমন, কুখ্যাত রানা ডাকাতের নাম থেকে রানাঘাট, ভুবন ডাকাতের নাম থেকে বোলপুরের ভুবনডাঙার মাঠ বা কলকাতার চিতে ডাকাত থেকে আজকের চিৎপুর।

ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়েও বহু ডাকাত সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল। তাদের ডাকাতির ধরণটা ছিল ধনীদের সম্পদ লুট করে গরিবদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া। এইসব ডাকাতদের নাম নিলে প্রথমেই আসে যাঁর নাম, তিনি হলেন বিশ্বনাথ সর্দার ওরফে বিশে ডাকাত। সোনার গহনা পরে তিনি পালকিতে ঘুরে বেড়াতেন সবসময়। তিনি ধনীদের মালামাল লুট করা ছাড়াও অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সাধারণ গরিব মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মসিহার মতো। পরে তার জীবন সম্পর্কে অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্যিক শ্রীশচন্দ্র মিত্র ‘বিশ্বনাথ’ উপন্যাসটি লেখেন।

ডাকাত মানেই যে জমিদার বা ভূস্বামীদের বিরোধী ছিল,তাও কিন্তু নয়। অনেক জমিদার নিজেও ডাকাত দল পুষতেন এবং সেই দলের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী জমিদারদের সম্পত্তি লুট করতেন। এভাবেই তারা নিজেদের সম্পত্তি বৃদ্ধি করতেন।

একসময় জনশ্রুতি ছিল মহিষাদলের রাজার মাইনেভুক্ত ডাকাত দল ছিল। এ ছাড়াও বর্ধমান বা বীরভূমের বহু জমিদার গোপনে ডাকাত দল পুষতেন। তাতে অনেক সময় ধরা পড়ে যেত তারা। শাস্তি হিসেবে তাদের ডান হাত আর বাঁ পা কেটে নেওয়া হত। তারপরই ক্ষতের উপর গরম ঘি ঢেলে দেওয়া হত, যাতে নিশ্চিতভাবে মারা যায়। ভাগ্যবলে বেঁচে থাকলে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কিছু উপায় থাকত না।

জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে ডাকাতিতে চিরকালই একটি উল্লেখযোগ্য স্থান বর্ধমান জেলা। বর্ধমানে ডাকাত বললে উঠে আসে জীবনা ডাকাতের নাম। যে ১৭৭০-থেকে ৮০ দশকে সেনপাহাড়ি পরগনাতে ভয়ঙ্কর সব ডাকাতি করে বেড়াত।

দেশকাল পেরিয়েও সেসব ডাকাতদের কথা আজও মনে গেঁথে রেখেছে মানুষ। সেটা যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বই ‘বাংলার ডাকাত’ পড়েই হোক অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতার সেই বীরপুরুষ সন্তানের ডাকাত তাড়ানোর মধ্য দিয়ে হোক।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.