স্বাধীন ভারতের ক্যানভাসে নতুন সমাজের ‘পাঁচালী’, ৭৫-এ প্রদর্শনী সিমা গ্যালারিতে



 ODD বাংলা ডেস্ক: ‘পথের পাঁচালী’-ই কি পথ দেখিয়েছে?


শুধু চলচ্চিত্র নয়। স্বাধীন ভারতের ভাবনার গতিপথ নতুন বাঁক নিয়েছে কি? ‘পথের পাঁচালী’ সাধারণের কথা বলে। নতুন ভাবে গড়ে উঠতে থাকা স্বাধীন ভারতের শিল্পকর্মে সমাজ-ভাবনা, সম্পর্ক, নাগরিক মনের প্রদর্শনে কি প্রভাব পড়েছে তার? কিছু ক্যানভাস, কিছু ভাস্কর্য সে কথা মনে করাতে পারে। ভাবনার গতি সেখান থেকে কোথায় গেল, তা জানার ইচ্ছা জোগায়।


স্বাধীনতার ৭৫-এ তেমনই কিছু ভাবনার রসদ জোগাচ্ছে সিমা গ্যালারি। প্রদর্শনীর নাম ‘কালার্স অব ফ্রিডম’। নগর সভ্যতাকে তুলে আনার ক্যানভাসের সঙ্গে মিশেছে পটচিত্র। ‘পথের পাঁচালী’-র দৃশ্যভাবনা, সত্যজিৎ রায়ের চোখে ধরা পড়া নব্য বাস্তববাদ প্রভাবিত করেছিল কিছু ক্যানভাস। স্বাধীনতাউত্তর ভারতে ইউরোপের সাংস্কৃতিক সে সব প্রভাব অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল কি বাস্তববাদের আঞ্চলিক কিছু সংস্করণের জন্মে? বিকাশ ভট্টাচার্য থেকে মকবুল ফিদা হুসেন— প্রশ্ন তোলে নানা শিল্পীর কাজ।


দ্রুত বদল এসেছে সামগ্রিক ভারতের অভিব্যক্তিতে। ৫০-এর দশক থেকে শুরু করে বর্তমান সময়, ‘কালার্স অব ফ্রিডম’ চোখ রাখে ভাবনার সেই পথ চলার আঁক-বাঁকে। ভিত্তোরিয়ো দি সিকা-র ছবি ‘বাইসাইকেল থিভ্‌স’ নতুন ভাবে সাধারণের গল্প বলার উৎসাহ জুগিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’। স্বাধীনতার সঙ্গে সাধারণের জীবনে আসে নানা বদল। কিছু মন্দ। কিছু স্বপ্ন। সে সব ক্যানভাসে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যায় দেশের আনাচ-কানাচে। সিমা গ্যালারি সাধারণের সে সব গল্প তুলে এনেছে। ৫০ থেকে ৬০-এর দশকের শিল্পীদের উপর তখনও সাধারণ ভাবে পশ্চিমী প্রভাব অনেক। প্রদর্শনীতে যেমন রয়েছে সোমনাথ হোর, কে. জি. সুব্রহ্মণ্যমের কাজ, তেমন আছে সইয়দ হায়দর রাজা, ফ্রান্সিস নিউটন সুজার পেন্টিং।


স্বাধীনতার আগে ‘বেঙ্গল স্কুল’ আধুনিকতার দিকে ঝোঁকে। মনে করান সিমা গ্যালারির অধিকর্তা রাখী সরকার। তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর ধাপে ধাপে বদল এসেছে শিল্পের ভঙ্গিতে। বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলেও নিজেদের জীবনের কথা বলার প্রচলন তৈরি হয়। সে সব কাজও আমরা রেখেছি এই প্রদর্শনীতে।’’


সাধারণের জীবন ধরা দেয় যোগেন চৌধুরী থেকে গণেশ পাইন, ১৯৬০ পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের কাজেও। এ প্রদর্শনীতে যোগেন চৌধুরীর ক্যানভাস যেমন দেশভাগের কথা মনে করায়, গণেশ পাইনের ‘মহাভারত’-দর্শন আবার নবভারতের রং-তুলির টানে পরিবর্তনের কথা দেখায়। মীরা মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা সিংহের পেন্টিং নতুন যুগের নারীর জীবনভাবনা নিয়ে আসে। স্বর্ণ চিত্রকরের কাজ পুরুষতান্ত্রিকতা ভেঙে বেরোনোর নতুন কথা বলে। আর পাশ থেকে উঁকি দেয় পটচিত্রে মঙ্গল-কাব্য। বাবরি ধ্বংস থেকে ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যু, অতিমারি থেকে অর্থনৈতিক সঙ্কট— নানা সময়ের কথাই বলেছে স্বাধীন ভারতের শিল্প। বলার ভঙ্গি এক এক সময়ে এক এক প্রকার হয়তো। নানা রঙের ব্যবহারে রিজওয়ানুরের মৃত্যু ধরে রেখেছে সুমিত্র বসাকের ভাবনা। ধর্ম, ধর্ম নিয়ে টানাপড়েন, দেশভাগের পরও নানা ভাবে এসেছে, মনে করায় এ সময়ের শিল্প। যেমন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে চিৎকার করে সমসাময়িক আর এক শিল্পীর কাজ।


সে কাল থেকে এ কালে আসার মাঝে ধাপে ধাপে বদল এসেছে শিল্পীর শৈলীতে, ফ্রেমে, কথা বলার ধরনে। হরেন দাস, হিম্মত শাহ, ভুপেন কক্কর, লালুপ্রসাদ সাউ, পরমজিৎ সিংহ, শর্বরী রায়চৌধুরী থেকে সুষেন ঘোষ প্রভাকর কোলটে, ইউসুফ, পালানিয়াপ্পন, রবীন্দ্র রেড্ডি, সমীর আইচ, পরেশ মাইতি, সুবোধ গুপ্ত, শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়, সোহম গুপ্ত— নানা জনে, নানা ভাবে সে সব কথা দেখান। শেখান। নতুন ধারণা তৈরি করেন। কারণ ৭৫ বছরের বিভিন্ন ধাপে এসেছে নতুন উদ্বেগ, চিন্তা, আনন্দ, গর্ব। শিল্প সব ধরে রাখে। কখনও টেরাকোটা, কখনও কাঁথার কাজও তা দেখায়।


প্রদর্শনীর প্রায় শেষ প্রান্তে নির্বিঘ্নে চলতে থাকে ৭০-এর দশকের ‘শোলে’ ছবির কিছু দৃশ্য। নতুন ভারতের নতুন সিনেমা-ভাবনা। নব্য রাগী নায়ক। পৌরুষ। সম্পর্ক। নারীত্ব। বন্ধুত্ব। সংগ্রামের নব নির্মিত ধারণা একসঙ্গে ধাক্কা দেয়। বলে দেয় ‘পথের পাঁচালী’-র কিছু দৃশ্য ও তা ঘিরে তৈরি হওয়া কিছু ক্যানভাস শুরু হওয়া প্রদর্শনী ‘শোলে’-র সামনে এসে নতুন ভারতে বদলাতে থাকা রূপ স্পষ্ট করে তুলে ধরে যেন। স্বাধীন ভারতে গত ৭৫ বছরে আরও বহু নতুন ধারণা, ভাবনার সংযোজন ঘটেছে। প্রান্তের শিল্প কেন্দ্রকে প্রভাবিত করেছে। কেন্দ্রের ভাবনা প্রান্তকে। স্বাধীনতার সে সব রং-ও ধরা পড়ে গ্যালারির দেওয়ালে দেওয়ালে।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.