শ্যামলী পরিবহন: গয়না বিক্রির টাকায় মিলেছে প্রথম নতুন বাস
ODD বাংলা ডেস্ক: শ্যামলী পরিবহন অনেকেই চেনেন। অনেকেই চড়েছেন- ঘুরেছেন। তবে শ্যামলী পরিবহনের আজকের এই অবস্থানের পেছনের গল্পটা কজনে জানি আমরা? সেই গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এক ব্যবসায়ী সাধক। তিনি শ্যামলী পরিবহন লিমিটেডের চেয়ারম্যান গণেশচন্দ্র ঘোষ।
শ্যামলী পরিবহন প্রাইভেট লিমিটেড আজ বাংলাদেশের বিলাসবহুল বাস পরিবহনের শীর্ষস্থানে, আর গণেশচন্দ্র নিজেও একজন সফল বিজনেস আইকন। তবে কেমন ছিল শ্যামলী পরিবহনের শুরুটা।
বছরটা ছিল ১৯৭২। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে বাংলাদেশ সদ্য একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সদ্যগঠিত যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের নাগরিকদের দুর্দশা তখন চোখে দেখার মতো নয়। জনঘনত্বের দিক থেকেও বাংলাদেশ তখন প্রথম স্থানে। অপুষ্টি তো রয়েছেই, তার মধ্যেই ৮-১০ মিলিয়ন মানুষ ছিন্নমূল হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সংকটজনক। প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চরম অভাব দেখা দিয়েছিল যুদ্ধের জন্য। মুক্তিযুদ্ধ দেশের পরিবহন ব্যবস্থাটিকেও সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছিল। কয়েকশো রাস্তা এবং রেললাইন ধ্বংস করা হয়েছিল যুদ্ধের সময়।
অবিনাশচন্দ্র ঘোষ তার বিরাট পরিবার নিয়ে তখন থাকতেন বাংলাদেশের পাবনা শহরের শালগড়িয়ায়। জীবন চালানোই ছিল এক সংগ্রাম। ১৩ জন সদস্যের পরিবার, তিনি নিজে এবং তার স্ত্রী, ৭ পুত্র ও ৪ কন্যাসন্তান। প্রত্যেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বেঁচে থাকার এক নতুন যুদ্ধে সামিল। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র গণেশচন্দ্র ঘোষ তখন এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বও এসে পড়ল তার কাঁধে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে চরম দারিদ্রের মধ্যে জীবন শুরু হয়েছিল গণেশচন্দ্র ঘোষের। তবে সবসময়ই তার স্বপ্ন ছিল বড়ো কিছু করার। লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় তাকে। এমনকি দৈনন্দিনের সামান্য প্রয়োজন মেটাতে ছোট থেকেই তিনচাকার রিকশা চালানো শুরু করেছিলেন তিনি।
তবে স্বপ্ন দেখতেন একদিন নিজের একটা বাস থাকবে, শুরু করবেন স্বাধীন ব্যবসা। তার এই স্বপ্নের কথা তখন যারাই শুনেছেন, তারাই মুখের ওপর হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যাবতীয় অবজ্ঞা সত্ত্বেও নিজের ওপর বিশ্বাস হারাননি তিনি। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
কিছু অর্থ জমিয়ে তিনি ১৯৭২ সালে একটি তিনচাকার স্কুটার কিনে ফেললেন গণেশচন্দ্র। এরপর পাবনা-সুজানগরের রাস্তায় বাণিজ্যিকভাবে স্কুটার চালাতে শুরু করলেন। সেই ভাড়াতেই সংসার চলত তাদের।
গণেশচন্দ্র ঘোষ নিজেই স্কুটার চালাতেন। পাবনা থেকে সুজানগর এবং পক্ষী ফেরিঘাট পর্যন্ত যাত্রীদের পৌঁছে দিতেন তিনি। পাবনা থেকে সুজানগর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার রাস্তার ভাড়া ছিল মাথাপিছু পাঁচ টাকা। আর পাবনা থেকে পক্ষী ফেরি টার্মিনাল পর্যন্ত ২২ কিলোমিটারের ভাড়া ২২ টাকা। প্রতিদিনের সেই উপার্জিত টাকা থেকেই নতুন করে সঞ্চয় শুরু করলেন গণেশচন্দ্র, নিজস্ব ব্যবসার জন্য।
