জীবনে এসেছে প্রেম, দিন কেটেছে জেলখানায়, জন্মদিনে ফিরে দেখা বিদ্রোহী কবি-কে

 

ODD বাংলা ডেস্ক: আজ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। একেবারে ছোটবেলায় এই নামটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলেও, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, অধিকাংশ সময়ই নজরুলের জীবনচর্যা আমাদের জানা হয়ে থাকে পড়ার বইয়ের মধ্যেই। অথচ তাঁর হিমাদ্রী-শিখর কর্মজীনবের কথা আমাদের সকলেরই জানা উচিত। তাই আজ এই প্রতিবেদনে আপনাদের কাজী নজরুলের কিছু অজানা দিক সম্পর্কে তুলে ধরা হল-

কাজী নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী। সাধারণত মনে করা হয় দারিদ্র্যের প্রবল কষাঘাতে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয় বলে তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। কিন্তু আসলে মা জাহেদা খাতুনের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পরে নজরুলের জন্ম হয় বলে শিশুকালেই তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। ছেলেবেলায় তিনি ‘তারা ক্ষ্যাপা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। পরে ‘নুরু’ নামও তিনি ব্যবহার করেছেন।

সিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক এবং যুগান্তর দলের গোপন বিপ্লবী নিবারণ চন্দ্র ঘটক কিশোর নজরুলের মধ্যে স্বাধীনতা এবং বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার করেছিলেন। বিপ্লবী কর্মতৎপতার জন্য এক সময় এই শিক্ষকের বিচার হয়। আর বিপ্লবের সাথে যোগাযোগ আছে সন্দেহে দশম শ্রেণীর সেরা ছাত্র নজরুলের মাসিক ৫ টাকা হারে ছাত্রবৃত্তি কেড়ে নেওয়া হয়, যদিও পরে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বৃত্তি পুনরায় অব্যাহত রাখা হয়। করাচি সেনানিবাসে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও তরুণ নজরুলের সাহিত্য-সংগীত অনুরাগী মন দমে যায়নি, বরং অদম্য আগ্রহে খুঁজে নিয়েছে আপন পথ। প্রাণবন্ত  হৈ-হুল্লোড়ে আসর জমাতেন বলে সেনানিবাসে তিনি  “হৈ হৈ কাজী” নামে পরিচিত ছিলেন।

১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ৪৯নং বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দেওয়া শুরু হলে নজরুল স্থায়ীভাবে করাচী ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে তিনি একটি মেসে ওঠেন। কিন্তু তিনি যে মুসলমান একথা জানতে পেরে মেসের চাকর তাঁর এঁটো বাসন ধুতে আপত্তি জানায়। এমন অবস্থায় দু-দিনের মাথায় তিনি মেস ছাড়তে বাধ্য হন। অবশ্য মেস ছাড়ার পরে তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসের একটি কক্ষে মুজফফর আহমেদের সঙ্গে থাকা শুরু করেন। এই ব্যক্তি নজরুলের পরবর্তী ব্যক্তি জীবনে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। 

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকার ব্যবস্থা হওয়ার দুইদিন পর জিনিসপত্র রেখে কবি চুরুলিয়া গ্রামের বাড়িতে যান। যতদূর জানা যায় এই সময় মায়ের দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণের কারণে মায়ের সাথে মান-অভিমানের কোনো ঘটনা ঘটে। এরপর মা জীবিত থাকা পর্যন্ত নজরুল আর চুরুলিয়া যাননি, এমনকি যাননি মায়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পরও। এরপর ১৯২১ সালের ৫ মে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে সৈয়দা খাতুন নামের এক সম্ভ্রান্ত তরুণীর সাথে তরুণ নজরুলের পরিচয় হয়। সৈয়দা খাতুন ওই অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলেন। পরে তাকে আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ হলে নজরুল তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এই আকর্ষণ তাদের বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যায়, যদিও সে বিয়ে সফল হয়নি। পরবর্তীতে নাজরুলের দেওয়া ‘নার্গিস’ নামেই সৈয়দা খাতুন সবার কাছে পরিচিত হন।

