খেলার রূপকথা, স্বপ্ন যখন বাস্তব হয়
ODD বাংলা ডেস্ক: রূপকথা বলে কিছু নেই। নেই কি?
স্বপ্ন কখনও কখনও বাস্তব হয়। আমেরিকার নিঃসন্তান এক কৃষ্ণাঙ্গ টেনিস খেলা দেখতে গিয়ে জানতে পারেন যে, এক টেনিস খেলোয়াড় মাত্র চার ঘণ্টা পরিশ্রম করে ৪০,০০০ ডলার পর্যন্ত আয় করেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলেন, তাঁর সন্তান হলে তারাও টেনিসই খেলবে।
প্রথম সন্তান জন্মায় কয়েক বছর পর। কন্যা। কিছু পরে দ্বিতীয় সন্তান। আবারও কন্যা। তত দিনে তিনি পরিকল্পনা করে ফেলেছেন, কী ভাবে তাদের বিশ্বজয়ী করতে হবে।
দুই কন্যাই টেনিস খেলোয়াড় হন। প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম পান ২০০৩ সালে। ২০১৭-র মধ্যে দুই বোন ৩০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম সিঙ্গল্স জেতেন। ডাবল্স ধরলে ৪৪টি। তুলনা করুন রজার ফেডেরারের সঙ্গে। তিনি পেয়েছেন ২০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। আর রাফায়েল নাদাল ২১টি।
এই বাবার কাহিনি ‘কিং রিচার্ড’ এখন অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র।
এ তো গেল আমেরিকার কথা। বেশি না হলেও আমাদের দেশে কি কোনও ‘কিং রিচার্ড’ আছেন? অনুসন্ধান করল আনন্দবাজার অনলাইন।
কলকাতা ময়দানের ঋত্বিক দাসের মাকে দেখা যায় ছেলের সঙ্গে। বরাবর। ঋত্বিকের গোলে এটিকে মোহনবাগানের আইএসএল লিগ-শিল্ড জয়ের স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল। এই জয়ের অনুশীলন শুরু হয়েছিল ১৩ বছর বয়স থেকে। তখন ঋত্বিক নবম শ্রেণি। আর সে সময় থেকে মাঠে-ময়দানে ঋত্বিকের সঙ্গী তাঁর মা মিতা দাস। আইএসএলে জামশেদপুর এফসি-র হয়ে খেলে সবুজ-মেরুন স্বপ্ন ভেঙে-দেওয়া ছেলের অনুশীলনের সময়ে এখনও পাশে থাকেন মা।
ঋত্বিকের বাড়ি আসানসোল। সেখান থেকে এসে কলকাতায় খেলার অনুশীলন সহজ ছিল না। সেই জোর জুগিয়েছেন মা। নিয়মিত আসানসোল থেকে ছেলেকে নিয়ে কলকাতার ময়দানে আসতেন মিতা। তিনি খেলোয়াড় নন। সাধারণ বাড়ির মেয়ে-বৌদের কাছে খেলোয়াড় তৈরি করার তেমন তথ্য সহজে আসেও না। তবে নিজের চেষ্টায় খোঁজ নিয়ে মোহনবাগান স্কুলে ছেলেকে ভর্তি করার সব তথ্য জোগাড় করেন মিতা।
এখন ঋত্বিক ২৫। জামশেদপুরের হয়ে খেলেন। এখনও দায়িত্ব সামলে চলেছেন মিতা। আইএফএ-র অনুষ্ঠানে অনেকেই স্ত্রী-বান্ধবীদের নিয়ে যান। ঋত্বিকের পাশে দেখা যায় মাকেই। মিতা বলেন, ‘‘বাড়ির সব কাজ সামলে আসানসোল থেকে কলকাতা যাতায়াত করা সহজ ছিল না। কিন্তু চেষ্টা ছাড়িনি। ঋত্বিক একটু ভাল খেলছে দেখলেই আরও বেশি করে চেষ্টা করতাম। যথাসম্ভব এখনও ওর সঙ্গে থাকি।’’
কলকাতার কিশোরী গল্ফার শিঞ্জিনী মুখোপাধ্যায়ের জীবনও খুব একটা আলাদা নয়। বাবার ইচ্ছা ছিল, মেয়ে গল্ফ খেলবে। তার পরেই শুরু। তখন মেয়ের ছ’বছর বয়স। মেয়ের গল্ফ খেলতে ভাল লাগছে দেখে মা সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায়ও চেষ্টা চালিয়ে যান। শুরু হয় মেয়েকে নিয়ে দৌড়োদৌড়ি। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী এই গল্ফার ইতিমধ্যে পরপর দু’বার ‘আল্টিমেট গল্ফ অ্যামেচার ট্যুর’-এ জিতেছে। আমেরিকার ‘কিড্স ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন’-এও থেকেছে প্রথম ষাটের মধ্যে। এখনও আঠেরোয় পা রাখেনি। কলকাতার বহু গল্ফ খেলোয়াড় বলেন, শিঞ্জিনী লম্বা রেসের ঘোড়া। তার খেলা দেখলেও তা বোঝা যায়।
