যেভাবে পাঞ্জাব থেকে এসে বাংলার জমিদার হলেন মান্নালাল রায়



 ODD বাংলা ডেস্ক: সুদূর পাঞ্জাব থেকে বাংলায় এসে মান্নালাল রায় হয়ে উঠলেন জমিদার। সোনা, হিরে, জহরতের ব্যবসা করতেন তিনি। শিখ ধর্ম থেকে দীক্ষা নিলেন হিন্দু ধর্মে। রংপুরের মাহিগঞ্জ অঞ্চলে দামি পাথর, সোনা, রুপোর পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন ১৮ শতকের শেষে। ওই সময় মাহিগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা সদর। 

মান্নালাল যেখানে হিরে জহরত দিয়ে সাজানো টুপি বা তাজ বিক্রি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন, সেখানে ওই টুপির বিক্রিকেই কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে জমে ওঠে একটা হাট, আর জায়গাটারও নাম হয়ে যায় তাজহাট। রত্নের ব্যবসা করে অনেক জমিজমার মালিক হয়েছিলেন মান্নালাল। 

রংপুরের বিভিন্ন জায়গায় তিনি জমিদারি গড়ে তোলেন। তাজহাটেই একটি প্রাসাদ তৈরি করিয়েছিলেন তিনি। যদিও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে প্রাসাদটি ভেঙে পড়ে আর মান্নালালা নিজেও আহত হন, মারাও যান পরে। তার দত্তক নেওয়া ছেলে গোপাল লাল রায়বাহাদুর জমিদারির দায়িত্ব পেয়ে কমবেশি দুই হাজার রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে শুরু করান তাজহাটের এখনকার জমিদারবারি বানানোর কাজ। তখনকার দিনের প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচের পর ১৯১৭ সালে বাড়িটি তৈরির কাজ শেষ হয়। 


রংপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে সাড়ে ১৬ একর জমিতে ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির জায়গা জুড়ে রয়েছে তাজহাট জমিদারবাড়ি। ঢাকার আহসান মঞ্জিলের মতো খানিকটা দেখতে এই বাড়ি লাল ইট, শ্বেত পাথর আর চুনা পাথর দিয়ে তৈরি। অট্টালিকায় ঘর আছে মোট ২২টি। 


চারতলা প্রাসাদের তিন আর চার তলায় রয়েছে রাজা গোপাল লালের জিনিসপত্র। দোতলায় ওঠার জন্য তিনটে সিঁড়ি রয়েছে, তারমধ্যে মাঝখানেরটা সবথেকে বেশি চওড়া। একটা সময় সিঁড়ির দুপাশে দোতলা পর্যন্ত ইটালিয়ান মার্বেলে তৈরি রোমান দেবদেবীর মূর্তি দিয়ে সাজানো ছিল। 


এখন সেগুলো আর দেখা যায় না। বারান্দার মেঝে সাদা আর ছাই রঙের পাথরে মোড়ানো। প্রাসাদে ইটালিয়ান শৈলীতে বানানো মার্বেল পাথরের মোট ৩১টি সিঁড়ি রয়েছে। প্রাসাদের ছাদে ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটা গম্বুজ। রাজবাড়ির পেছনে রয়েছে সুড়ঙ্গের সঙ্গে যুক্ত একটা গুপ্ত সিঁড়ি। লোকে বিশ্বাস করেন, সুড়ঙ্গ চলে গেছে ঘাঘট নদীর তীরে। তবে এখন নিরাপত্তার কারণে সুড়ঙ্গ বন্ধ করা আছে। 

প্রধান ভবনের ঠিক সামনে দোতলায় ওঠার জন্য গ্যালারির মতো একটা সিঁড়ি বানানো আছে। আম, কাঁঠান, মেহগনি, কামিনীর মতো গাছগাছালি আর বড়ো মাঠে ঘেরা জমিদারবাড়ির দুদিকে রয়েছে দুটি পুকুর। 


এই জমিদারবাড়িটি ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করা হতো বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রংপুর হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯৫ সালে প্রাসাদটিকে সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০৫ সালে রংপুর জাদুঘরকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় এই বাড়ির দোতলায়। জাদুঘরে রাখা আছে ১০ ও ১১ শতকের অপরূপ টেরাকোটার ভাণ্ডার। সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি ভাষায় লেখা খুব পুরোনো কিছু পাণ্ডুলিপিও রয়েছে এখানে। তার মধ্যে ঔরঙ্গজেবের সময়ে লেখা কোরআন, রামায়ণ, মহাভারতের সংগ্রহ দেখার মতো। 


ঢাকার থেকে কল্যাণপুর, গাবতলি, মহাখালি বাস টার্মিনাস থেকে বাস ধরে যাওয়া যায় রংপুরে। রংপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সায় তাজহাটের প্রাসাদ ও জাদুঘর। ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের বাস ধরলে সরাসরি নামা যায় জাদুঘরের সামনে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.