'নকল কলা'ই কি হবে আমাদের ভবিষ্যতের খাদ্য!

 


ODD বাংলা ডেস্ক: একদিকে তীব্র জলবায়ু সংকট, অন্যদিকে কোভিড মহামারি; দুইয়ে মিলে বিশ্বের লাখো মানুষের জন্য তৈরি করেছে খাদ্য অনিরাপত্তা। বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের (মূলত আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো) মানুষের ক্ষেত্রে এই নিরাপত্তাহীনতার মাত্রা সবচেয়ে বেশি।


জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে এবং বন্যা, খরা, দাবদাহ ও পোকার আক্রমণ থেকে শস্য সুরক্ষিত রাখতে না পারলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ এবং খাদ্য নিরাপত্তা গুরুতর হুমকির মুখে পড়বে।


উদাহরণস্বরূপ, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমনের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ভূট্টা ও গমের ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।


আফ্রিকা এবং মধ্য আমেরিকায় বার্ষিক প্রায় ৯৫০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ভূট্টা খাওয়া হয় এবং এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন ডায়েটে ভূট্টা একটি প্রধান ভূমিকা রাখে। এদিকে বিশ্বের মোট ক্যালরির ২০ শতাংশের বেশি পূরণ করে গম।


উদ্যানবিদ্যা ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত খাদ্যশস্যকে মানুষের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে, যেগুলো ক্রমশ উষ্ণতর হতে থাকা বিশ্বে টিকে থেকে মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারবে।


'ফলস ব্যানানা' বা নকল কলা আসলে কি?


এনসেট বা 'ফলস ব্যানানা' (নকল কলা) ইথিওপিয়ার বহুল প্রচলিত একটি ফসল। ১০ মিটার উচ্চতার এই বারমেসে-বহুবর্ষজীবী গাছটি 'ইথিওপিয়ান ব্যানানা' নামেও পরিচিত। ইথিওপিয়ার দক্ষিণপূর্ব পার্বত্য অঞ্চলে জন্মানো এই ফসলটি এ অঞ্চলের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের প্রধান খাদ্য। 


তবে নামে 'কলা' যুক্ত থাকলেও এটি আসলে কোনো ফল নয়। কিন্তু কলাসদৃশ দেখতে হওয়ায় এর নাম 'নকল কলা'। এর কলাসদৃশ ফলটি খাওয়ার উপযুক্ত নয়, কিন্তু ফলস ব্যানানা গাছের শ্বেতসারবহুল কাণ্ড বা ডাঁটা এবং এর মূল খাওয়া যায়। এগুলোর কোমল মণ্ড গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয় এবং ডো বানিয়ে পরিজ ও 'কোচো' নামক এক ধরনের রুটি বানিয়ে খাওয়া হয়। ইথিওপিয়ানরা সাধারণত সকালের নাস্তায় এটি খেয়ে থাকে।


এনসেট ইথিওপিয়ার বাইরে আবাদ করা হয়না, যদিও এটি দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত অঞ্চলজুড়ে নদী উপত্যকা ও গিরিখাতে বুনো ফসল হিসেবে এমনিতেই জন্মে। বুনো এই গাছটি তেতো এবং বিস্বাদ। কিন্তু এর বাহ্যিক গঠনরূপ দেখে মনে করা হয়, এটি ভিন্ন জলবায়ুতে আরো বড় পরিসরে আবাদ করা সম্ভব।


খাদ্যের উৎস হিসেবেও এনসেট চমৎকার কার্যকরী এবং বছরে একজন মানুষের চাহিদা মেটাতে ১৫টি গাছের প্রয়োজন হয়। ইথিওপিয়ানরা এটিকে 'দ্য ট্রি এগেইনস্ট হাঙ্গার' বা 'ক্ষুধা দূর করার গাছ' বলে থাকে। কারণ অন্যান্য শস্য যখন ফল দিতে পারে না, তখন এনসেট তাদের জীবন বাঁচায়।


এনসেট কেন জলবায়ু সহনশীল?


জলবায়ু পরিবর্তন আরো চরম রূপ ধারণ করলে এনসেট বা নকল কলা পৃথিবীর ১০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্যের চাহিদা পুরণ করতে পারবে বলে মত লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনের ডা. জেমস এস বোরেল এবং ওলেফ কোচ এর। 'এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ' জার্নালে তাদের প্রকাশিত নতুন গবেষণায় এমনটা জানিয়েছেন দুই গবেষক।


বিজ্ঞানীদ্বয় বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদেরকে আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়ার (ফুড সিস্টেম) সহনশীলতা ও সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জের মাত্রা তুলনাহীন, কিন্তু মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা নয়।"


তারা আলু ও টমেটোর উদাহরণ দিয়ে বোঝান, যেগুলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উৎসারিত। কিন্তু এখন এই সবজিগুলো বিশ্বের সব জায়গায় চাষ হচ্ছে।


এনসেট বা 'নকল কলা' গাছকে খরা প্রতিরোধী ও রোগজীবাণু সহনশীল হিসেবে মনে করা হয়। কারণ এটি সারাবছর জন্মে এবং সহজেই সংরক্ষণ করা যায়।


গবেষণায় আরো বলা হয়, ২০৭০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে হয়তো এনসেট উৎপাদনের সম্ভাব্যতা ৩৭-৫২ শতাংশ কমে যেতে পারে। কিন্তু তবুও ইথিওপিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের বিশাল এলাকা, কেনিয়া ও উগান্ডা, বিশেষ করে লেক ভিক্টোরিয়া ও ড্রাকেনসবার্গ অঞ্চল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পার্বত্য অঞ্চল এই ফসল উৎপাদনের উপযুক্ত রয়ে যাবে।


কেন এনসেট শুধু সীমিত পরিসরে জন্মায়? 


লন্ডনের কিউ টিমের গবেষণায় দেখা গেছে, এনসেট শুধু নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় জন্মানোর পেছনে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভূগোলের অবদান রয়েছে।


আফ্রিকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের ৮০ ভাগই ইথিওপিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত যা একটি দুর্গম-বিচ্ছিন্ন এলাকা। এ অঞ্চলের মানুষেরা শত শত বছর ধরে বাইরের পরিবেশের প্রভাবমুক্ত রয়ে গেছে।


এনসেট এ অঞ্চলে সবচেয়ে ভালো জন্মায় ঠিকই, কিন্তু তা শুষ্ক-নিচু এলাকায় জন্মানোর অনুপযোগী। শুধু তাই নয়, এনসেট চাষের জন্য পর্যাপ্ত স্থানীয় জ্ঞান দরকার যা শুধু ইথিওপিয়ানরাই জানে। আর গবেষকদের মতে, এটিই এই ফসল অন্যত্র আবাদের ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.