আর বোঝা যায় তার মায়ের চেষ্টা দেখলে। নিজে গল্ফ না খেললেও মেয়েকে খেলার মাঠ থেকে প্রতিযোগিতার ময়দান— নিয়ে যান সর্বত্র। ইতিমধ্যেই জুনিয়র গল্ফার হিসাবে এ রাজ্যে নাম ছড়িয়েছে শিঞ্জিনীর। যে কাজে অধিকাংশ ভারতীয় বাবা-মায়ের এখনও আপত্তি থাকে, তাতেও সায় দিয়েছেন তার অভিভাবকেরা। শিঞ্জিনী স্কুল যাওয়া বন্ধ করেছে। লেখাপড়া চলে ‘হোম স্কুলিং’-এর মাধ্যমে। খেলায় যাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায়, সে দিকেই নজর তার বাবা-মায়ের। তাঁদের জোগানো সাহসে ৪০০ মিটার দূর থেকে ঠিক গর্তে বল পৌঁছে দেওয়ায় অনেক বেশি মন দিতে পারে শিঞ্জিনী। রাজ্য ও জাতীয় স্তরে খেলার সুযোগ দিন দিন বাড়ছে এই বাঙালি গল্ফারের। মা সুপ্রীতি বলেন, ‘‘সারা দিনের রুটিন বেঁধে ওকে নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করি। মূলত অনুশীলনেই যায় ওর সময়। রোজ দু’বেলা শরীরচর্চার সময়ও সঙ্গ দিই। খেলোয়াড়দের মনের জোরও তো দরকার।’’ আপাতত সুপ্রীতির স্বপ্ন, মেয়ে দেশের হয়ে খেলবে। তার জন্য তাকে নিয়ে যে রাজ্যে যাওয়া জরুরি, সবেতেই রাজি এই মা। বলেন, ‘‘খেলার জগৎ সহজ নয়। অনেক খাটনি। তাই নিজের কোনও কাজ আর আলাদা করে করি না। সবটাই ওকে ঘিরে চলে।’’
মেয়েদের গল্ফ খেলতে খুব বেশি দেখা যায় না এ রাজ্যে। সে কথা শিঞ্জিনী নিজেও জানিয়েছে। যখন সবে সবে রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিত, তখন খুব বেশি মহিলা খেলোয়াড়ের দেখা মিলত না। তবে শিঞ্জিনীর মা সে সবে আমল দেননি। জাতীয় স্তরে পৌঁছে প্রতিযোগিতা বাড়ে। আরও অনেক মেয়েকে দেখতে পায় শিঞ্জিনী। এখন তার ইচ্ছা, ‘লেডিস প্রফেশনাল গল্ফ অ্যাসোসিয়েশন’-এ খেলার। আরও একটি স্বপ্ন আছে বাবা-মা-মেয়ের। তা হল, শিঞ্জিনী এক দিন অলিম্পিক্সে যোগ দেবে।
হায়দরাবাদ পর্যন্ত পৌঁছলে দেখা যাবে স্বপ্ন সফল হওয়ার আরও বড় এক কাহিনি। সানিয়া মির্জাকে টেনিস খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য বাবা ক্রীড়া সাংবাদিক ইমরান মির্জা চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দেন। মেয়ের ভবিষ্যৎ কী ভাবে তৈরি হবে, সে চিন্তাতেই মগ্ন থেকেছেন। টেনিস কোর্টে মেয়েকে একা লড়াই করতে হয়। কিন্তু বাইরে এলেই সানিয়া পেয়ে যেতেন বাবাকে। ইমরানই সানিয়ার কোচ, ম্যানেজার সব কিছু। বাবা ঠিক করে দিতেন সানিয়া সারা বছর কোথায় খেলবেন, কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন। সানিয়ার সঙ্গে দেশবিদেশে ঘুরতে ঘুরতে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন ইমরান। কিডনিতে পাথর হয়েছিল বিভিন্ন জায়গার জল খেয়ে। অস্ত্রোপচার করাতে হয়। তবু ধ্যান-জ্ঞান হয়ে থেকেছে মেয়ের সাফল্য। মেয়ের সঙ্গ ছাড়েননি। ভারত থেকে মেয়েদের মধ্যে সেরা টেনিস খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন সানিয়া। পিছন থেকে তাঁকে তৈরি করার কাজটা করে গিয়েছেন বাবা ইমরান।
