পি সি সরকার যখন একটা খুন করেছিলেন, অতঃপর...

পোড়া চামড়ার মানুষ, সে কিনা জাদু দেখাবে! এত স্পর্ধা! ছাত্রজীবনে অঙ্কের জাদুকর, পরিণত বয়সে মঞ্চের। কে তাঁকে উঠতে দিল, না দিল, তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। প্রতুল চন্দ্র সরকার নিজেই নিজের নামের আগে বিশেষণ যোগ করে নিলেন—বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাদুকর। দ্য ওয়ার্ল্ডস বেস্ট ম্যাজিশিয়ান। সংক্ষেপে টিডব্লিউবিএম।

কেউ ভাবতেও পারেনি, এই স্বঘোষিত বিশেষণটিই তাঁকে দূর দূরান্তের মঞ্চে কি তুমুল খ্যাতির জোগান দিতে চলেছে। অধুনা যিনি পি সি সরকার (সিনিয়র), এমনতর সম্মান তো শুরুতেই তাঁর মেলেনি। প্রাচ্য জগৎ মানেই জাদুমঞ্চে ব্রাত্য। এরকমই একপেশে ধারণায় অভ্যস্ত পৃথিবীটার টুঁটিতে টান পড়তে দেরি ছিল তখনও। ভবিষ্যতের মহারাজা জাদুকর তখনও ইতিউতি দেশীয় সার্কাসে জাদু দেখিয়ে চলেছেন। রপ্ত করছেন সম্মোহন। পাখির চোখ তাঁর বিশ্বমঞ্চ। সাহেবদুর্গ ভেদ করা।

আরও ভিডিও -র জন্য সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল

সরকার থেকে বদলে গিয়ে ‘সোরকার’ হয়ে গেছেন আগেভাগেই। ততদিনে অবশ্য পরিবারের জমিদারিটি নেই। জাহাঙ্গিরের দরবার থেকে উপহার পাওয়া জমিদারি। জাদুতে মোহিত করে সে উপহার জিতে ফিরেছিলেন পরিবারের ঊর্ধ্বতন অষ্টম পুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র দেব।


জমিদারি না থাক, প্রতুলচন্দ্রের জন্মটাই কিন্তু প্রাপ্তির বছরের। ১৯১৩। সে বছরটা বাংলার প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির।


কিন্তু ওই যে। চামড়া বাদামি। হেলাফেলাটা তাই ভাগ্যের নিয়ম। লন্ডনে থিয়েটার হল বুক করলেন বটে। টানা তিনসপ্তাহ ম্যাজিকের শো বসবে। কিন্তু দর্শক আর জুটছে কই। পঞ্চাশের দশকের সে সময়টা সাহেবি উন্নাসিকতা কিছুটা বেশি ছিল বইকি।

সোরকার বরাবরই ব্যতিক্রমী। বেপরোয়া। নিজের বিজ্ঞাপন নিজেই করেন। বাদামি মানুষদের যেমন ভবিতব্য আর কি!

সে সময়টা বিদেশেও ছোটপর্দার প্রসার তেমন হয়নি। বিবিসি টেলিভিশন সবে টলমল করছে।


প্রতুল সোরকার আবারও ঘটালেন এক কাণ্ড। বিবিসি-র স্লট বুক করে ফেললেন। শুরু করলেন তাঁর সবচেয়ে বিপজ্জনক খেলা, তাও আবার লাইভ।


উঁচু টেবিলে একেবারে ক্যামেরার সামনে শুয়ে পড়লেন জাদুকরের সতেরো বছরের তন্বী সচিব দীপ্তি দে। তাঁকে ফালা ফালা করে কাটতে শুরু করলেন প্রতুল চন্দ্র। পেট থেকে টুকরো করতে করতে যখন আরও ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলেন জাদুকর, নার্ভ আর ধরে রাখতে পারলেন না বিবিসি-র ঘোষক। শো দিলেন শেষ করে। আর তার পর থেকেই বিবিসি দপ্তরে শয়ে শয়ে দর্শকের ফোন—এইমাত্র চোখের সামনে এক পৈশাচিক খুন দেখেছেন তাঁরা!

প্রতুল চন্দ্র সরকার। বলা বাহুল্য, এর পরের তিনটে সপ্তাহে লন্ডনে তাঁর বুক করা থিয়েটার হলে একটা মাছি গলার মতোও জায়গা ফাঁকা ছিল না।

অবশ্য পাশ্চাত্যে তাঁকে যে দুর্নাম করার চেষ্টা হয়নি, তা নয়। খেলা ভেস্তে দেওয়ারও চেষ্টা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু জাদুতেই যাঁর যাপন, তাঁকে আর রুখবে কে! বিধির চোখরাঙানি তুচ্ছ করেও ছুটে যান দূর মঞ্চে। জাদুর টানে। ১৯৭১-এ জাপানের হোক্কাইডো শহরে সেই জাদুমঞ্চের নীচেই যে অপেক্ষা করে ছিল অমোঘ নিয়তি। মঞ্চসম্রাটকে শেষবারের মতো বিজয়রথে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য। অবশ্য সে কথা নাহয় থাক এখন। আজ দিনটা উদযাপনের। ভারতীয় জাদুগর্বের উদযাপন। ২৩ ফেব্রুয়ারি, জাদুসম্রাটের জন্মদিন।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.