একসময় তার ছোটো ভাই রমেশচন্দ্র এবং রমেন্দ্রনাথ ঘোষও যোগ দিলেন তার সঙ্গে। অবশ্য গণেশচন্দ্র পড়াশোনা ছাড়েননি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই বেরিয়ে পড়তেন যাত্রী পরিবহনে। এভাবেই একদিন কলেজের পাঠ শেষ করলেন। রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেন, কিন্তু জীবনের সংগ্রাম তার পিছু ছাড়ল না।
তিন ভাই ধীরে ধীরে অর্থ জমিয়ে কয়েকটি নতুন স্কুটার কিনলেন। আর এভাবেই শুরু হল শ্যামলী পরিবহনের পথচলা। প্রথম কেনা সেকেন্ড হ্যান্ড, ভাঙাচোরা স্কুটারটিতেই লেখা ছিল নামটি। স্কুটারের সংখ্যা যত বাড়তে লাগল, ততই সেটি একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়ে উঠল।
দুই বছর বাদে সমস্ত স্কুটার বিক্রি করে একটি সেকেন্ড হ্যান্ড বাস কিনে ফেললেন গণেশচন্দ্র। রাজশাহী থেকে নগরবাড়ি পর্যন্ত যাতায়াত করত সেই বাস। তবে গণেশচন্দ্রের স্বপ্ন তখনও পূর্ণ হয়নি। ১৯৭৮ সালে পাবনার সোনালি ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ঋণ নিলেন তিনি। সেইসঙ্গে পরিবারের নারী সদস্যদের সমস্ত গয়নাও বিক্রি করে দিলেন। এরপর কিনে ফেললেন একটি আস্ত বিলাসবহুল বাস।
১৯৭৯ সালে শুরু হল পাবনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত বাস পরিবহন। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা রাত্রিকালীন বাস চলাচল শুরু হয় ১৯৮১ সালে। এরপর থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি গণেশচন্দ্রকে। লভ্যাংশের প্রায় সমস্ত অংশই তিনি বিনিয়োগ করে গিয়েছেন ব্যবসার উন্নতির জন্য।
পরিবহনের ব্যবসায় নামার পর ৫০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। গণেশচন্দ্র ঘোষ এখন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। শ্যামলী পরিবহন এখন আর শুধু বাংলাদেশের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম নয়। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের নানা অঞ্চলেও পৌঁছে যায় তাদের বাস।
আন্তর্জাতিক পথে বাস পরিবহন শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। দেশে এবং দেশের বাইরে হাজার হাজার টিকিট কাউন্টার শ্যামলী পরিবহনের। পরিবহন ব্যবসায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানেও খোঁজ দিয়েছে এই সংস্থা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় শ্যামলী পরিবহনের বাস চলাচল করে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, শ্যামলীর বাস সর্বত্র পৌঁছে যায়।
আন্তর্জাতিক যাত্রাপথের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-কলকাতা, আগরতলা-ঢাকা, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি-ঢাকা, চট্টগ্রাম-ঢাকা-কলকাতা রুট।
সময় বদলেছে। কিন্তু গণেশচন্দ্র তার নিজের মূল্যবোধের কাছে সবসময় স্থির। মাটির মানুষটি কখনও তার জীবনের শুরুর দিনগুলোর কথা ভুলে যাননি। আজও তাই তিনি সাদামাটা জীবন যাপন করেন। একসময় পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজে রসায়ন বিষয়ে অধ্যাপনাও করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে সেখান থেকে অবসর নিয়েছেন।
এভাবেই গণেশচন্দ্র ঘোষ আজ এমন একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগের কর্ণধার, যা সমস্ত দেশের মধ্যে বিলাসবহুল পরিবহনের একটি মাইলস্টোন তৈরি করে দিচ্ছে। পরিবহন ব্যবসার মুকুটহীন সম্রাট গণেশচন্দ্র ঘোষের অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস আজও সমস্ত উচ্চাকাঙ্খী উদ্যোগপতিদের অনুপ্রাণিত করে।
Post a Comment