অত্যন্ত অভিমানী নজরুল একটি রাতও তার নতুন বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে কাটাননি। কনের মামা আলী আকবর খান কাবিননামায় জবরদস্তিমূলক শর্ত আরোপ করেন যে নজরুল নার্গিসকে দৌলতপুর ছেড়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। অন্যায় এই বৈবাহিক শর্তে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল কনেকে গ্রহন না করে ভোর হবার আগেই চিরদিনের জন্যে দৌলতপুর ছেড়ে আসেন এবং পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় পৌঁছান। বিয়ে ভেঙে গেলেও নজরুল কখনও এর জন্য নার্গিসকে দায়ী করেননি। নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের রাতেই নজরুল অভিমানে ক্লান্ত মন নিয়ে কাদামাখা রাস্তায় দশ-এগারো মাইল হেঁটে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের বাড়িতে আসেন। এখানে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের জেঠাইমা গিরিবালা দেবীর কন্যা কিশোরী আশালতার (ডাক নাম- দুলি/দোলন এবং পরে নজরুলের দেওয়া নাম প্রমীলা) প্রতি নজরুল অনুরক্ত হয়ে পড়েন। হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলমান যুবকের এই সম্পর্ক কুমিল্লার কিছু গোঁড়া হিন্দু এবং রক্ষণশীল মুসলমান সমাজ মেনে নেয়নি, তাই নজরুলকে বারবার কুমিল্লা ত্যাগ করতে হয়েছে।

অবশ্য আরও জানা যায় কবির জীবনের একটা পর্যায়ে নাকি জাহানারা চৌধুরী নামক এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। জাহানারা চৌধুরী রবি ঠাকুরের আশির্বাদ নিয়ে বর্ষবাণী বলে একটা বার্ষিকী কয়েক বছর চালিয়েছিলেন। জাহানারা ও নজরুলের  মধ্যে পত্র বিনিময় হত। কবির অনেক পত্র ও কবিতা এই মহিলার কাছে ছিল। তবু নজরুলের জীবন প্রমীলা ছাড়া শুধু অসম্পূর্ণই না, অসম্ভবও ছিল।

‘যুগবাণী’র জন্য রাজদ্রোহমূলক প্রবন্ধ লেখা ও প্রচারণার অভিযোগে কবি গ্রেফতার হন ১৯২৩ সালে। হুগলীর জেলে নজরুল ৩৯ দিন কতৃপক্ষের অব্যবস্থা, অবমাননামূলক আচরণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদে আরো ২১ জন সহবন্দির সঙ্গে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। এসময় তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ায় তা তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের গভীর চিন্তার মধ্যে ফেলে। এ সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালিম্পং থেকে নজরুলকে অনশন ভাঙার অনুরোধ করে টেলিগ্রাম করেছিলেন, “Give up hunger strike, our literature claims you.” যদিও ব্রিটিশ সরকার সে বার্তা নজরুলের কাছে পৌঁছতে দেয়নি!

১৯২৪ সালে প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে হয় কলকাতায়। প্রমীলার বয়স ১৮ না হওয়ায় এবং নজরুল প্রমীলার ধর্ম পরিবর্তনে রাজী না থাকায় ‘আহলুল কিতাব’ মতে তাদের বিয়ে হয়। কনের মা ছাড়া কনেপক্ষের আর কেউই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না। নজরুলেরও হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুই উপস্থিত ছিলেন সেখানে। এমনকি গোলযোগের আশংকায় বিয়ের সময়ও আগে থেকে প্রকাশ করা হয়নি। এই বিয়েকে কেন্দ্র করে দুই ধর্মেরই মানুষজন মারমুখী হয়ে উঠলে নতুন দম্পতিকে কলকাতা ছেড়ে হুগলি আসতে হয়। হুগলিতে তাঁরা যদিও তরুণ বিপ্লবীদের সমর্থন পান, কিন্তু মুসলমান যুবক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করায় সেখানে কোনও হিন্দু বাড়িওয়ালা তাদের বাড়ি ভাড়া দিতে চায়নি।

যে বিয়ের জন্য এতো প্রতিকূলতা পেরতে হয়েছে কেমন ছিলো প্রমীলা-নজরুলের সেই বিবাহিত জীবন? তাঁদের কারওর জন্যই জীবনের চলার পথ সহজ ছিল না, কিন্তু তাঁদের পারস্পারিক ভালবাসা আর বোঝাপড়ার অভাব ঘটেনি কখনও। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় কাজ করার সময় কবি ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। তিনি ক্রমশ স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলতে থাকেন এবং মারধোর করতে লাগলেন। তিনি অনবরত কাগজ ছিঁড়েতে থাকতেন, চশমা সহ্য করতে পারতেন না এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেজাজ করতেন। কবিপত্নী আরো কয়েক বছর আগে থেকেই প্যারালাইসিস এ আক্রান্ত হয়ে সম্পুর্ণ বিছানাগত ছিলেন। (তখন উমা নামের একটি অল্প বয়সী মেয়ে সব সময় কবিপত্নীকে দেখাশোনা করতেন, এই উমাকেই পরে কবির বড়ো ছেলে কাজী সব্যসাচী বিয়ে করেন।) প্রমীলা নজরুল-কে এই অবস্থাতেও  মাঝে মাঝে নিজের পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিতেন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.