এ পর্যন্ত ছ’টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন সানিয়া। ভারতীয় মহিলা টেনিসে এক নম্বরে তিনি। সিঙ্গল্সে হারিয়েছেন মার্টিনা হিঙ্গিসের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে। ভারতীয় টেনিসে বহু প্রথম সাফল্য এসেছে সানিয়ার হাত ধরেই। তিনিই ভারতের প্রথম টেনিস খেলোয়াড়, যিনি ‘উইমেন্স টেনিস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সিঙ্গলস জিতেছেন। এশিয়ান গেমস্, কমনওয়েলথ গেমস্, অ্যাফ্রো-এশিয়ান গেমস্ মিলিয়ে ১৪টি পদক জিতেছেন সানিয়া।
২০২০ সালের টোকিয়োর সামার অলিম্পিক্সে দেখা গিয়েছিল ভারতীয় গল্ফার অদিতি অশোকের ক্যাডি হয়েছেন তাঁর মা মহেশ্বরী। আবার ২০১৬-র রিয়ো অলিম্পিক্সে অদিতির বাবা ছিলেন তাঁর ক্যাডি। রিয়োতে ৪১ নম্বরে শেষ-করা অদিতি টোকিয়োয় চতুর্থ। টোকিয়োর প্রবল গরমে প্রত্যেক ক্রীড়াবিদই কোনও না কোনও ভাবে সমস্যায় পড়েছেন। অদিতিও তাঁর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু প্রবল রোদের মধ্যেও অদিতির মা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন মেয়ের পাশে।
২০১৬ সালে প্রথম অলিম্পিক্সে যোগদান বেঙ্গালুরুর অদিতির। তবে বাবা-মায়ের কাজ শুরু হয়েছে বহু আগে। বাবা অশোক এবং মা মহেশ্বরী অদিতিকে গল্ফ খেলতে নিয়ে যান যখন, তখন মেয়ের বয়স সবে পাঁচ। ১২ বছর বয়সে অদিতি এশিয়া-প্যাসিফিক ইনভিটেশন টুর্নামেন্ট খেলেন। এখন তিনি ‘লেডিজ ইউরোপিয়ান ট্যুর’ খেলেন। খেলেন ‘এলপিজিএ ট্যুর’-এও।
আমাদের সমাজ এখনও সামন্ততান্ত্রিক। সাধারণত বাবা-মা যে পথে হেঁটেছেন, সে দিকেই যান সন্তানেরাও। ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার, উকিলের সন্তান উকিল। রাজনীতিতে যেমন, খেলাতেও তা-ই। সিনেমায় তো খুব বেশি। সুচিত্রা সেন, মুনমুন সেন, রাইমা সেন। অপর্ণা সেন-কঙ্কনা সেনশর্মা। রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি, মুকুল রায়-শুভ্রাংশু রায়।
উত্তরসূরিরা অভিভাবকদের পথে হাঁটলে এক রকম। তাতে সাফল্য আসার পথ খানিকটা হলেও মসৃণ। কারণ, প্রতি ব্যক্তির পথ আলাদা আলাদা হলেও পথটি কিছুটা পরিচিত।
চেনা পথের বাইরে সন্তানকে এগিয়ে-দেওয়া বাবা-মায়েরা সব ক্ষেত্রে সাফল্য পান না। লড়াই কঠিন। এ দেশে সানিয়া ছাড়া তেমন সাফল্য এখনও বিশেষ দেখা যায়নি। তবে সাফল্য পেতে হলে কর্তব্যপরায়ণ বাবা-মা ছাড়াও প্রয়োজন প্রতিভা। বাংলা সাহিত্যে যাকে বলা হয়েছে ‘মন্ত্রশক্তি’।
মন্ত্রশক্তি জন্মগত। কারও আছে, কারও নেই। যেমন সানিয়ার মতো আর্ন্তজাতিক মানের খেলা আর কারও ক্ষেত্রে এখনও দেখা যায়নি। সে তাঁর বাবা-মা খেলোয়াড়ই হোন বা আসুন অন্য পেশা থেকে। দিন দিন প্রতিযোগিতা বাড়ছে। এখন শুধু বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা ও কর্তব্যবোধ অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয় না। ময়দানে টিকে থাকার জন্য জরুরি প্রতিভা।
যেমন এ দেশে লিয়েন্ডার পেজের কত নামডাক। চেষ্টায় হয়তো ত্রুটি রাখেননি তাঁর খেলোয়াড় মাতা-পিতাও। কিন্তু সেই লিয়েন্ডারও গ্র্যান্ড স্ল্যামের সিঙ্গলস্ খেলার সুযোগ পাননি। জেতা তো দূরের কথা!
অন্যরা কত দূর পারবেন, তা বলা কঠিন। কিন্তু রূপকথার মতো স্বপ্ন তো হয়। আর রূপকথা সত্যি না হলেও কিছু কিছু স্বপ্ন সত্যিও হয়। যে সত্যির নাম ‘কিং রিচার্ড’।
Post a Comment